ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পরিক আদানপ্রদান, এই সম্পর্ক যুগে যুগে, কালে কালেই সত্যি হয়েছে। মাস্টারমশাইরা সবসময়েই, ন্যূনতম একজন ছাত্রকেও রেখে যান, যার মধ্যে তিনি আত্মরূপ খুঁজে পান। আমরা মহাভারতে দ্রোণাচার্যকে দেখেছি। ন্যায়-অন্যায়ের কথা সরিয়ে রেখে দেখি, তিনি অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসানোর জন্য একলব্যের সঙ্গে অমন আচরণ করছেন, কোনও ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়। পরাধীন ভারতে চিত্তরঞ্জন দাশ আর সুভাষচন্দ্র বসু, কিংবা মাস্টারদা সূর্য সেন আর প্রীতিলতার গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের কথা মনে করে দেখো।
কথা শুরু করতে গিয়েই মনে আসছে ‘আতঙ্ক’ ছবির সেই মিথ হয়ে যাওয়া সংলাপ— ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।’ ক্ষমতার এমন নিদান দেওয়া তো বরাবর অব্যাহত। আপনি নিজেও বলেছেন সরকারি চাকরির বাধ্যবাধকতার কথা। তবুও, এই সংকটকাল কি এ কথাই বুঝিয়ে দিল না, যে, মাস্টারমশাইরা দেখেন, প্রয়োজনে দেখতেও বলেন?
আমাদের জীবনে পেশা তখনই নেশার রূপ নেয়, যখন আমরা সেই পেশাকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করতে শিখি। আমার কাছে শিক্ষকতা পেশা ও নেশা– দুই-ই। সবরকমের পেশারই একটা ধর্ম থাকে। আবার, আমি যখন মানুষ মোনালিসা মাইতি, আমি যখন এই চলমান সমাজের বাইরের কেউ নয়, তখন আমার মনের মধ্যেও এই সমাজের যাবতীয় উত্থান-পতন, শোক-দুঃখের ছায়া পড়ে। কোনও কোনও সময়ে হয়তো অত্যাচার-অনাচারের সামনে আমি কিছু বলে উঠতে পারিনি, বলার মতো প্রস্তুতি তখন ছিল না। কিন্তু যখন একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে যায়, মনে এবং মননে সে সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়, তখন তো সে সমাজের এ ধরনের উত্থান-পতনে কথা বলবেই। এবং সে শুধু নিজে বলবে না, সে চাইবে তার চারপাশে আরও যারা আছে, তারাও যেন বলতে শেখে, বলতে পারে। সেখান থেকেই আমার এই কথাগুলো বলা। যুগে যুগে এক ধরনের মানুষ আরেক শ্রেণির মানুষের ওপর তার প্রতিপত্তি ফলিয়েছে। আপত্তি তুললে সেই প্রতিপত্তি আরও জোরালো হতে চেয়েছে। তবে সহ্য করতে করতে মানুষ একসময় ঘুরে দাঁড়ায়। এখন সেই ঘুরে দাঁড়ানোর ঘটনাটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হয়।
এই সময়কে ঘিরে আত্মকেন্দ্রিকতার অভিযোগ ওঠে বারবার। অথচ উন্নতির পথে সমাজে যদি দুর্নীতিই স্বাভাবিক বলে গণ্য হতে থাকে, তাহলে তা কি শুধু নিজেরটুকু বুঝে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করে দেয় না?
