বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ঠাঁয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। চিৎকার করে ছাত্রছাত্রীদের হত্যার বিরোধিতা করেছেন। আজ যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ বিজয়ী হয়েছেন, তখন তিনি ফিরে গেছেন কল্পনা চাকমার গুম হওয়ার প্রসঙ্গে। একটা প্রতিবাদ থেকে আরেকটা প্রতিবাদের দিকে তাঁর যাত্রা। বাংলাদেশের গণজাগরণের পর অকপট, অনর্গল ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, রোববার.ইন-এর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে। অনেকেই তাঁর মন্তব্য জানতে চেয়েছেন, কিন্তু তিনি আপাতত এই আন্দোলনকে ধাতস্থ করছেন অন্তরে।
তিতাস রায় বর্মন
প্রথমেই বলি, বাংলাদেশের এই বন্যা পরিস্থিতিতে আমরা শোকাহত, চিন্তিতও। বাংলাদেশ এখন কেমন আছে?
আমাদের এখানে কয়েকটি জেলা ভয়াবহ বন্যা-আক্রান্ত। তবে ফেণীর দিকে পানি কমতে শুরু করেছে। অসংখ্য বাড়িঘর ভেসে গেছে, বহু মানুষের খোঁজ নেই। তবে পাল্লা দিয়ে চলছে ত্রাণকার্যও। স্বেচ্ছাসেবকরা অভূতপূর্ব কাজ করছেন। এই মুহূর্তে আমরা একটা অগোছালো রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে আছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বন্যা নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা আছে কি না, সেটা আমরা বুঝতে পারছি না কারণ সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, বিশেষ করে ছাত্র-জনতার ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ক্ষমতা দেখেছি। আজ বন্যা পরিস্থিতিতেও দেখছি। ছাত্র-জনতার এই ঐক্যের নেপথ্যে কি অভ্যুত্থানের সাফল্য রয়েছে?
অবশ্যই এই দুটোর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বাংলাদেশে এতদিন ছাত্র-জনতার দুর্নাম ছিল যে, তারা খুব ‘অরাজনৈতিক’। রাজনীতিতে আগ্রহহীন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কারণ রাজনীতি বুঝতে আমরা এতদিন দলীয় পতাকার কর্মকাণ্ডই বুঝতাম। কিছু অংশগ্রহণ নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এবার যেটা দেখছি, সেটা একটা জোয়ার। মুহূর্তের মধ্যে আমার দেশের জনতার, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মানবিকতা, দেশাত্মবোধ একটা উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, আজকে ছাত্র-জনতার ঐক্য সরাসরি সম্পর্কিত গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে।
কতদিন লাগবে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে?
আসলে বন্যার জল নেমে গেলেও পুনর্বাসনে সময় লাগে। আমাদের সেনাবাহিনী কাজ করছে, ছাত্র-জনতা তো আছেই। কীভাবে কাজ এগোবে, তার একটা কাঠামো তৈরি করেছে ওরা নিজেরা। দলে দলে ভাগ হয়ে গেছে। আমি আশাবাদী।
যখন মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছিল, যখন সইয়ে নিয়েছিল স্বৈরাচার, তখন আমাদের উপমহাদেশে হঠাৎ গণজাগরণ হল, হয়ে চলেছে। এটার কারণ কী?
হ্যাঁ, এটা খুব জরুরি প্রশ্ন। আমাদের উপমহাদেশে প্রতিবাদের একটা জোয়ার এসেছে। অনেকদিন ধরেই এই প্রতিবাদহীন সময়টার মধ্যে বাস করতে করতে আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আবার মানুষের যুগ ফিরে আসছে। আমি এটা বিশ্বাস করছি। কারণ আমি নিজের চোখে দেখেছি নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ক্ষমতা। একদিন আমাদের বাচ্চারা ঠিক করল এই অসম্মানের, এই অপমানের জীবন তারা আর বাঁচবে না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। সেই শক্তি, সেই চোখ নিয়ে বাচ্চারা যখন রাস্তায় দাঁড়াল, সেটা সব পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিল। এতগুলো সশস্ত্র বাহিনী উপস্থিত ছিল সেখানে, আরও কত কী যে হতে পারত! আমি একটা মৃত্যুকেও খাটো করতে চাই না, কিন্তু ছাত্রদের যে দৃপ্ত স্লোগান– আমরা মরতে ভয় পাই না, এই জন্যই কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী পিছু হটল। এটাই প্রতিবাদের শক্তি। কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে যে ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এল, তাদের রুখবে কে? তারা বাবা-মাকে বলে দিয়েছিল যে তারা