সদর স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট এই পাড়াগুলোর ইতিহাস বৈচিত্রময়। একটা সময়ে এই জায়গাটা ছিল একাধারে বইপাড়া এবং রেকর্ড-পাড়া। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও বিদেশিদের আনাগোনা প্রভাবিত করেছে এই চত্বরের সংস্কৃতিকে। কলকাতায় হাতে গোনা যে কয়েকটি ভিনাইল রেকর্ডের দোকান এখনও টিকে রয়েছে, তার মধ্যে একটি এই চত্বরেই। ‘ভাইব্রেশন্স’। দুষ্প্রাপ্য সব বিদেশি রেকর্ড সংগ্রহে রাখার জন্য সুনাম ছিল এই দোকানটির। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গান শোনার মাধ্যম বদলেছে। এলপি রেকর্ড বদলে গিয়ে এসেছে ক্যাসেট, সিডি কিংবা হালের ইউটিউব, স্পটিফাই। তবু চার দশকের বেশি সময় ধরে ফুটপাথের এই ছোট্ট দোকানটিকে আগলে রেখেছেন মহম্মদ ইমতিয়াজ ওয়ারসি। মাইকেল জ্যাকসনের ফ্যান। তাঁর ‘গ্র্যামি’ পাওয়ার আনন্দে দোকান করেছিলেন। অলাভজনক হলেও সেই ব্যবসা ছাড়তে পারেননি এখনও। স্বপ্ন দেখেন কোনও একদিন বিরাট একখানা দোকান হবে তাঁর। সেখানে সাজানো থাকবে তাঁর সংগ্রহের আট হাজার রেকর্ড। কারণ রেকর্ডে ‘লাইফ’ আছে। ‘লাইফ’।
‘ভাইব্রেশন্স’। এই নামটা কার দেওয়া?
আমারই দেওয়া (হাসি)। একেবারে শুরুতে, আমি আর দাদা ভাবছিলাম যে, কী নাম রাখা যায়! এমন একটা নাম, যেটা শুনতেও ভালো লাগবে, আবার ‘মিউজিক’ বিষয়টার সঙ্গে মানানসই হয়। তো মনে হয়েছিল, ‘ভাইব্রেশন’ না হলে তো আওয়াজ হয় না, সুর হয় না, তাল হয় না, মিউজিকও হয় না। তাই এই নামটা দেওয়া। তখন আমাদের ইয়ারদোস্ত যারা ছিল, তাদেরও খুব পছন্দ হয়েছিল নামটা।
কিন্তু হঠাৎ ইংরেজি নাম দিতেই ইচ্ছে হল কেন?
তার একটা কারণ হল, এই যে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট এখানে তো প্রচুর ফরেনার আসতেন। এবং আমাদের আসল ক্রেতাও ছিলেন তাঁরাই। আব্বা, বনি এম, মাইকেল জ্যাকসন। রক মিউজিক, জ্যাজ। ওয়েস্টার্ন মিউজিক এখানে বেশি চলত। তাই তাঁদের বোঝার যাতে সুবিধে হয়, সেই জন্য ইংরেজি নাম রেখেছিলাম। ‘ভাইব্রেশন্স’ কিন্তু ওয়েস্টার্ন গানের জন্যই বিখ্যাত ছিল একসময়। কলকাতায়, যে গান কোথাও পাওয়া যেত না, সেই গান লোকে এখানে পেয়ে যেত।
এই দোকানটা কি আপনিই শুরু করেছিলেন?
এই জায়গাটা ১৯৪০ সাল থেকে আমাদের। আমার বাবার দোকান ছিল। পরে আমার দাদাও কিছুদিন এই দোকানের দায়িত্ব সামলেছেন। রেকর্ডের ব্যবসা প্রথম আমিই শুরু করেছিলাম। দোকানটা তিন জেনারেশনের। কিন্তু রেকর্ড আমার থেকে শুরু।
এখানে তখন অনেকগুলো রেকর্ডের দোকান ছিল। অল্প বয়স থেকেই মাইকেল জ্যাকসন আমার হিরো। ’৮২ সালে মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’ নামে একখানা অ্যালবাম এসেছিল। খুব হিট অ্যালবাম। তারপরে মাইকেল জ্যাকসন ‘গ্র্যামি’ পেল। ব্যাস! আমি দোকান খুলে বসলাম। ১৯৮৪ থেকে শুরু করেছিলাম। ১৯৯০ অবধি শুধু রেকর্ড বেচেছি। তারপরে সিডি-ক্যাসেট এগুলোও বিক্রি করেছি। এখন আমার ছেলেরাই বেশিরভাগটা দেখাশোনা করে।
মাইকেল জ্যাকসন গ্র্যামি পেল বলে রেকর্ডের দোকান খুলে ফেললেন?
