আজ বোধহয় খেলা মাটি, যা মেঘ! বলামাত্রই মেঘ ঘন হয় খুব। ততক্ষণে রাজভবন-সংলগ্ন ফুটপাথ রাধাচূড়ায় ঢেকেছে আগাগোড়া। চামের গুমটির অবাধ্য ছাউনি ধরে থাকে বছর বারোর এক কিশোর। ভেজা ভেজা হাওয়ার পথ ধরেই হাঁটছিলাম। চোখ পড়ল যে ছেলেটির ওপর, তার গায়ে রিয়েল মাদ্রিদের জার্সি। অস্পষ্ট গোঁফের রেখা। বসে আছে প্রকাণ্ড বটগাছের তলায়। সামনে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জার্সি। খান বিশেক। ডানদিকে হলুদ। চেন্নাই সুপার কিংস। বাঁদিকে লাল। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। অল্প কিছু মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। মাথার ওপর দোল খাচ্ছে ‘বিরাট কোহলি– ১৮’। হঠাৎ, বিদ্যুৎ চমকায়। জার্সি-বিক্রেতা বিদ্যুৎ পাল-এর একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোদ্দুর মিত্র ও শঙ্খ বিশ্বাস।
আজ ইডেনে কলকাতার শেষ ম্যাচ! এরপরে তো প্লে-অফ। জার্সি কেমন বিক্রি হল এই মরশুমে?
মোটামুটি ভালোই বিক্রি হয়েছে। হচ্ছে এখনও। আশপাশে অনেকেই তো বসেছে। তবুও, বিক্রি ভালোই।
কতক্ষণ হল এখানে এলে?
বাড়ি থেকে বেরিয়েছি সাড়ে দশটা। ট্রেনে এসেছি। এখানে এসে পৌঁছেছি ওই বারোটা নাগাদ।
কোথায় থাকো?
নিউ ব্যারাকপুর।
মূলত জার্সির ব্যবসাই তোমার?
এ তো হাতখরচের জন্য। আমাদের নিউ ব্যারাকপুর থেকে অনেক চেনাশোনাই আসে। ওদের দেখে আমিও চলে এসেছি। তিন বছর হয়ে গেল।
তাহলে? অন্য কোনও ব্যবসা?
আসলে আমরা ঠাকুরের ব্যবসা করি!
মানে মূর্তি তৈরি করো?
হ্যাঁ। তাছাড়া, বাবা ওদিকে প্লাম্বিং-এর কাজ করে। আর যেদিন কলকাতার খেলা থাকে, আমিও চলে আসি এখানে।
তোমার নামটাই জানা হয়নি এতক্ষণ!
আমার নাম বিদ্যুৎ পাল।
তুমি কি পড়াশোনা করো?
হ্যাঁ। ক্লাস টুয়েলভে পড়ি। আর্টস নিয়ে। লেনিনগড় শিক্ষা নিকেতন হাই স্কুলে।
আচ্ছা বিদ্যুৎ, কখনও ইডেন গার্ডেন্সের গ্যালারিতে বসে খেলা দেখেছ?
বাংলার খেলা দেখেছি। রঞ্জি ট্রফি। ইচ্ছে করলেও আইপিএল দেখা হয়নি।
প্রিয় খেলোয়াড় কে তোমার?
হার্দিক পান্ডিয়া।
আজ কি তবে মুম্বইকে সাপোর্ট করছ?
তা কী করে হয়! আমি তো কেকেআর-এর ফ্যান।
গলি-ক্রিকেট খেলো নিশ্চয়ই?
সে তো হবেই। টুর্নামেন্ট খেলি রীতিমতো। আমি আসলে বোলার। কিন্তু ব্যাট করতেও ভালোবাসি।
হার্দিক পান্ডিয়ার মতো?
(উত্তর নেই কোনও) কেবল লাজুক হাসি।
ধরো কোনওদিন হার্দিক পান্ডিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কী করবে?
অত বড় প্লেয়ার! আমার সঙ্গে থোড়াই দেখা হবে।
জার্সির কেমন স্টক আনো বিদ্যুৎ?
বেশ ভালোই। কলকাতার জার্সিই বেশি থাকে দাদা। ইডেন বলে কথা! কিন্তু চেন্নাইয়ের জার্সিও কম বিক্রি হল না এ-বছর। ইডেনে খেলা পড়েনি, তবুও কত মানুষ ধোনির জার্সি কিনে নিয়ে গেল।
দুপুরে কী খাওয়া-দাওয়া হবে?
খেয়ে এসেছি বাড়ি থেকে। দুপুরের খাওয়াটা হবে না। রাত আটটা অবধি জার্সি বিক্রি হবে টানা।
তারপর বাড়ি? ফিরে খেলা দেখবে?
না, না। ফেরার পথে খেলা চালিয়ে নেব মোবাইলে।
এই গাছতলাতেই প্রতিদিন এসে বসো?
যেদিন যেখানে জায়গা পাই, সেখানে বসে পড়ি। কোনও প্রবলেম হয় না।
বড় হয়ে কী হতে চাও?
পারিবারিক ব্যবসাই সামলাব। তবে হ্যাঁ, আইপিএলের সিজনে ইডেনের সামনে জার্সি নিয়ে বসে পড়ব। প্রতি বছর।
এ কি ক্রিকেটের জন্য ভালোবাসা?
মৃদু মাথা নেড়েছিল বিদ্যুৎ। আর সেই লাজুক হাসি। বৃষ্টি থেমে রোদ উঠেছিল ফের।
আমরা চাইছি, ফরসা আকাশেও এ বিদ্যুৎ চমকে উঠুক। প্রতিদিন। হার্দিক পাণ্ডিয়ার মতো গ্যালারি পেরনো ছয় মারুক। অন্তত একবার।
সহায়তা: সম্বিত বসু, সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়, শুভদীপ রায়
চিত্রগ্রাহক: অমিত মৌলিক