ফিরবে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি এই ছেলেমেয়েদের চোখ। এরপর আমাদের ঘরে বসে থাকা মানায় না। আমরা ঘর থেকে বেরিয়েছি আমাদের ছেলেমেয়েদের সাহসে। মানুষ যদি জেগে যায়, কোনও শক্তি তার সামনে টেকে না– আমরা ছোটবেলায় বইয়ে পড়েছিলাম। সেটাই সরাসরি প্রত্যক্ষ করলাম এবার। আমেরিকাতেও তো দেখলাম ছাত্র-জনতা প্যালেস্তাইনের সংহতিতে কত না লড়াই করল। একটাই আহ্বান– যুদ্ধ বন্ধ হোক। সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদের জোয়ার ছড়িয়ে পড়ছে এখন। এটাই হল অস্ত্রের বিরুদ্ধে, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের ডাক। মুনাফার দুনিয়ায় মানুষ একদিন জেগে ওঠেই। পৃথিবীর সব মুনাফাবাজ সরকার একজায়গায় হয়েছে, পুঁজিবাদী শক্তি একত্র হয়েছে, তাহলে সব দেশের মানুষ একসঙ্গে জেগে উঠবে না কেন? একটা দেশের সরকারকে যেই মুহূর্তে বয়কট করছি, সেই মুহূর্তে আমি সেই দেশের নিপীড়িত মানুষের বন্ধু হচ্ছি। সারা পৃথিবীর মানুষেরা এক হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস আছে, আজ তাদের মিছিলে শোনা যাচ্ছে– ‘তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি’। ব্রিটেনে একটা জায়গায় দেখলাম পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ জড়িয়ে তারা ‘জনগণমন’ গাইছে। এটাই মানুষের ক্ষমতা, এটাই অস্ত্রের বিপরীতে মানুষের সবচেয়ে বড় বিজয়। এই ছেলেমেয়েরা যে খুব ইতিহাস-বলা প্রজন্ম, তা আমি বলব না। ওরা এই মুহূর্তের মাটি থেকে ভালোবাসার গল্প বলছে, আমি ওদের থেকে সেটা শিখতে চাই।
বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এক ধরনের প্রতিবাদের নিশান দেখিয়েছে। প্রতিবাদের এই ধরনটাই কেন কার্যকর হল?
আসলে গণজাগরণের কোনও প্রেসক্রিপশন হয় না। নিষ্পেষিত মানুষ কখন কীভাবে জেগে উঠবে, সেটা আগে থেকে কেউ বলে দিতে পারে না। বিভিন্ন জায়গায় নিপীড়নের আলাদা আলাদা ধরন, সেখান থেকে প্রতিরোধ তৈরি হবে। আমাদের বিদ্বজ্জনেরা তো আন্দোলনের শুরুতে চেনা ছকের পথ বাতলেছিলেন। তা তো কর্যকর হল না। মাটির ভেতর থেকে হঠাৎ সর্বস্তরে জাগরণের ডাক এল। সব ধরনের মানুষ জীবন বাজি রেখে সেই ডাকে সাড়া দিল। এটা আগে থেকে বলে-কয়ে হিসেব কষে হয় না। যে অঞ্চলের সংগ্রাম যেমন, তেমনভাবে তৈরি হবে সেই অঞ্চলের প্রতিবাদের নকশা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ ঠিক পথ নামবে। এটা পরিকল্পনা করে হবে না।
এই মুহূর্তে ভীষণ চর্চায় ‘অরাজনৈতিক’ শব্দটা। আপনার কাছে এর অর্থ কী?
রাস্তায় সবাই নামতে পারে না। ঘরের মধ্যে নারী-পুরুষের সংঘাতে যখন ছেলের মা মেয়েটির পক্ষ নিচ্ছে, তখনই সেটা রাজনৈতিক হয়ে যায়। সে তখন যুদ্ধ করছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। একটা কথা এক্ষেত্রে বলব, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, মেয়েদের অবস্থা বদলায় না। কোনও বৈষম্য ও নিপীড়নকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ কি আমাদের আর আছে? ‘অরাজনৈতিক’ শব্দটা তাই অমূলক। যাঁর রিকশায় আমি উঠি, তিনি যে ছোট্ট কথাটা বলেন, সেটাও রাজনীতি। ফুলের ব্যবসায়ীর কথা রাজনৈতিক। আমরা যে সমাজে থাকি, সেখানে আর বলার সুযোগ নেই যে আমরা রাজনীতির মধ্যে পড়ি না। কোন রাজনীতিটা করব, সেটা শুধু আমাদের হাতে। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হব না ক্ষমতার কাছে মাথা নত করব– সেটা বেছে নিতে হবে।
………………………………………………………………..
আমি যে ভাতটা খাই, কোন কৃষকের কত ফোঁটা ঘাম ঝরার পরে এই ফসল ফলল, যে বাটিতে আমি খাচ্ছি, সেটা কে বানাল– এই প্রশ্নগুলো করি আমি। বুঝতে পারি জীবনের প্রতিটি পদে একটি করে মানুষ আছে। এটাই যদি পরিবার হয়, তাহলে পরিবারের ওপর কোনও আঘাত এলে, সে খবর তো আমি পাবই। আলাদা করে সজাগ থাকতে হয় না।
……………………………………………………………………
এ বাংলায় ঘটে যাওয়া নারকীয় ধর্ষণের ঘটনায় আপনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন ‘এই মেয়ে শোন’ গানটির মাধ্যমে। আপনার গান এই বাংলায় স্লোগান হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদের রেশ ওই বাংলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই গান কবে লেখা?