(হাসি) আমার আসলে এই গানটান খুব ভালো লাগত। ‘হবি’ ছিল। আমার স্কুল লাইফ, মানে যখন ইলেভেনে পড়ছি, তখন থেকেই আমার মুভি আর মিউজিকের নেশা। একটা সময়ে প্রচুর ছবি দেখতাম। ছবির গান, রবীন্দ্রসংগীত আর মহম্মদ রফি খুব ভালো লাগত। সেই গানের শখ থেকেই এই পাড়ায় আসা। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট তো মিউজিকের দোকান আর বই-কিতাবেরই জায়গা ছিল। কিতাব নিয়ে আমার আগ্রহ নেই, প্রথম প্রথম রেকর্ড দেখতে আসতাম এখানে। বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে, কতরকম গানের কত রেকর্ড। কিছু কিছু কিনতামও। এইভাবে কালেকশন করা শুরু। তারপর সেই নেশার জায়গাটা থেকেই দোকান খুলে ফেলা। ধীরে ধীরে অনেক কালেকশন করেছি। নতুন রেকর্ড কিনেছি যেমন, সেকেন্ড হ্যান্ড রেকর্ডও সংগ্রহ করতাম। এখন এই নেশাটা আমার ছেলেরা পেয়েছে। এখান থেকে ওখান থেকে কিনে আনে। বাইরে থেকেও আনানো হয়।
আপনার নিজের কাছে রেকর্ড প্লেয়ার ছিল তখন?
রেকর্ড প্লেয়ার তখনও ছিল না। রেডিও থেকেই শুনতাম। আমার বেশিরভাগ গান রেডিওতেই শোনা। ব্রিজ ভারতী, পট্টনায়েক এইসব ভক্তিগীতি। তারপর প্লেয়ার এল। সেখানে শুনেছি।
তারপর একটা সময়ে আমার বেশি শখ ছিল ইংরেজি গানের। পিঙ্ক ফ্লয়েড, জেথ্রু টল, বিটলস– এসবের কালেকশন ছিল আমার। বেশি শুনতাম বিটলস আর এরিক ক্ল্যাপটন। ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকালের মধ্যে বিঠোফেন আর মোৎজার্ট খুব ভালো লাগত। প্রথম যখন দোকান খুলেছিলাম, সবই সেকেন্ড হ্যান্ড রেকর্ড। সেভেনটি এইট আরপিএম। আমার কালেকশনের রেকর্ড। শ’খানেক ছিল বড়জোর।
তার মানে রেকর্ড সংগ্রহ ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে আপনার নেশা, তার পর পেশা?
হ্যাঁ, শখ। এখনও তো শুনি। ভিনাইল প্লেয়ারেই শুনি। আমার দোকানেই আছে গ্রামাফোন প্লেয়ার। আপনাকে দেখাব। সেভেনটি এইট আরপিএম আছে। সেভেনটি আরপিএম আছে। যাকে ‘কলের গান’ বলত। আগে, আমার সময়ে তো এই দোকানটার তেমন নাম ছিল না। আমার ছেলেদের সময়ে হয়েছে। কলকাতার বাইরেও পরিচিতি তৈরি হয়েছে। আমি এখন আর তেমন বসি না। মাঝে মাঝে আসি। বসি। কেউ এলে রেকর্ড দেখাই, ব্যাস।
শুরুতে কি এভাবে রেকর্ড নিয়ে ফুটপাথেই বসতেন?