কোনও মানুষের দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া এবং কোনও মানুষের তার প্রতিবাদ করা বা না-করা, উভয় ক্ষেত্রেই যে কথাটা মনে রাখার তা হল, একজন ব্যক্তি যেমন সমাজবহির্ভূত নয়, তেমনই সে গোটা সমাজও নয়। ব্যক্তিমানুষকে এই ওঠাপড়ার ঢেউগুলো এসে আঘাত করে তো বটেই। এই অনুভূতিগুলো যখন একজন থেকে আরেকজনে সঞ্চারিত হয়, তখনই যৌথ প্রতিবাদ তৈরি হয়। সাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষিতে যেমন আন্দোলনের নিশান পরিবারের হাত থেকে চলে গেল জনতার হাতে, তার ফলেই আমরা জনআন্দোলনের পূর্ণ, মূর্ত, বাস্তব রূপ প্রকাশ্যে দেখতে পেলাম। এই প্রতিবাদ কিন্তু একদিনে, তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি হয় না। অনেক দিনের ক্ষোভ একটু একটু করে জমতে জমতে একদিন এরকম প্রকাশের অবয়ব বেছে নেয়। যে প্রতিবাদ সব স্তরের সব মানুষের মধ্যে একটু একটু করে পৌঁছে, সেখান থেকে উত্তরণ হয়েছে এই যৌথ মুখরতায়।
যে ছাত্রীরা প্রতিবাদের শরিক হতে চেয়েছিল, হিসেবমতো তারা এখনও নাবালিকা। অপ্রাপ্তবয়স্ক কারও মতামতকে অনেকসময়ই একজন মানুষের সিদ্ধান্ত হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় না। আপনার কী মত?
মানুষের বয়স কত হয়েছে, শুধু সংখ্যাতত্ত্বের সে হিসেব দিয়ে তার মননকে মাপা যায়, একথা আমি বিশ্বাস করি না। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিই, এর মধ্যেই আমার স্কুলে সে ঘটনাটি ঘটেছে। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিল। আমি তখন বলেছিলাম, দেখো, মন যখন ভালো নেই, তখন আনন্দে তো মেতে ওঠা যায় না। তোমরা অন্য কিছু ভাব। সেই মেয়েরা তার পরে এসে আমাকে জানিয়েছে, বড়দি, আপনি আমাদের ভাবতে বলেছিলেন। আমরা ভাবতেই চাইছি। আপনাদের উপহার দেব বলে, ঘর সাজাব বলে আমরা যেটুকু টাকা তুলেছিলাম, সেই টাকা আমরা খরচ করছি না। আমরা কোনও একটি অনাথ আশ্রমে যেতে চাই, এবং তাদের যা প্রয়োজন সেই জিনিসগুলো আমরা তাদের উপহার হিসেবে দিতে চাই। ক্লাস সেভেনের মেয়ে, কতটুকু তাদের বয়স, সে তুমিও জানো, আমিও জানি। তাদের একথা আমার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছে। আমি ওদের জড়িয়ে ধরে বলেছি, এই পরিবর্তনই আমি চেয়েছিলাম। উদযাপন হোক, কিন্তু তার মধ্যে যেন মনুষ্যত্বের জায়গাটা থাকে। অথচ একথা তো অনেকেরই অনেক সময়ই মনে আসে না। কিন্তু এই বারো-তেরো বছরের মেয়েরা অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে যে একথা অনুভব করতে পেরেছে, তার জন্য শিক্ষক হিসেবে আমি সত্যিই গর্বিত। বয়সের হিসেব করে কারও সিদ্ধান্তকে তুমি দমিয়ে দিতে পারো না। আমি তাই বিশ্বাস করি এবং মেনেও চলি যে, রাষ্ট্র যদি বিপন্ন হয়, যদি তার শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তবে আঠেরো বছরের নিচের মানুষেরও অধিকার রয়েছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
আমরা ‘ভালো’ বলে তাকেই সাধারণত চিনি, যে ভালো ছাত্র। অথচ, দুর্নীতির সঙ্গে অনেকসময়ই এমন অনেকের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে, যাঁরা এই প্রচলিত অর্থে ‘ভালো’ অর্থাৎ কৃতী ছিলেন। ভালো ছাত্র আর ভালো মানুষ– এ দুয়ের মেলবন্ধনের দিকে শিক্ষক হিসাবে কীভাবে আরও নজর দেওয়া যায় বলে আপনি মনে করেন?