আর.জি. করের ঘটনায় আমার সংহতি প্রকাশ– এটা আমার নিজস্ব ধর্মবোধ। জীবনে কতগুলো সহজ ধর্ম আমি পালন করি। তার মধ্যে এক নম্বর হচ্ছে, যে প্রকৃতি আমাকে নারী রূপে সৃষ্টি করেছে, তা যখন আমি আবিষ্কার করতে যাই, দেখি পৃথিবীর প্রতিটি নারী প্রতি মুহূর্তে অপমানিত, অসম্মানিত। নারীর এই যন্ত্রণা বাংলাদেশেও যা, ভারতেও তা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তা, জাপানেও তা। আর নারীর অসম্মানের প্রতিবাদ আমাকে করতেই হবে, জ্বলে উঠবই আমি। আর.জি. করের নির্যাতিতার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মেয়েরা যে ‘রাত দখল’ কর্মসূচি নিয়েছিল, সেটা জানতে পেরে আমার খুব অস্থির লাগছিল, ছটফট করছিলাম। বুঝতে পারলাম পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের সঙ্গে আমি একাত্মবোধ করতে চাই। ২০১৭-’১৮-র দিকে বাংলাদেশে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। একটি মেয়ে কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরছিল স্কুটার চালিয়ে। মাঝরাস্তায় তাঁকে আটকে একদল পুরুষ জিজ্ঞেস করেছিল– এত রাতে কেন সে বাড়ি ফিরছে। মেয়েটি দু’-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ইঙ্গিত ছিল, ভালো মেয়েরা কখনও রাতে বেরয় না। মেয়েদের জন্য রাতকে নিষিদ্ধ করার চক্রান্তের বিরোধিতা থেকেই এই গানটা বেঁধেছিলাম। সোজা কথায় বুঝতে পারি, রাতের দখল নিতে হবে আমাদের, মেয়েদের, প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের। গানটা ২০১৭ সালে লেখা হলেও গানটার রেকর্ডিং এখন চলছে। আসলে কী হয়, যখন কোনও ঘটনা ঘটে, তখন তার অভিঘাতে একটা গান লেখা হয়ে যায়, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে রেকর্ড করে প্রকাশ করা হয় অনেক অনেক বছর পরে, হয়তো দশ-বারো বছর লেগে যায়। এটাই আমার কাজের ঢং। প্রতিদিন তো গান প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু প্রতিবাদ তো জীবনযাত্রার অংশ, সেটা তো করে যেতেই হবে। ‘এই মেয়ে শোন’ গানটার রেকর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। হয়তো মাসখানেকের মধ্যে প্রকাশ করব।
আপনি একজন ঘোষিত নারীবাদী মানুষ। এই ধর্ষকের জল্লাদমঞ্চে একটি নারীর প্রতিবাদ কেমন হওয়া উচিত?
গত রাতেই আমি একটি প্রতিবাদ সভায় ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে-রাষ্ট্রই ধর্ষক, যে-রাষ্ট্র ধর্ষণ নিয়ে মুনাফা লোটে, সেখানে একদিনে কোনও বদল আসবে না। শুধু প্রতিবাদ, মিছিল করে হবে না। আমরা কার কাছ থেকে বিচার চাইব, যে রাষ্ট্র ধর্ষকের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তার কাছ থেকে? একটা সংস্কারমূলক যাত্রার মধ্য দিয়ে যেতে হবে আমাদের। প্রতিবার একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, আমরা শুধু সেই ঘটনার বিচার চাই। কিন্তু তাতে তো ধর্ষণ-সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে না। গোড়া থেকে ভাবতে হবে আমাদের। জীবনব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য কর্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। পুরুষ-চরিত্রের আস্ফালন তো একটা ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যেও দেখতে পাই আমরা, ছিড়ে খেয়ে ফেলার চরিত্র ছোট-বড় সবার মধ্যে লক্ষ করি, এই পৌরুষের আগ্রাসন কোথায় না আছে! তাই আমাদের ঘরে ঘরে সংস্কার করতে হবে। আমরা বৈষম্য দূর করার কথা বলি, শ্রেণিহীন সংগ্রামের চিন্তা করি, কিন্তু নারী-প্রশ্ন হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না।
আপনার গান মানুষের রোজকার যন্ত্রণার কথা বলে। যা অস্বস্তিকর। আপনি কীভাবে এই অস্বস্তি যুঝে নেন?