না। ‘ভাইব্রেশন্স’। এটাই আসল দোকান। ওখানেই আগে রেকর্ড নিয়ে বসতাম। বর্তমানে ওটা কাপড়জামার দোকান। ছেলেরা টি-শার্ট, পার্স, টুপি– এইসব বিক্রি করে। রেকর্ড পাওয়া যায় এইখানে।
একটা সময়ে তো মিউজিকের বিজনেসে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গেল। তখন অন্য কিছু করা ছাড়া উপায় ছিল না। পেট চলত না। তাই আমার ছেলেরা কাপড়জামার দোকান করল। কিন্তু আমি আমার ছেলেদের বলে দিয়েছি, রেকর্ড ‘ভাইব্রেশন্স’-এর ঐতিহ্য। রেকর্ডকে পাশে রেখে যা খুশি করো। কাপড়জামার ক্ষেত্রেও মিউজিকের সঙ্গে আমাদের একটা যোগ রয়ে গেছে। এখানে যা-যা পাওয়া যায়, দেখবেন, বিটলস-এর টি-শার্ট, মহীন, জন লেনন, বাংলা ফোক এইসব। সবেতেই মিউজিক জুড়ে আছে।
আটের দশক, মানে যখন আপনি শুরু করছেন, তখন তো রেকর্ডের যুগ প্রায় শেষের দিকে?
হ্যাঁ, তখন থেকেই ক্যাসেটের যুগ শুরু হচ্ছে বলা যায়। পরের দিকে ক্যাসেটও রাখতাম। টি-সিরিজ প্রথম করল। তারপর এইচএমভি, ভেনাস, টেপস একে একে এল। চাঁদনি থেকে সাপ্লাই আসত। ক্যাসেটও কালেক্ট করতাম একসময়। অনেক পুরনো পুরনো গান আমার সংগ্রহে ছিল। তারপর এল সিডি। গানের সিডি, মুভির সিডি। সিডিও রেখেছি তখন। কিন্তু সিডি-র সেই কোয়ালিটি নেই। ‘এলপি-রেকর্ড’ অন্য জিনিস। ১০০ বছর আগের রেকর্ড আপনি এখনও মুছে নিয়ে চালাতে পারবেন। সেই জন্য রেকর্ডের সংগ্রহ আমি কখনও হাতছাড়া করিনি।
একটা সময়ে যে আপনার দোকানে এত রেয়ার কালেকশন পাওয়া যেত– সেইসব জোগাড় করতেন কোথা থেকে?
এক তো আমার নিজের কালেকশনের ঝোঁক ছিল। কোথায় কোথায় কী পাওয়া যাবে জানতাম। তারপর কী হত, অনেকেই তখন বাড়ির পুরাতন রেকর্ড বেচে দিতেন। একেবারে কেজি দরে। এখন আমার ফুটের দোকান, সহজেই চোখে পড়ত। অনেকেই এসে জিজ্ঞাসা করে যেতেন, পরে বাড়ির রেকর্ড বেচতে আসতেন। এভাবেও অনেক রেকর্ড এসেছে। না বুঝেই অনেকে রেয়ার সব রেকর্ড আমায় বিক্রি করে দিয়েছেন।
আগে চাঁদনি মার্কেট, ধর্মতলা ইত্যাদি জায়গায় রেকর্ডের পাইকারি বিক্রেতারা ছিলেন। তাঁদের থেকেই প্রাথমিকভাবে নতুন রেকর্ড আসত। চাঁদনিতে পুরাতন রেকর্ডেরও মার্কেট ছিল। সেখান থেকেও কেনা যেত। তখন এইচএমভি রেকর্ড করত। মিউজিক ইন্ডিয়া, সিবিএস এদেরও রেকর্ড ছিল। এই তিনটেই বেশি নামকরা। কোম্পানি থেকেও ডাইরেক্ট রেকর্ড কেনা যেত। এলপি-র দামটা বেশি ছিল। সেভেনটি এইট আর থারটি থ্রি। ৫০-৬০ টাকা করে পড়ত। আর ইপি ৮-১০ টাকাতেও পাওয়া যেত।
লেট নাইনটিজে রেকর্ডের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায়। তখন তো কোনও রেকর্ড ম্যানুফ্যাকচার করা হত না। তখন শুধুই অডিও ক্যাসেট পাওয়া যেত। নতুন রেকর্ড আসা একদমই বন্ধ হয় গেছিল। কিন্তু আমরা রেকর্ড ডিসপ্লে করতাম। সেল কম হলেও করতাম। ক্যাসেট এসে আসলে একটা বদল ঘটিয়ে দিয়েছিল। এলপি রাখার তো অনেক ঝামেলা। ক্যাসেট ছোট। নষ্ট হয় না চট করে। পড়ে গেলে ভেঙে যায় না অত সহজে। তাই তখন সবাই রেকর্ড বেচতেই চাইত। আমার কেন জানি না, একটা ভালোবাসা ছিল তো, সেইসব নিয়ে ঘরে জড়ো করতাম। কেউ বেচতে এলে কখনও ফেরাইনি। সব কিনে নিয়েছি।
কিন্তু ওয়েস্টার্ন মিউজিক– যে জন্য আপনার দোকানের খ্যাতি– সেসব রেকর্ডও কি পাইকারি বাজারে মিলত?