ভারতীয় যে লেখাপড়ার পদ্ধতিতে নম্বর একটা বড় ফ্যাক্টর, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কারণ আমাদের পরিকাঠামো ওইভাবেই তৈরি হয়েছে। আমরা বাচ্চাদের একথা বলি যে, আগে কিন্তু ভালো মানুষ হতে হবে। তবে তার মানে এই নয় যে, তাকে আমরা ওই প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দিচ্ছি। আমরা দু’-ধরনের ছাত্র পাই– একরকম ছাত্র ভাবে, বইতে যা পড়লাম পুরোপুরি তা-ই লিখলাম। আবার আরেক ধরনের ছাত্র বইয়ের সেই পড়াকেই পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করার কথা ভাবে। সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় ধরনের ছাত্রকে আমরা এই বিচারে একটু বাড়তি গুরুত্ব দিই যে, সে ভালো মানের ছাত্র এবং ভালো মনেরও মানুষ। শিক্ষাকে শুধুমাত্র খাতায় উগরে দিলে নম্বর বেশি পাওয়া যায়, সে কথা অস্বীকার করছি না, কিন্তু তাকে আত্তীকরণ করলে ভালো মানুষ হওয়া যায়, তার থেকে সমাজও ভালো কিছু পেতে পারে বলে আমি মনে করি। তবে এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলব। কেউ প্রতিযোগিতা আর নম্বরের বিচারে ভালো ছাত্র মানেই সে খারাপ মানুষ হবে, এমনটাও দাগিয়ে দেওয়ার কিন্তু কোনও কারণ নেই। সাম্প্রতিক কোনও কোনও ঘটনায় দেখা গিয়েছে, কৃতী ছাত্র হিসেবে পরিচিত কেউ পরবর্তীকালে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন, তবে তার জন্য সমগ্র ছাত্রসমাজকে কোনও সাধারণীকরণে আমি ফেলে দিতে পারব না।
মানুষের সঙ্গে মানুষের আচরণবিধি বা সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের শিক্ষা কি আজকের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত?
অবশ্যই থাকা উচিত। আর এ প্রসঙ্গেই আমি বলব, মূল্যবোধের পাঠ যদি পাঠ্যক্রমে না-ও থেকে থাকে, আমাদের অর্থাৎ শিক্ষকদের এবং পরিবারকেই সে দায়িত্ব নিতে হবে। আমারও একটি ছেলে রয়েছে, যে বয়ঃসন্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আমার কথা বলা, আমার জীবনচর্যা, আমার ভাবনা সে নিরন্তর লক্ষ করছে, যার প্রভাব তার ওপরে কোথাও না কোথাও পড়বেই। তেমনই, স্কুলকে আমরা বলি দ্বিতীয় বাড়ি। সেখানেও তাই আমাদের দায়িত্ব থাকে, কোনও একটা কিছু পড়ানোর সময় আরও পাঁচটা বাইরের কথা জানিয়ে, গল্প করে তাদের সচেতন করে তোলার। তাদের মূল্যবোধের পাঠ দেওয়ার। শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা এমনভাবে আত্মসমর্পণ করে, যা অনেকসময় মা-বাবার চেয়েও বেশি। তাই পরিবার এবং শিক্ষক, এই চেন সিস্টেমেই ছোটদের শিক্ষা দিতে হবে। যে বাচ্চা তাঁর ওপরে নির্ভর করে আছে, তাকে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষককে নিতেই হবে।
………………………………………………………
শিক্ষক দিবস উপলক্ষে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীরা আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছিল। আমি তখন বলেছিলাম, দেখো, মন যখন ভালো নেই, তখন আনন্দে তো মেতে ওঠা যায় না। তোমরা অন্য কিছু ভাব। সেই মেয়েরা তার পরে এসে আমাকে জানিয়েছে, বড়দি, আপনি আমাদের ভাবতে বলেছিলেন। আমরা ভাবতেই চাইছি। আপনাদের উপহার দেব বলে, ঘর সাজাব বলে আমরা যেটুকু টাকা তুলেছিলাম, সেই টাকা আমরা খরচ করছি না। আমরা কোনও একটি অনাথ আশ্রমে যেতে চাই, এবং তাদের যা প্রয়োজন সেই জিনিসগুলো আমরা তাদের উপহার হিসেবে দিতে চাই।
………………………………………………………
এই যে সমর্পণ বা নির্ভরতা, হয়তো এই কারণেই ডাক্তার এবং শিক্ষক, সমাজের চোখে এ দুই-ই একসময় ‘নোবেল প্রফেশন’ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। দু’ক্ষেত্রেই তাঁদের কাছে মানুষ নিজেকে অনেকখানি সমর্পণ করে। সময়ের বদল আর রাজনীতির দৌরাত্ম্যে সেই ভাবনায় অনেকখানি ক্ষয় লেগেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে, এক পেশার বিপন্নতাই কি অন্য পেশার দায়িত্বের কথা আরও উসকে দিল না?