আমার গানে যে অস্বস্তি প্রকাশ পায়, সেগুলো তো মানুষেরই কষ্ট-যন্ত্রণা। আমি কী করেই বা এড়িয়ে যাই? অনেকেই হয়তো এই অস্বস্তিগুলো শুনতে চায় না, কিন্তু সেটাও তো স্বাভাবিক। আমি যে জীবন-ব্যবস্থার মধ্যে থাকি, আশপাশের ঘটনাগুলোকে অগ্রাহ্য করে বাঁচা সম্ভব নয়। বাঁচবই বা কেন? কারও অস্বস্তি বেশি, কারও কম, কেউ যুঝতে শিখেছে, কেউ শেখেনি, কেউ এড়িয়ে যায়, কেউ এড়াতে চায় না। কিন্তু এর ভেতরেই আমাদের বসবাস। একটা ঘটনা যখন ঘটে, সেই ঘটনাটাকে আত্মস্থ করার একটা প্রক্রিয়া চালু হয় নিজের মধ্যে। সেই প্রক্রিয়াটাই হল গান লেখা। গানের মাধ্যমে প্রতিবাদও করছি, আবার ঘটনাকে স্বীকার করছি অন্তরে। আমি যখন এই অস্বস্তির জন্য জায়গা করছি নিজের মধ্যে, তখন আমি আসলে গোটা পৃথিবীটাকে আমার ভেতরে নিচ্ছি। গানটা মূলত আমার নিজের সঙ্গে কথোপকথন। এই পৃথিবী তো সহনীয় নয়। আমরা যেমন আশা করি, তার সঙ্গে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে বাস্তবের। এই পার্থক্যটার সঙ্গে যুঝে ফেলার জন্য আমার গান লেখা, প্রতিবাদ করা। আমি কী চাই, সেটা জানাতে চাই সকলকে। হয়তো চাইলেই পাব না, কিন্তু না চাইলে তো চাওয়ার দিকে কোনও দিনও এগনো যাবে না।
…………………………………………..
ক্ষমতার কাছে যেই যায়, তারই প্রবণতা হয় আমজনতাকে ঠকানোর। তা সে যে দর্শনেরই মানুষ হোক না কেন। তাই আমার রাজনৈতিক দর্শন ক্ষমতার থেকে দূরত্ব। এটাতেই আমার আরাম। একটা দলের মধ্যে থেকেই যে রাজনীতি করতে হয়– এই ধারণাকেই আমি প্রশ্ন করতে চাই।
…………………………………………..
আপনি চিরকাল সজাগ থেকেছেন। কোনও রাষ্ট্র-অপরাধ আপনার চোখ এড়ায়নি। এই সজাগ চোখ আপনি পেলেন কী করে? কেন এমন সজাগ থাকি না প্রত্যেকে?
এই প্রশ্নটাকেই আমি আরেকটা প্রশ্নের মধ্যে ফেলব। সাধারণ মানুষ ও আমার মধ্যে যে বিভাজন করা হচ্ছে– এই বিভাজনটাই আমি মানি না। আমি যদি সাধারণ হতে না পারি, সাধারণ জীবন যদি না পাই, তাহলে সে বিচ্ছিন্ন মানুষ, মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন, জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন, মানবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। পৃথিবীটা যে আমার ও আমাদের, এর ভেতরে যে শান্তি আমি পেয়েছি, তা আর কোথায়? আমরা তো আমাদের কাছের মানুষের, পরিবারের খোঁজ রাখি, তাই না? সেভাবেই এই পরিবারটাকে যদি বড় করা যায়, তাহলেই অনেকটা বদলে ফেলা যায়। আমি যে ভাতটা খাই, কোন কৃষকের কত ফোঁটা ঘাম ঝরার পরে এই ফসল ফলল, যে বাটিতে আমি খাচ্ছি, সেটা কে বানাল– এই প্রশ্নগুলো করি আমি। বুঝতে পারি জীবনের প্রতিটি পদে একটি করে মানুষ আছে। এটাই যদি পরিবার হয়, তাহলে পরিবারের ওপর কোনও আঘাত এলে, সে খবর তো আমি পাবই। আলাদা করে সজাগ থাকতে হয় না। এমন তো নয় যে সবকিছুতে আমি প্রতিবাদ করতে পারি। কিছুই পারি না, তিতাস। এর মধ্যে কোনও বিনয় নেই। আমার পক্ষে সব অন্যায় জানতে পারা অসম্ভব, সবকিছুতে প্রতিবাদ করতে পারাও অসম্ভব। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি একটা হতাশা আছে, যে আমি জানতে পারলাম না। আরেকটা খুব স্বার্থপর কারণ আছে, সেটাও আমি বলতে চাই। মানুষ যখন নিজের ভেতরে বন্দি হয়ে থাকে, তখন তার দুঃখগুলো খুব প্রকট হয়ে যায়। আমার কী হল, আমার পরিবারে কী হল, আমার মনের মানুষের কী হল– এমন দুঃখ দিয়ে যদি হৃদয় ভরে রাখি, তাহলে পৃথিবীর দুঃখকে সহ্য করব কী করে? পৃথিবীর দুঃখকে যদি টেনে নেওয়া যায় ভেতরে, তখন অনেক সহনীয় হয়ে ওঠে জীবন। ছোট ছোট দুঃখ জীবনকে খুব বিষাদময় করে রাখে। আমি যদি হৃদয়ের দরজা খুলে দিই, পৃথিবীর সব দুঃখ সেখানে ঢুকে পড়ল, তখন ওই ব্যক্তিগত দুঃখকে এত তুচ্ছ মনে হয়, মনে হয় যেন মুক্ত হলাম। সব দুঃখই তখন ছোট হয়ে যায়, সব দুঃখ বড়ও হয়ে যায়। দুঃখের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব হয়। দুঃখকে আমন্ত্রণ জানানো সুখী হওয়ারই পথ।
এই জন্যই কি আপনি নিজেকে আমজনতাপন্থী বলেছেন? যে কোনও পতাকার তলায় নেই।
আমজনতাপন্থী মানে যে ক্ষমতার থেকে দূরে থাকে। ক্ষমতার কাছে যেই যায়, তারই প্রবণতা হয় আমজনতাকে ঠকানোর। তা সে যে দর্শনেরই মানুষ হোক না কেন। তাই আমার রাজনৈতিক দর্শন ক্ষমতার থেকে দূরত্ব। এটাতেই আমার আরাম। একটা দলের মধ্যে থেকেই যে রাজনীতি করতে হয়– এই ধারণাকেই আমি প্রশ্ন করতে চাই। আমাকে যেন কেউ বেঁধে না ফেলে। শিল্পী হিসেবে আমার রাজনীতি আছে, নারী হিসেবে আমার রাজনীতি আছে, মানুষ হিসেবে রাজনীতি আছে।
………………………………………………….
ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া, প্রতিবাদে যাওয়ায় কি মানুষ কিছুই পায় না? শেষ পর্যন্ত একটা মানুষ নিজের কারণে মিছিলে যায়। আসল কথা হল, আমার মানবতা আমাকে চর্চা করতে হবে। প্রতিটি মানুষ যে যার মাপে মঙ্গল করে। মহত্ত্বের মাধ্যমে কী হয় বলো তো– ব্যক্তিপুজো। ব্যক্তিকে তুলে আনার কোনও দরকার নেই তো, সে আলাদা নয়, সে সবারই মতো। বরং মাটির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে, তা ব্যক্তিমানুষের ক্ষতি।
………………………………………………….
একজন শিল্পীর প্রধান কাজ কী?
একজন শিল্পীকে কেমন হতে হবে, তার কোনও ব্যাকরণ আমি মানি না। শিল্প তো প্রথমে একটা প্রকাশ, তার প্রকাশের ধরন কে ঠিক করে দেবে? আমি প্রতিবাদ করছি, তাই আমি মহান, যে করছে না সে নিকৃষ্ট– এ কেমন কথা? শিল্পী মাত্রেই প্রতিবাদ করা উচিত, সেটাও তো চাপিয়ে দেওয়া। পপ শিল্পী, শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীরা হয়তো নিজেদের মতো করে জীবন বাঁচেন, কারও অমঙ্গল করেন না, তাঁকে কেন দোষ দেব? আমি তো একটা পাখিকে দোষ দিচ্ছি না আমার বাজারদর বেড়ে যাওয়ার কারণে তুমি কেন মিছিলে হাঁটলে না বলে। মন্দ লাগে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া, শিল্পী হিসেবে সুবিধা নেওয়া, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া।
আপনি বারবার বলেছেন আপনি মহান নন, আপনাকে যেন কেউ মহান না ভাবে। কেন মহত্ত্বের প্রতি আপনার এই দৃপ্ত সমালোচনা?
এটা একদম ঠিক ধরেছ। মহত্ত্বের ব্যাপারে আমার একটা অ্যালার্জি আছে। এর মূল কারণ হল, মহত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের যে অসীম ক্ষমতা, তাকে ছোট করা হয়। প্রতিটি মানুষই আসলে অপার অসীম ভালোবাসার ক্ষমতায় বলীয়ান। এক শিল্পী মানুষ বা এক খেলোয়াড় মানুষ তার ক্ষমতা অনুযায়ী একটা ভালো কাজ করল, যে কাজটা এমনিই মানুষ করতে পারে, কিন্তু সেটুকু করার জন্য আমরা যদি তাকে মহান করে তুলি, তাহলে মানুষকেই ছোট করা হয়। মানুষ যা করে, তা অতিমানবীয় নয়। মানবিকতাই তাকে মানায়। এখানে মহত্ত্বের সুযোগ কোথায়? ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে যাওয়া, প্রতিবাদে যাওয়ায় কি মানুষ কিছুই পায় না? শেষ পর্যন্ত একটা মানুষ নিজের কারণে মিছিলে যায়। আসল কথা হল, আমার মানবতা আমাকে চর্চা করতে হবে। প্রতিটি মানুষ যে যার মাপে মঙ্গল করে। মহত্ত্বের মাধ্যমে কী হয় বলো তো– ব্যক্তিপুজো। ব্যক্তিকে তুলে আনার কোনও দরকার নেই তো, সে আলাদা নয়, সে সবারই মতো। বরং মাটির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলে, তা ব্যক্তিমানুষের ক্ষতি। অন্যকেও মহান করে তোলার কিছু নেই, নিজেকে মহান ভাবার সুযোগ তো আরও নেই।
আপনি নিয়মিত সোশাল মিডিয়ায় আপনার কথা, গান, মতাদর্শ দর্শকের কাছে প্রকাশ করেন। একটা কমিউনিটি তৈরি করেছেন আপনি। আপনাকে আমরা কাছ থেকে দেখি। এটা কি আপনার সচেতন সিদ্ধান্ত?