না, বাইরে থেকেও আনানো হত। রেয়ার যেগুলো। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড। অরিজিনাল টেপ পাওয়া যেত মেইনলি হংকং, সিঙ্গাপুর থেকে। সেখান থেকে কপি আসত। অরিজিনাল সবসময় পাওয়া যেত না। পরে ম্যাগনাসাউন্ড, এইচএমভি, পলিডোর কিংবা ইএমআই– এইসব কোম্পানি আলাদা করে রিলিজ করত। কিন্তু সেভেনটিজ-এইটিজ-এ একটা মাস্টার কপি আসত, তা থেকে রেকর্ডিং করেই বিক্রি হত।
রেকর্ডের পাশাপাশি রেকর্ড প্লেয়ার কবে থেকে বিক্রি করতে শুরু করলেন?
আরেকটু পরের দিকে। গ্রামাফোন, ভিনাইল প্লেয়ার সবই রাখতাম। তবে সেগুলো বিক্রি হত অ্যান্টিক হিসেবে। এখনও আছে আমার দোকানে, ফিলিপস কোম্পানির। এখন যে গ্রামাফোনগুলো রাখি– এগুলো চলবে, কিন্তু এগুলো ঠিক গান শোনার জন্য নয়। লোক ঘর সাজানোর জন্যেই কেনে। এখানে তো প্রচুর বাংলাদেশের লোক আসেন, থাকেন। এখন ভিসা দিচ্ছে না বলে হয়তো সংখ্যাটা খুব কম। নইলে আগে আমার মাসে ১০-১২টা গ্রামাফোন বাংলাদেশেই যেত।
ওয়েস্টার্ন মিউজিক বাদ দিলে, ভারতীয় সংগীতের কোন কোন ঘরানার রেকর্ড বেশি জনপ্রিয় ছিল সেই সময়ে?
‘রাহুল অ্যান্ড আই’, মানে আর ডি বর্মন খুব বিক্রি হয়েছিল একটা সময়ে। তাছাড়া মহম্মদ রফি, লতাও খুব হিট ছিল। ক্ল্যাসিকালও বিক্রি হত। রবিশঙ্কর, আনন্দশঙ্কর। বাংলার মধ্যে বেশি বিক্রি হত রবীন্দ্রসংগীত। আর আধুনিক। ফিল্মের অরিজিনাল মুভি সাউন্ডট্র্যাক একসময় খুব জনপ্রিয় ছিল। রেকর্ডের যুগ যখন শেষের দিকে, তখন অমুক শিল্পীর ‘হিটস’, তমুক শিল্পীর ‘বেস্ট কালেকশন’ এইরকম সব রেকর্ড বেরত। মানে পুরনো মদ নতুন বোতলে। সেগুলোরও খুব বিক্রি ছিল। সেসব এখনও সংগ্রহ করে রাখা আছে আমার দোকানে।
একটা সময়ে আপনার দোকানে দুর্লভ সমস্ত লঙ-প্লে রেকর্ডের পাশাপাশি বাজারচলতি ক্যাসেট, সিডিও পাওয়া যেত। ব্যবসার জায়গাটা যদি ধরি, তবে কোনটা বেশি লাভজনক ছিল?