আমার মনে হয়, ছাত্র-শিক্ষকের এই পারস্পরিক আদানপ্রদান, এই সম্পর্ক যুগে যুগে, কালে কালেই সত্যি হয়েছে। মাস্টারমশাইরা সবসময়েই, ন্যূনতম একজন ছাত্রকেও রেখে যান, যার মধ্যে তিনি আত্মরূপ খুঁজে পান। আমরা মহাভারতে দ্রোণাচার্যকে দেখেছি। ন্যায়-অন্যায়ের কথা সরিয়ে রেখে দেখি, তিনি অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ আসনে বসানোর জন্য একলব্যের সঙ্গে অমন আচরণ করছেন, কোনও ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নয়। পরাধীন ভারতে চিত্তরঞ্জন দাশ আর সুভাষচন্দ্র বসু, কিংবা মাস্টারদা সূর্য সেন আর প্রীতিলতার গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের কথা মনে করে দেখো। এই সময়ের প্রেক্ষিতে যদি বলি, করোনা আমাদের নতুন করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, স্কুল কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল মানে তো শুধু দেওয়াল, শুধু চক, ব্ল্যাকবোর্ড নয়। সেখানে একটা জীবন্ত আদানপ্রদান ঘটছে। আমার স্কুল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের কথাই বলি, সেখানে করোনার পর মনোবিদের সাহায্য নিয়েছি, বাচ্চাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর জন্য। এই গড়ে তোলার কাজ তো আমাদের করে যেতেই হবে। আর প্রথমে তো আমাদের এগোতেই হবে, নইলে যে কথা আমরা ক্লাসরুমে বলি তা বাস্তবে করে না দেখালে ওই বাচ্চাটি, যে ভবিষ্যতের নাগরিক, সে কী শিখবে?
মনের কথা ধরেই বলি, ভয়ংকর অপরাধের ক্ষেত্রে মনোবিকৃতির একটা বড় ভূমিকা অনুমান করা যায়। একটি অপরাধ আর একটি শাস্তি, এই প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ-নির্যাতনের ধারাবাহিক অভ্যাস বন্ধ করা যায়নি। অপরাধ বন্ধ করার জন্য অপরাধমনস্কতাকে উপড়ে ফেলা জরুরি। সেখানে সামগ্রিক শিক্ষার ভূমিকা, এবং ছোটদের সেভাবে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে বড়দের ভূমিকা কতখানি?