প্রথমে একটা প্রয়োজন থেকে এটা তৈরি হয়েছিল। মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে আমি আর কাজ করতে পারছিলাম না। টেলিভিশন জগতের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হচ্ছিল। তারা যেগুলো বলত, সেই অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ঠিক করলাম আমি একা একা করব। সেসময় ইউটিউবে বা ফেসবুকে আমার তেমন বিচরণ ছিল না। কিন্তু একা কাজ যখন শুরু করলাম, তখনও ভাবিনি কোনও কমিউনিটি তৈরি করতে পারব। ভেবেছিলাম, যেটা করতে চাই, সেটা ছোট গণ্ডির মধ্যে শুরু করি আপাতত। কিন্তু সোশাল মিডিয়া বা ইউটিউবে আসার পর অনেকগুলো দিক খুঁজে পেলাম। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির পর বুঝলাম তাদের একটা অপেক্ষা রয়েছে, আর আমার একটা দায়িত্ব। শিল্পীর যে ভূমিকা, তা তো মানুষের সঙ্গে। তো আমার একটা তাগিদ রয়েছে মানুষের কাছাকাছি থাকার। আগে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার বেরলে দেখেছি আমার ভাষা তারা বদলে দিয়েছে। আমি যা বলতে চেয়েছি, যেভাবে বলতে চেয়েছি তা প্রকাশিত হয়নি। আমি যখন সরাসরি কথা বলতে শুরু করলাম, আমাকে দর্শকরা দেখতে পেল, কোন শব্দ কীভাবে ব্যবহার করছি, সেটা স্পষ্ট হল। যোগাযোগও তীব্র হল। আরেকটা ব্যাপার হল, দূরে দূরে থাকা আমার জীবন বোধই নয়। শিল্পী হয়ে দূরে থাকা আসলে ঠকে যাওয়া। রাজপথে মিছিল নামলে আমাকে সেখানে পৌঁছে যেতে হবে। জানো তো, আগামীর শিল্পীরা অনেক বেশি মানুষ-বান্ধব হবে। মাঠ থেকে দূরে থাকার সময় আর নেই। আমরা দুর্নাম করি যে ফেসবুক এসে মানুষকে মানুষের থেকে দূরে করে দিয়েছে, আমার ঠিক উল্টোটা মনে হয়। কাছাকাছি আসার সুযোগ আরও বেড়েছে। আমি নিজে প্রকাশিত থাকি, যোগাযোগে থাকি।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় আপনার গান খুব সহজ কিছু কথা বলে। যা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সহজভাবে কথা বলার শিক্ষা আপনি কোথা থেকে পেলেন? সহজ গানকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না। এই নিয়ে আপনার কি মত?
আমি যখন লিখি, তখন আমি নিজেকে বোঝাতে বোঝাতে লিখি। যা নিজেকে বোঝাই, সেটাই লিখি। তার মানে এই নয় যে, ভাষার অলংকার বা কাঠিন্যকে আমি বর্জন করছি। বাংলা ভাষা আসলে খুব সুন্দর, এত ধনী একটা ভাষার অলংকার যতটা পারা যায় ব্যবহার করা উচিত। তবে আলাদা করে কঠিন শব্দ বেছে নেওয়ারও দরকার নেই। যেভাবে কথা বললে আমি নিজে বুঝি, সেটাই আমার ভাষা। আরেকটা বিষয় হল, যাঁরা শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষ, তাঁরা কি আমাকে বুঝতে পারছেন? এগুলো কিন্তু আমি পরে ভেবেছি। আমি নিজে কঠিন ভাষা বুঝি না, বলিও না। কোনও কথা বোঝাতে হলেও আমি সেটা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলি। সে বন্ধুর মতো করে আমার কথা শুনবে, সে জানবে আমার জীবনে কী ঘটেছিল। সহজের সুবিধা আমি বুঝতে পেরেছি। আরও সৎভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে আমি এরকমই। এই জন্য আমার কিন্তু দুর্নামও আছে। অনেকেই আমাকে বলেছেন গানের মধ্যে কাব্যের অভাব। তাঁর বিচারে হয়তো সেটাই সত্যি। যদিও আমি নিজেকে স্বঘোষিত কবিই বলি। এটা আবার আমি দাবি করে বসি। (হাসি)
…………………………………….
ফিলিস্তিনি হল সেই যুদ্ধ করা জাত, যারা লড়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে না চেয়ে। আমি তাই ঘোষণা করি আমার শরীরটা একটুকরো প্যালেস্তাইন। একটা জাতকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে গায়ের জোরে, অস্ত্রের জোরে, এটা আমি মানতে পারব না। ওই ভূখণ্ডের মানুষকে বিলীন করে দিলে সারা পৃথিবীতে টুকরো টুকরো প্যালেস্তাইন গজাবে। আমি তার একজন।
…………………………………….