নাইনটির শুরুর দিক অবধি রেকর্ডই বেশি বিক্রি হত। তারপর একটু একটু করে বিক্রি কমতে শুরু করল। তখন ক্যাসেটের চাহিদা বেশি থাকত। কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগনিক– এঁরা সব ক্যাসেটের শুরুর যুগের বেস্টসেলার। এঁদের ক্যাসেট পড়ে থাকত না।
কিন্তু চাহিদা কমার পরেও তো লঙ-প্লে রেকর্ডই আপনার দোকানের প্রধান পণ্য? সেটা কেন?
সেটার খানিকটা তো একটা ভালোবাসা থেকে, শখ থেকে। তাছাড়া যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা জানেন ‘এলপি’ কী জিনিস! কিছু লোক তখনও ছিলেন– যাঁরা ক্যাসেট নয়, রেকর্ডই কিনতেন। কারণ এটা একটা আবেগ। একটা ঐতিহ্য। সেটা আপনি ক্যাসেটে পাবেন না।
এখনও আছেন তেমন মানুষ– রেকর্ডে গান শোনেন, রেকর্ড সংগ্রহ করেন। আবার রেকর্ড বিক্রি করতে চান এমনও আছেন। না হলে আর বাজারটা থাকবে কী করে! আমার পরিচিত লোকই আছেন, হপ্তায় হপ্তায় এসে খোঁজ নেন ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল নতুন কিছু এল কি না। এঁদের জন্যই তো ‘ভাইব্রেশন্স’!
তবে একটা বিষয় জানেন তো– লোকে বলে, ক্যাসেট-সিডির জমানা চলে গেছে, এখন তো সব ইউটিউব। কিন্তু এখন আবার নতুন করে রেকর্ড প্রোডাকশান শুরু হয়েছে। আমার ছেলেদের মুখে শুনলাম যে বাজারে নতুন কোম্পানি এসেছে। এলপি বানাচ্ছে। সুতরাং রেকর্ডের যুগ কিন্তু আবার আসছে।
রেকর্ডের ‘ভ্যালু’ এখনও আছে। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা কতটা গান শোনার জন্য? এখন তো যাঁরা রেকর্ড সংগ্রহ করেন তাঁরা মূলত দুষ্প্রাপ্য বস্তুর সংগ্রাহক। অ্যান্টিক হিসেবেই এখন রেকর্ডের মূল্য।
শখটাই আসল, বুঝলেন তো। যদি শখটা না থাকত আমার এই দোকান কি এতদিন থাকত? ভালোবাসা না থাকলে কোনও মূল্যই থাকে না।
কিন্তু এই পরিবর্তনটায় আপনাদের লাভ হয়েছে না ক্ষতি হয়েছে?
লাভই হয়েছে বলব। ক্ষতি কিছু হয়নি। সংখ্যা হিসেবে হয়তো বিক্রি কমেছে, কিন্তু দাম হিসেবে বেড়েছে। তবে একটা কথা বলব, চাহিদা কিন্তু এখনও ভালো কন্ডিশনের রেকর্ডেরই। খারাপ রেকর্ড, স্ক্র্যাচ বা ড্যাম্প রেকর্ড কেউ কিন্তু কিনে নিয়ে যেতে চায় না। তাই, আমার মনে হয়, এখনও যাঁরা কেনেন, অ্যান্টিক হিসেবেই কিনুন, বা অন্য কিছু– গান শোনার জন্যেই মূলত কেনেন। রেকর্ডে যে একবার গান শুনেছে, ক্যাসেট বা সিডি-তে গান শুনে কিন্তু তার মন ভরবে না। ডিজিটাল সাউন্ড তার ভালোই লাগবে না।
এখন কারা আপনার নিয়মিত ক্রেতা?