আমার ছেলে বা মেয়ের যে মনের অসুখ হতে পারে, এখনও পর্যন্ত আমরা অনেকেই সে ভাবনায় পূর্ণ মাত্রায় পৌঁছতে পারিনি। আমরা যারা সামনের দিকে রয়েছি বলে মনে করি, তারাও একথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি তা স্বীকার করাই ভালো। তাই মনোবিদের কাছে যাওয়া মানেই সে পাগল, এই দাগিয়ে দেওয়ার সামাজিক অভ্যাসটিও রয়েই গিয়েছে। আর সামাজিক অবস্থানের কথা, সামাজিক প্রতিপত্তির কথা মনে রেখে অনেক সময়ই আমরা বাচ্চাদের ভীষণ ক্ষতি করি। যদি কেরিয়ারের কথাও ধরি, কেউ হয়তো ভালো দাবা খেলে, কিন্তু তাকে ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে বলে জোর করব, কেননা সন্তানের তা হওয়া বা না-হওয়ার উপরে আমার সম্মানের হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করছে। আমি হয়তো তাকে বায়োলজিক্যালি জন্ম দিয়েছি, কিন্তু সেও যে একজন আলাদা মানুষ! তার সেই আলাদা সত্তা কী চায়, তা বিশ্লেষণ করার দায়বদ্ধতা থেকে আমরা সরে আসি। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। দেখো, যদি সংস্কার চাও, তবে একেবারে শিকড়ে গিয়ে তার কারণ খুঁজতে হবে। ধরো যে, বাচ্চাটির মধ্যে এখন থেকেই কোনও কারণবশত কোনও হিংস্রতার জন্ম হচ্ছে, আমি বলব তাদের জন্য অবশ্যই কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই তার ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে সরকারি স্কুলে, যেখানে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ভীষণ ওলটপালট হয়ে আছে। কোথাও ৯০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক, তো কোথাও আবার ৬-৭ জন ছাত্রের জন্য হয়তো জনা ১২ শিক্ষক। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ‘অন্যরকম’ আচরণ করা শিশুদের চিহ্নিত করা যাবে কীভাবে, তার বন্ধু হয়ে ওঠা যাবে কীভাবে, এই প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। মনের কথা বলতে শেখানো, এই বিষয়টি প্রতিটি স্কুলে বাধ্যতামূলক হওয়া দরকার। আমাদের স্কুলের প্রসঙ্গেই বলি, কোনও বাচ্চার মধ্যে যে অন্যরকম চারিত্র্য প্রকাশ পাচ্ছে তা কীভাবে চিহ্নিত করব, মনোবিদের সাহায্যে আমরাও তা শেখার চেষ্টা করছি। কারণ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে ৯০টি বাচ্চার ক্লাসরুম থেকে তেমন বাচ্চাকে বেছে নেওয়া সমস্যার। স্কুলে আমরা একটি বক্সও রেখেছি, ‘নিজের কথা জানাও’ বলে। সেখানে যেমন অদ্ভুত সুন্দর ঘটনার কথা উঠে আসে, তেমনই এমন অনেক ঘটনাও উঠে আসে যা আমাদের কষ্ট দেয়। আমরা চেষ্টা করি বাচ্চাদের সেই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনার। স্কুলের তরফে আমরা একটি এনজিও-র সঙ্গে কোলাবরেশনে কাজ করছি, সেই সূত্রে পড়ুয়াদের মধ্যে এমন ঘটনাও শুনতে পাই যেখানে ১৩-১৪ বছরের মেয়েরা তাদের মামা-কাকা-আত্মীয়ের হাতে নির্যাতনের শিকার। তাদের অনেকে মা-বাবার কাছে একথা বলেও উঠতে পারেনি, ধরেই নিয়েছে যে কেউ বিশ্বাস করবে না। এ প্রসঙ্গে এটাও দেখেছি যে, কোনও বাচ্চার কথা তার মা-বাবা বিশ্বাস করছেন না, উল্টে সে মিথ্যে বলছে এই অভিযোগে তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে ফেলছেন। তবে আমরা তাঁদের কাছে সে কথা পৌঁছে দিলে তখন তাঁরা সেই সমস্যার কথা অন্তত শুনছেন। সুতরাং শুধু শিক্ষিকা হিসেবে নয়, একজন মা হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে আমি চাই, খুব ছোট্ট বয়স থেকেই স্কুলগুলো যদি এই ব্যবস্থা করে– বাচ্চাদের নিয়ে বসা, তাদের মনের কথা শোনার একটা অভ্যাস জারি রাখে। ছোট বড় সরকারি বেসরকারি যে কোনও স্কুলে অন্তত সপ্তাহে একদিন মনোবিদের যদি ব্যবস্থা করা যায়। শুরুতেই যদি খারাপ জায়গাগুলো একটু স্নেহ দিয়ে, খানিক ভালো দিয়ে আমরা ভরাট করতে পারি; ওদের মতো করে বুঝে; তাহলে আমার মনে হয় একদিন অন্ধকার পেরিয়ে যাওয়া যাবে। আমাদের দেশই তো দেখিয়েছে যে দস্যু রত্নাকর বাল্মীকি হয়েছেন। ফলে আমার মনে হয় অনাস্থার জায়গা নেই। আমাদের চেষ্টাটুকু করেই যেতে হবে।
…………………………………………………..