তাহলে আমার পরের প্রশ্নটা হবে, আপনার প্রথম পরিচয় কী? কবি, সংগীতশিল্পী, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী, লেখক, প্রতিবাদী জনতা?
এখন সামাজিকভাবে একটা মোটা দাগের পরিচয় দিই, সংগীতশিল্পী বলে। কিন্তু আসলে অন্য যে পরিচয়গুলো তুমি দিলে, তার সব ক’টাই আমি, এবং একইসঙ্গে আমি। লিখতে খুব ভালোবাসি জানো তো। আবার কবিতা লেখার পরে অনেকে বলেন এটাকে গান বানিয়ে নাও। যতখানি লেখা হয়, ততটা সুর আসে না। এই জন্য আমার একটা হতাশাও আছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতীতে কাজ করেছি, মানুষের মনের যাত্রাটা খুব স্পর্শকাতর। মনটাকে যে কতটা অবহেলিত, এই নিয়ে যে কত সচেতনতা তৈরি করতে হবে– এটা বোঝা দরকার। এই কোণায় পড়ে থাকা মনটাকে উদ্ধার করা, তাকে আদর করা– এটা আমার নিজের যাত্রা, আমার কাজের জায়গা।
আপনার ভিডিওতে আমরা প্যালেস্তাইনের পতাকা দেখতে পাই। আপনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার কথা বলে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই সাম্রাজ্যবাদী সময়কে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
প্যালেস্তাইনের পতাকা নিজের ঘরে রাখা আসলে আমার নিজেকে রিমাইন্ডার দেওয়া। আমি যেন ভুলে না যাই পৃথিবীর এককোণে ফিলিস্তিনিরা কীভাবে লড়াই করছে, আর আমি কতটা সুবিধার মধ্যে রয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের যে পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এটা যেমন স্বীকার করি, একইসঙ্গে বলব আমার দেশের পাহাড়ে যাঁদের বসবাস, তাঁদের ওপর বাঙালিয়ানা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমি। পাহাড়ে সেনাশাসন জারি রয়েছে, বহু আদিবাসী মানুষের বাস। সেই সংগ্রাম তাদের এখনও চলছে, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। আমার এই কথাটা দেশদ্রোহিতার পর্যায়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ওর চেহারা বলে দিচ্ছে ও চাকমা, কিন্তু ওকে বলতে বলা হচ্ছে ও বাঙালি। ফিলিস্তিনি হল সেই যুদ্ধ করা জাত, যারা লড়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হতে না চেয়ে। আমি তাই ঘোষণা করি আমার শরীরটা একটুকরো প্যালেস্তাইন। একটা জাতকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে গায়ের জোরে, অস্ত্রের জোরে, এটা আমি মানতে পারব না। ওই ভূখণ্ডের মানুষকে বিলীন করে দিলে সারা পৃথিবীতে টুকরো টুকরো প্যালেস্তাইন গজাবে। আমি তার একজন। আমি লিখেছিলাম ‘আমার দেশের বাড়ি প্যালেস্তাইন’। এই যন্ত্রণা এই ব্যর্থতা আমার সঙ্গে থাকবে, যতদিন আমি বেঁচে থাকব। এটা আমার প্রত্যেক দিনের বাস্তবতা। আমি কখনওই ভুলে যেতে চাই না ফিলিস্তিনিদের। একটা দেশকে মুছে দেওয়া হবে, মানুষদের মেরে ফেলা হবে, শিশুদের খাদ্য জোগান বন্ধ করে দেওয়া হবে– এই মানবিকতা নিয়ে এত অহংকার করা মানায় না। এই ব্যর্থতাই আমার গয়না।
প্রায় ২৫ বছর হয়ে গেছে কল্পনা চাকমার হদিশ আমরা পাইনি। বেশিরভাগ মানুষই তাঁকে ভুলে গেছে। কিন্তু আপনার স্মৃতিতে তা অটুট। স্মৃতি কতটা জরুরি?