নিয়মিত নয়। তবে অনেকেরই মুখ চিনি। মাঝেমাঝেই আসেন। তাছাড়া আমার ক্রেতাদের অনেকেই বাইরে থাকেন। হয়তো পুজোর আগে একবার আসেন। ছেলেদের ফোন করে খোঁজ নেন, রেকর্ডের ব্যাপারে। কেউ কেউ আসেন না। ফোনেই টাকা পাঠিয়ে দেন। রেকর্ড ভালো করে প্যাকিং করে পোস্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন দোকানে কম বিক্রি হয়, অনলাইনেই বেশি বিক্রি। ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ, বোম্বে। একসময় অনেক বিখ্যাত লোক কিনতে আসত। এখনও আসে। তাঁরা খোঁজ রাখেন, জানেন বাজারে কোথায় কী পাওয়া যায়। আমি বলতে চাইছি, বিক্রিটা এখনও আছে।
এখন কিন্তু অনেকেই পুরাতন রেকর্ডগুলোকে ডিজিটাইজ করছেন। মানে পুরাতন এলপি চালিয়ে, রেকর্ড করে, বিশেষ সফটওয়ারের সাহায্যে ‘নয়েজ’ মেরামত করে সেগুলো স্টোর করে রাখছেন। কিংবা ইউটিউবে তুলে রাখছেন। এই এত রেকর্ড তো একদিন না একদিন নষ্ট হয়ে যাবে। তখনকার কথা ভেবে আপনাদের এরকম কোনও পরিকল্পনা নেই?
রেকর্ড থেকে সিডি-তে কনভার্ট করার কাজ অনেক আগেই হত। কোনও কোনও দোকান করত। আপনি যেটা বললেন সেটা অনেকেই করেন। ব্যবসায়িকভাবেও করেন। আমার ছেলে জানে। এ ব্যাপারটা ভাবিনি তা নয়। চার-পাঁচ বছর আগে কিছু কিছু রেকর্ড কনভার্ট করা হয়েওছিল। তবে আমি তো এখন বুড়ো হয়েছি, এই বিষয়গুলো তত ভালো বুঝি না। তাই ছেলেরাই এ ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।
আমি এখন সময় পেলে বাড়িতে বসে গান শুনি। এইসব ভাবার চেয়ে গান শুনতেই বেশি ভালো লাগে (হাসি)।
কী ধরনের গান শোনেন?
‘বাহারোঁ ফুল বরসাও’ আমার খুব প্রিয় গান। একটা সময়ে শুনতাম মহম্মদ রফি, আর ডি বর্মন, হেমন্ত কুমার, লতা আর কিশোর কুমার। এখনও সেগুলোই শুনি। আমার এখনও আগেকার মিউজিকই ভালো লাগে। এখনকার গান শুনি না।
সিডি-ক্যাসেটের দোকানে, একটা সময়ে, সারাক্ষণ গান চলত– এতে একটা বিজ্ঞাপনও হত। পুজোয়, বা নতুন বছরে নতুন অ্যালবাম বেরোলে আগে সেগুলোই চালানো হত।
আগে আমার দোকানেও হত। সবসময়েই গান চলত। হয়তো কেউ এসে একটা রেকর্ড দেখে বলল, এঁর গান আগে শুনিনি, একটু শুনব। তখন আলাদা করে তাকে রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছি। আবার আশপাশের অনেকে দোকানে আসত শুধু গান শুনবে বলেই।
কিন্তু এখন এই ফুটের দোকানে সেই সমস্ত ব্যবস্থা রাখা মুশকিল। আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন। চার হাত জায়গা। ইলেক্ট্রিসিটি নেই। কোথায় গান চালাব, কীভাবে চালাব? এখন কেউ রেকর্ড শুনতে চাইলে তাকে গোডাউনে নিয়ে যাই। সেখানে চালিয়ে শোনাই। কিছুদিন আগে একজন মুঘল-এ-আজম-এর একটা রেয়ার কালেকশন কিনতে এসেছিলেন। চালিয়ে শোনাতে বললেন। শুনিয়ে দিলাম। আসলে এখন সবাই সব জেনেই কিনতে আসে। কোনটা ‘ক্যানসেল নাম্বার’, কোনটা রেয়ার এলপি। চালাতে বলে কেবল রেকর্ডটা ভালো আছে কি না দেখার জন্য।
এখন তো আপনার অধিকাংশ সোর্সই সেকেন্ড হ্যান্ড? কীভাবে বুঝতে পারেন রেকর্ড কতটা ভালো আছে?