অনেক কঠিন কথা আমরা শিক্ষকরাই পারি সহজ করে তুলে ধরতে। কোনও একটা বয়সের বাচ্চার কাছে নিউটনের তৃতীয় সূত্রও তো সহজবোধ্য নয়। আবার সেই বাচ্চাই তো একটু পরিণত হয়ে ওই সূত্র কথায় কথায় ব্যবহার করে। সুতরাং বয়স কম বলে তার কাছ থেকে যৌনতা সম্পর্কিত কথা এড়িয়ে যেতে হবে কেন! এই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও শিশুকে তো গুড টাচ, ব্যাড টাচ শেখাতে হবে। এবার সে যখন প্রশ্ন করছে, কোনও স্পর্শ কেন ভালো আর কেন খারাপ; সে উত্তর তাকে তার মতো করেই বোঝাচ্ছি।
…………………………………………………..
মন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই শরীরেরও তো একটা মন থাকে। বয়ঃসন্ধিতে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে শরীর নিয়ে নানারকম প্রশ্ন তৈরি হয়। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের শারীরিক পরিচয়ের প্রতি কৌতূহল আসে, আবার প্রান্তিক যৌনতার কারও মধ্যে নিজেকে চেনার সংকট থাকে। এই সবকিছুকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য পাঠ্যক্রমে সেক্স এডুকেশন কতটা জরুরি?
নিশ্চয়ই জরুরি। আমার মনে হয়, অনেক কঠিন কথা আমরা শিক্ষকরাই পারি সহজ করে তুলে ধরতে। কোনও একটা বয়সের বাচ্চার কাছে নিউটনের তৃতীয় সূত্রও তো সহজবোধ্য নয়। আবার সেই বাচ্চাই তো একটু পরিণত হয়ে ওই সূত্র কথায় কথায় ব্যবহার করে। সুতরাং বয়স কম বলে তার কাছ থেকে যৌনতা সম্পর্কিত কথা এড়িয়ে যেতে হবে কেন! এই সময়ে দাঁড়িয়ে কোনও শিশুকে তো গুড টাচ, ব্যাড টাচ শেখাতে হবে। এবার সে যখন প্রশ্ন করছে, কোনও স্পর্শ কেন ভালো আর কেন খারাপ; সে উত্তর তাকে তার মতো করেই বোঝাচ্ছি। আবার এই সময়ে বাচ্চাকে হাত ধরে শপিং মলে নিয়ে গিয়ে হিন্দি সিনেমাও দেখাচ্ছি। এই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াও তার হাতের নাগালে। অতএব, যৌনতার প্রসঙ্গ যখন তার পরিপার্শ্বে ছড়িয়ে আছে, তখন তাকে সে প্রসঙ্গ থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত রাখলে সে ভালো আর খারাপের পাঠ পাবে কেমন করে! আমি নিজেও স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি, বায়োলজি ক্লাসে পরাগমিলন বা বংশবিস্তার পড়ার সময় বন্ধুরা এ ওকে ঠেলাঠেলি করছে, ইশারা ইঙ্গিত করছে যেন কোনও নিষিদ্ধ আকর্ষণের প্রসঙ্গ উঠেছে। আসলে যা জানি না, তাকে জানার ইচ্ছে যে কোনও অনুসন্ধিৎসু মনের থাকবেই, এ তো স্বাভাবিক ঘটনা। তুমি কীভাবে জানছ, আর তুমি কীভাবে জানাচ্ছ, এ দুয়ের ওপরেই কিন্তু অনেক কিছু