পদ্মশ্রী পেলেন সনাতন রুদ্র পাল। বাংলার প্রতিমাশিল্পের এ এক চূড়ান্ত আনন্দ মুহূর্ত। যে শিল্পসমাজ গিয়েছে দীর্ঘদিন অবহেলার মধ্যে দিয়ে, যে সমস্ত কারিগর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন মাতৃমূর্তি– তাঁদেরকে সত্যিই কি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এতদিন? খাস কলকাতার কুমোরটুলি পাড়াটিও কীরকম ঝিমিয়ে, অন্ধকার টিমটিমে হয়ে পড়েছে। সনাতন রুদ্র পালের পদ্মশ্রী প্রাপ্তি হয়তো একঝলক টাটকা রোদ, যা এসে পড়ল কুমোরটুলির মাটিতে। প্রতিমাশিল্পীদের স্বপ্নে ও সংসারে। রোববার.ইন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সনাতন রুদ্র পাল বললেন তাঁর জীবন, তাঁর শিল্পকথা। শুনলেন তিতাস রায় বর্মন।
প্রথমেই রোববার.ইন-এর তরফ থেকে পদ্মশ্রী প্রাপ্তি জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা।
এই ‘পদ্মশ্রী’ শুধু আমার নয়। এই সম্মান সমস্ত কারিগর শিল্পীর, প্রতিমা শিল্পের। আমি ভারত সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের এই সম্মান দেওয়ার জন্য। এই প্রাপ্তি আমি সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।
দীর্ঘদিন ধরে আপনি মাটি নিয়ে চর্চা করছেন। ‘মাটি’ আপনার কাছে কী?
মাটি আমার কাছে অমূল্য। মাটি এমনই একটা জিনিস, যা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। পৃথিবীতে যা কিছু, সবই তো মাটি-নির্মিত। মাটি মানে জমি। আর জমিতেই ফসল, জমিই সোনা। মাটি থেকেই আমরা বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পাই। আমিও মাটি থেকেই শিখেছি বেঁচে থাকা।
আপনি প্রথম কবে মাটিতে হাত দিলেন? ঠিক করলেন যে মূর্তি গড়বেন?
আমাদের তখন ‘রাখাল পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের প্রতিষ্ঠান ছিল। আমি ইশকুলে পড়ার সময় অফ টাইমে কারখানায় গিয়ে কাজ করতাম। পুজোর সময় যখন খুব চাপ থাকত, তখন বাবা-জ্যাঠারা বলত, কারখানায় গিয়ে একটু কাজ করে দিতে। ওদের সাহায্য করা আর কী। সেই প্রথম আমার মাটিতে হাত দেওয়া– মূর্তি গড়ার জন্যই। বাবাদের সাহায্য করতে করতে মূর্তি গড়া একটা নেশায় পরিণত হয়ে হল। একটা সময় এল, যখন একা একাই মূর্তি গড়তে শুরু করি। জেদ চেপে গিয়েছিল যে, কাজটা শিখব এবং ভাল করে করব। যখন পড়াশোনার পাঠ শেষ হল– আমি অ্যাক্টিভলি আমাদের ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। কাজকম্ম করতাম, কাজ শিখতাম। এইভাবে বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে আমার কাজ শেখা। এখনও শেষ হয়নি শেখা– যতদিন মূর্তি গড়া, ততদিনই তো শেখা।
কোন ছোটবেলা থেকে আপনি মূর্তি গড়া শুরু করেছেন। আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। কী বদল এসেছে এই সময়সীমায়?
ছোটবেলায় বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের নির্দেশানুসারে কাজ করতাম। তাদের ধারাটাকে বজায় রাখতাম। কিন্তু যখন নিজের দায়িত্বে প্রতিমা গড়া আরম্ভ করি, তখন নিজের চিন্তা-ভাবনাগুলোর মধ্যে একটু বদল আনতে লাগলাম। ভাবতে লাগতাম, কীভাবে প্রতিমাগুলোকে আধুনিক করা যায়। বাবা-জ্যাঠামশাইয়ের কাজগুলোর থেকে একটু আলাদা করা যায়। মুখের আদলটা একটু বদলে ফেলা যায়, অ্যানাটমি যদি একটু বদলানো করা যায়। এই বদল করার আগ্রহটা থেকে কাজের পরিবর্তন ঘটিয়েছি। এইভাবে কাজের পরিবর্তন ঘটানোর ফলেই লোকের চোখে পড়েছে আমার কাজ। এবং দর্শকদেরও ভালো লেগেছে।
আপনার তো কুমোরটুলিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সেই কুমোরটুলি কতটা বদলেছে বা কতটা একইরকম আছে?