এখনও আমি প্রাথমিক কথাবার্তার পর তাদের বাড়িতে যাই। রেকর্ড কীভাবে রাখা আছে দেখি। এখানে এনে চালিয়ে শুনি। তারপর কিনি, দোকানে রাখি। ড্যামেজ রেকর্ডও থাকে। সেই অনুযায়ী স্টিকার মারা আছে দেখুন– কোনওটা ‘এইটি পার্সেন্ট’, কোনওটা ‘এইটি ফাইভ পার্সেন্ট’।
বাইরে থেকেও তো রেকর্ড আসে। তখন হয়তো যেতে পারি না। ওঁরা পার্সেল করে দিলেন। আমি এখানে চালিয়ে দেখে নিলাম। ভালো না হলে ফেরত পাঠালাম। তবে চেনা-পরিচিতির একটা ব্যাপার আছে তো। এতদিনের ব্যবসা। তাই কেউ ঠকায় না। বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর থেকে কত রেকর্ড আসে। আমার ছেলেরাই এইসব দেখাশোনা করে।
আপনার এই এতটুকু দোকানেও যে সুন্দর করে গুছিয়ে, জ্যঁর অনুযায়ী রেকর্ডগুলো সাজিয়ে রেখেছেন এটা আমার খুবই ভালো লাগল।
হ্যাঁ। ক্রেতাদের জন্যেই করে রাখা। খুঁজতে সুবিধে হয়। ওপরের তাকে বাংলা পাবেন। রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক, সিনেমার গান। পরের তাকে হিন্দি। সিনেমার গান আছে, অ্যালবাম আছে। এক পাশে ক্ল্যাসিকাল– গান এবং বাজনা। এদিকে নীচে ইংরেজি– সোলো অ্যালবাম, ব্যান্ড। আর এখানে ডিভোশনাল সং।
আসলে অনেকরকম রুচির ক্রেতা আসেন তো। সবরকমই সাজিয়ে রাখি। যার যেটা পছন্দ। তবে এখনও, রেয়ার রেকর্ড বাদ দিলে, রবীন্দ্রসংগীত আর আধুনিক বাংলা গানের বিক্রি সবচেয়ে বেশি হয়।
আরেকটা বিষয়ও লক্ষণীয়– এই যে আপনি প্রত্যেকটা পুরনো রেকর্ডকে কভার-সহ যত্ন করে ড্রাই প্লাস্টিক কভারে মুড়ে রেখেছেন, যাতে ধুলো না পড়ে…
হ্যাঁ, এটা আমার করতে ভালো লাগে। এই ডিসপ্লে-র রেকর্ডগুলোকে তোলার সময় রোজ ভালো করে মুছে তুলি। নিয়ম করে প্লাস্টিক বদলাই। যিনি কিনছেন, ভালোবেসেই তো কিনছেন। তাঁর জন্য এটা করতেই হয়। তাছাড়া এখন তো রেকর্ডের দাম হয় কন্ডিশনের ওপরেই। তাই এই যত্নটা করা উচিত বলেই আমার মনে হয়। অ্যান্টিক রেকর্ডের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশি করে করা হয়। এমন অনেক রেকর্ড ছিল যেগুলো লিমিটেড কপি প্রিন্ট হত। দুষ্প্রাপ্য এডিশন। সেগুলো না যত্ন করলে তো ক্ষতি। রেয়ার জিনিস নষ্ট করতে গায়ে লাগে।
এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে, কলকাতার এক দুর্গাপুজোয় এলপি রেকর্ড ব্যবহার করে প্যান্ডেল তৈরি হয়েছিল। আপনি কি জানেন? সেই নিয়ে প্রচুর লেখালিখিও হয়েছিল যে, এত গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড, কেবল প্যান্ডেল বানাতে গিয়ে নষ্ট করা হল!