নির্ভর করে। ভারতীয় সমাজে যৌনতা বা মানব-মানবীর শারীরিক গঠন নিয়ে মুক্তকণ্ঠে আলোচনা করার ক্ষেত্রে একরকম ‘নিষিদ্ধ’ তকমা লাগানো আছে। কিন্তু, দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুকে মনে রেখেও আমাদের এগোতেই হবে। আমাদের একটাই লক্ষ্য, আমাদের বাচ্চারা যাতে বিপথে না যায়। স্কুলের সিলেবাসে যখন লাইফস্টাইল বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হল, সেই শুরুর দিকে দেখলাম অনেক শিক্ষকও কিন্তু কিন্তু করছেন। এই অস্বস্তি আমাদের এমন গভীরে রয়েছে যে, আমাদের এ নিয়ে কোনও ট্রেনিংও দেওয়া হয়নি। তার ফলে কী হল? যে সংস্কারে আমাদের বাচ্চারা চলছে, সে সংস্কারে তো আমি নিজেও জারিত হয়ে আছি; ফলে বাচ্চাদের এ কথা কীভাবে বলা যাবে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যেও এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বজায় রইল। এই প্রসঙ্গে আমার মনে হয়, যৌনশিক্ষা জরুরি তো বটেই, উপরন্তু এ নিয়ে কী কথা বলব, কেমন করে বলব– তা নিয়ে শিক্ষককে ভাবতে হবে। খোলা মনে। এবং শব্দব্যবহার, আচরণ, সবকিছু নিয়ে সচেতন থেকে। পাঠ্যক্রমের বইগুলি নিয়ে চর্চা ও আদানপ্রদানও জারি রাখতে হবে, এবং সেই চর্চা ও আলোচনার উদ্যোগ শিক্ষাদপ্তরকেই নিতে হবে। কারণ, সরকারি স্কুলের ভরসায় এখনও বিপুলসংখ্যক বাচ্চারা থাকে। তিরিশ মিনিটের ক্লাসে ৭০-৮০-৯০ জন বাচ্চাকে মোটিভেট করার সুযোগ অন্য কোনও পেশায় নেই। সুতরাং লিঙ্গবৈষম্য দূর করার চর্চা আমাদের ক্লাসরুম থেকেই শুরু করতে হবে।
শেষ প্রশ্ন, পড়ুয়াদের মধ্যে প্রশ্ন করার অভ্যাস তৈরি করা শিক্ষকের দায়িত্ব। তবে অন্য হায়ারার্কিকে প্রশ্ন করার মতো, শিক্ষককেও প্রশ্ন করার অধিকার শিক্ষার্থীর থাকা উচিত, এ কথা কি আপনি মনে করেন?
অবশ্যই আছে। বয়স বিচার করে, বুদ্ধির বিচার করে, তোমার মতামত দেওয়ার সময় হয়নি বলে কোনও কথাকে চুপ করিয়ে দেওয়া চলে না। তাকে উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। সেক্ষেত্রে সে তার মতো করে অন্ধকারে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে। যদি সে আলো খুঁজে পায়ও, হয়তো তখন অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। অতএব এটা আমাদের দায়িত্ব যে, আমাদের তার কথা শুনতে হবে, এবং শোনার মতো করেই শুনতে হবে। সেখানে তেমন কোনও উপাদান থাকলে তাকে গ্রহণও করতে হবে। কেবল আমি বড় আর সে ছোট বলে তাকে নাকচ করা চলবে না।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………..