স্মৃতি ভীষণ জরুরি। এমন তো নয় আমাদের উৎসব, আমাদের ভালো থাকা সব বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা বেঁচে থাকা ভুলে যাব না। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার মধ্যে যদি এই মানুষগুলো থাকে, সেটা সহজাতভাবে আমাদের জীবনযাপনের ঢঙে অন্য চলন আনবে। ছোটবেলায় আমি কল্পনা চাকমার নাম জানতাম, ঘটনা কিছু জানতাম না। ১৯৯৬-এ ওঁকে তুলে নেওয়া হয়, গুম করা হয়। এমন ঘটনা কল্পনাকে দিয়েই শুরু হয় আমাদের দেশে। বড় হওয়ার সময় কানে আসছে– ‘কল্পনা চাকমা কোথায়, কল্পনা চাকমা কোথায়’। পুরুষতন্ত্র, সনাতনী জীবনপদ্ধতি যখন মেয়েদের কথা বলতে দিচ্ছে না, সেসময়ে পাহাড়ে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলছে একটি মেয়ে। ১৯৯৬ সালে। উনি ভয় পাননি। এটা অবিশ্বাস্য। ‘এটা কল্পনা চাকমার গান’ যখন লিখছি, তখনই তাঁর কেস খারিজ হয়ে যায়। তাই শেষে পৃথিবী যাতে কল্পনাকে না ভুলে যায় তার আর্তি করেছিলাম। বিচার পাই আর না পাই তাঁকে অন্তত মনে তো রাখতে পারি। একটা অন্যায় হয়েছিল, এটা বলে অন্তত অস্বস্তি তৈরি করতে পারি। আমি ভুলেও যেতে পারি, আমি চুপ করে থাকতে পারি, আমি গানও গাইতে পারি। আমি বেছে নিয়েছি গান গাওয়াকে। আমি বেছে নিয়েছি স্মরণ করাকে। কল্পনা চাকমা আমার কাছে বিশেষ তার কারণ তিনি নারী। তিনি সংখ্যালঘু। তাঁকে খুঁজে না পাওয়ার বেদনাটাকে আমি রেখে দেব আমার কাছে। এটা শিল্পী হিসেবে আমার কাজ, মেয়ে হিসেবে আমার কাজ।
আপনার গানজীবন আর রাজনৈতিক জীবন কীভাবে একবিন্দুতে এসে মিলিত হল?
গানজীবন আর রাজনৈতিক জীবনকে কিছুতেই আলাদা করতে পারি না। আমার চেতনে রাজনীতি প্রবেশ করার সুযোগ হয়েছিল। তাই এটা আমি ছাড়ব না। আমার প্রেমও রাজনৈতিক, বা রাজনীতিই আমার প্রেম। দুটো একই সত্তা।
বাড়িতে গানের পরিবেশ কেমন ছিল?
এটা আমার খুব প্রিয় প্রশ্ন। যেটা অবশ্যই জানাতে চাই, তা হল আমার বাবা গান গাইতেন প্রফেশনালি। আমার চাচা, চাচাতো ভাই সবাই গানবাজনার সঙ্গে জড়িত। আধুনিক বাংলা গান। অন্যদিকে আমার মা গান শিখতেন। আমি বড় হয়েছি আমার মায়ের কাছে। পাঁচ বছর বয়স থেকে একক মায়ের জীবন আমাদের একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা দিয়েছে। সেটাই কিন্তু আমার গান লেখার অনুপ্রেরণা। আমার বাড়িতে যে গানের চর্চা ছিল, সেখানে লিরিকের কোনও ব্যাপার ছিল না। মা বসে বসে গান শিখতেন, একক মায়ের সংগ্রাম দেখতাম, সেই জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতাই আমার গানের গুরু। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তাই বারেবারে আমার বাবার পরিচয়ে আমাকে দেখা হয়, মায়ের পরিচয় সামনে আসে না। সেজন্য আমাকে বেশি বেশি করে আমার মায়ের কথা বলতে হয়। আমাকে জোর গলায় বলতে হয়, আমি মায়ের মেয়ে।
আপনার সুর খুব বাঙালি সুর। কিন্তু আবার লোকসুরও নয়। এই সুর আপনি পেলেন কোথা থেকে?
এটা একেবারে আমার জীবনের সুর। আমার নাগরিক জীবনের সুরই আমার গান ছুঁয়ে যায়। এ সুর পাশ্চাত্যের নয়, আবার মেঠো পথ, সবুজ ধানখেতেরও নয়। কিন্তু বাংলাবিচ্ছিন্নও নয়। আরেকটা ব্যাপার, আমি আধুনিক বাংলা গান শুনে বড় হয়েছি। হেমন্ত, প্রতিমা, কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর– এঁদের সুরই আমার ছোটবেলাকে প্রভাবিত করেছে। তারপর ধীরে ধীরে বাংলা লিরিক্যাল গান এসেছে। ফলে আমার নিজস্ব সুরে অনেকের প্রভাব এসে পড়েছে। আমি সবাইকে গ্রহণ করেছি, কাউকে বাদ দিইনি।
শেষ প্রশ্ন, আপনাকে কেউ কখনও বব ডিলানের সঙ্গে তুলনা করেছে?
(হাসি) বব ডিলানের সঙ্গে তুলনা আমি শুনেছি। শুনে কখনও খারাপ লাগেনি, ভালোই লেগেছে। (হাসি)
এ দেশে যত মানুষ ইউএপিএ-র আওতায় গ্রেপ্তার হয়েছে, তার মাত্র ২.৮% সাজা পেয়েছে। বাকিরা বহুবছর জেলে কাটিয়ে ছাড়া পেয়েছেন বা দেশের কোনও এক প্রান্তে, জেলের ভেতর বসে মুক্তির দিন গুনছেন।
নির্বাক ছবির অস্তাচল ও সবাক ছবির উদয়াচল ধরা পড়েছিল যে সিনেপত্রিকায়
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’