দেখুন, অনেকেই রেকর্ড নিয়ে যায় ঘর সাজাবে বলে। আর্টের লোকজনও পুরনো রেকর্ড কেনে। সেক্ষেত্রে আমরা দামি রেকর্ড, দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড দিই না। ঘর সাজানোর জন্য নষ্ট হয়ে যাওয়া রেকর্ডই সস্তায় দিয়ে দেওয়া হয়।
আপনি যে কথাটা বললেন, প্যান্ডেলের, মনে হয় সেগুলো সব স্ক্র্যাপ রেকর্ড দিয়েই করা হয়েছিল। কারণ ভালো রেকর্ডের দাম অনেক বেশি। স্ক্র্যাপ রেকর্ড আমরা ৫০-১০০ টাকাতেও বিক্রি করি। আর যদি ভালো রেকর্ড দিয়ে করা হয়ে থাকে, তবে আমি বলব, খুবই খারাপ ব্যাপার সেটা। এভাবে কোনও কিছুই নষ্ট করা উচিত নয়।
আপনার সংগ্রহে এখন কত রেকর্ড রয়েছে?
খুব বেশি নেই। আট হাজারের কাছাকাছি আছে বোধহয়।
কীভাবে সংরক্ষণ করেন রেকর্ডগুলোকে? আমি যতদূর জানি, ধুলো আর পোকা– দুই-ই রেকর্ডের খুব বড় শত্রু।
ধুলো, পোকা, আর ড্যাম্প। ড্যাম্প খুব বাজে জিনিস। ড্যাম্পে রেকর্ড একদম খারাপ হয়ে যায়। আমি গোডাউনে বড় বড় লোহার আলমারি করেছি। এইসব রাখার জন্য। রোজ কিছু কিছু করে রেকর্ড বের করে ঝাড়া-মোছা করা হয়। হাওয়াবাতাস লাগাতে হয়। প্লাস্টিক বদলানো হয়। পোকার জন্য ওষুধ দেওয়া হয়।
নতুন রেকর্ড আনা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো আলমারিতে রাখা হয় না। পোকা আছে কিনা, ড্যাম্প ধরা কিনা দেখে নিয়ে, বেছে-টেছে, কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে তারপর রাখা হয়। না হলে একবার পোকা লেগে গেলে কিচ্ছু করার থাকবে না। যতটা পারি, যত্ন করে রাখার চেষ্টা করি।
এই রেকর্ডগুলো নিয়ে বিশেষ কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে আপনাদের? কোনও প্রদর্শনী বা অন্য কিছু?
এগজিবিশন যদি বলেন, এপ্রিলের তিন নম্বর শনিবারে ‘রেকর্ড স্টোর ডে’ হয়। সেই উপলক্ষে দু’ বছর হল অনেকে মিলে একটা ছোটখাটো ডিসপ্লে করে। রেকর্ড দেখানো হয়। আমার ছেলেরা সেখানে যায়। তবে ওদের পরিকল্পনা আছে আরও বড় করে কিছু একটা করার। সেখানে রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি– দুষ্প্রাপ্য সব কিছুই থাকবে।
আর একটা দোকান করার স্বপ্ন আছে। খুব বড় দোকান। সেখানে সব ভিনাইল রেকর্ড, প্লেয়ার, গ্রামাফোন গোটা দোকান জুড়ে সাজানো থাকবে। লোকে দেখতে আসবে। আমি আশা রাখি, রেকর্ড কখনও মুছে যাবে না, রেকর্ড থাকবেই। আর রেকর্ড থাকলে দোকানটাও থাকবে। গান কি কখনও পুরনো হবে? আপনার পরের প্রজন্ম কি গান শুনবে না? শুনবে তো। গান যতদিন থাকবে, রেকর্ডও থাকবে। কারণ রেকর্ডে ‘লাইফ’ আছে। ‘লাইফ’। এ-ই আমার বিশ্বাস।
কৃতজ্ঞতা: মহম্মদ শাহনওয়াজ (পুত্র), আলোকচিত্র: ব্রতীন কুণ্ডু
গত রবিবার (১৬ মার্চ) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ভয়েস অফ আমেরিকা এবং অন্যান্য সরকারপোষিত সংবাদমাধ্যমগুলোতে গণ ছাঁটাই আরম্ভ করেছে। আজকাল সারা পৃথিবীর কর্পোরেট চাকরিতে ইদানীং যা দস্তুর, সেই অনুযায়ী রাতারাতি ইমেল করে কর্মরত সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীদের জানানো হয়েছে– কেটে পড়ো। যে সাংবাদিক চাটুকার নয়, তাকে নিয়ে ট্রাম্প কী করবেন?