আমার যখন ৪৪ বছর বয়স, তখন আমি কুমোরটুলি থেকে বেরিয়ে আসি। বেরিয়ে এসে উল্টোডাঙা গুরুদাস দত্ত গার্ডেন লেনে আমি স্থায়ীভাবে কাজকম্ম করতে আরম্ভ করি। ৪৪ বছর বয়স পর্যন্ত কুমোরটুলির যে অভিজ্ঞতা সেটা বলি। তখনকার কুমোরটুলির একটা আলাদা ঐতিহ্য ছিল। ঐতিহ্য এখনও আছে, কিন্তু তখন কুমোরটুলিতেই একমাত্র প্রতিমা তৈরি হত, বাইরে বাইরে এত প্রতিমা তৈরির কারখানা তৈরি হয়নি। এখন বাইরে অনেক কারখানা তৈরি হয়েছে। আমাদের কারিগররা বিদেশি গিয়ে কাজ করছে। ভারতেরও নানাপ্রান্তে গিয়ে তারা কাজ করছে। ফলে এখন কুমোরটুলিতে কারিগরের অভাব তৈরি হয়েছে। আগে যে কাজটা কেন্দ্রীভূত ছিল, সেটাই ছড়িয়ে পড়ল, কেন্দ্রহীন হল। এখন কুমোরটুলিতে কারিগর পাওয়া যায় না– এমনই পরিস্থিতি! লোকে এসে বলে– কুমোরটুলি সেই আগের মতো নেই, এখন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ভাব। অন্ধকার অন্ধকার। আগে একটা জমজমাট ব্যাপারটা ছিল! আগের সময়টাও ভেবে দেখুন– রাখাল পাল, নেপাল পাল, ওদিকে গোরাচাঁদ পাল, রমেশচন্দ্র পাল, শ্রীকৃষ্ণ পাল, কার্তিক পাল– এ বলত আমায় দেখ, ও বলত আমায় দেখ। আলাদা একটা চার্ম ছিল। এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিল্পীদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে যাচ্ছে। তবুও এই ভাঙাগড়ার মধ্যে থেকেই কেউ কেউ কাজ ভালো করার চেষ্টা করছেন। থিম শিল্প আসার দরুন আমাদের মনে একটা জেদ চেপে গেছে কীভাবে আরও ভালো করা যায়। আমরা যেন এই প্রতিযোগিতা থেকে একটু এগিয়ে থাকি। এই প্রতিযোগিতার জন্য কাজকম্মে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
আপনি কখনও সাবেকি মূর্তি ছাড়া অন্য কিছু গড়েছেন?
হ্যাঁ, থিমের মূর্তি আমরা প্রতি বছর দুটো-তিনটে করে গড়ি। কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী, আমরা করে দিই। না-হলে ভাববে এরা থিমের প্রতিমা করতে পারে না। তার জন্য আমরা করে দিই। উপযাজক হয়েই করে দিই। তাছাড়া বেশিরভাগ ঠাকুরই আমাদের সাবেকিয়ানার। কিন্তু থিমের যে ক’টা করি, সে ক’টার মধ্যে কিন্তু মাতৃভাব রাখি আমরা। মাতৃভাব তুলে দিয়ে বিকট থিম আমরা করি না। আর করবও না। আমার সাবেকিয়ানাই পছন্দ। আমার কাস্টমারেরাও সাবেকিয়ানাই বেশি চায়।
অন্যরকম একটা প্রশ্ন করছি। যাঁরা মূর্তি গড়েন তাঁরা তো জানেন যে মূর্তিটা ভাসান হয়ে যাবে, একটা জিনিস আপনি এতদিন ধরে গড়লেন সেটা ভাসান হয়ে যাবে, সেটার অনুভূতিটা কীরকম হয়?
ভাসান তো হবেই। আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি যে, প্রতিমা পুজো হচ্ছে, চারদিন পর ভাসান হয়ে যাচ্ছে। তবুও আমরা আমাদের মনের তাগিদ খুঁজে পাই লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিমা দর্শনের আনন্দ দেখে। এখন ক্যামেরা এসেছে, আজ থেকে বছর ১৫-২০ আগে এত ক্যামেরা ছিল না। তখন কিন্তু মনের মধ্যে একটা ছবি গেঁথে রাখত দর্শকমণ্ডলী। সেটাই আমাদের প্রাপ্তি ছিল। মনের মধ্যে গেঁথে রাখা। সেই মনের ছবি থেকেই দর্শক চিন্তাভাবনা করত যে, গত বছর এইরকম করেছে, এ বছর অন্যরকম হবে। কে ভাল, কে মন্দ– এই বিচারটাও তারা মনের মধ্যে থেকে তৈরি করছে। এখন তো ছবি পরপর রেখে দেখছে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটার মধ্যে কী দোষ আছে, কোনটার মধ্যে কী ভালো আছে, কিন্তু তখন তো আর এসবের সুযোগ ছিল না, মনের মধ্যে ছবিগুলোকে ভাসিয়ে রাখত শুধু। তাই ভাসানের মনখারাপটা আর করত না। এটাই শিখেছি আমরা যে, মানুষের মনে আমরা রইলাম। তাই ভাসান নিয়ে কখনও মনখারাপ করত না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কুমোরটুলি সেই আগের মতো নেই, এখন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা ভাব। অন্ধকার অন্ধকার। আগে একটা জমজমাট ব্যাপারটা ছিল! আগের সময়টাও ভেবে দেখুন– রাখাল পাল, নেপাল পাল, ওদিকে গোরাচাঁদ পাল, রমেশচন্দ্র পাল, শ্রীকৃষ্ণ পাল, কার্তিক পাল– এ বলত আমায় দেখ, ও বলত আমায় দেখ। আলাদা একটা চার্ম ছিল। এখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিল্পীদের মনোবল অনেকটাই ভেঙে যাচ্ছে। তবুও এই ভাঙাগড়ার মধ্যে থেকেই কেউ কেউ কাজ ভালো করার চেষ্টা করছেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আপনার কি মনে হয়, দর্শক কতটা বদলেছে? দর্শকের চাহিদা কতটা বদলেছে?
দর্শকের চাহিদা প্রচুর বদলেছে। আগে দর্শকরা এত খুঁটিনাটি বিচার করত না। কিন্তু এখন আমরা যখন প্যান্ডেলে যাই, দেখতে পাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিমা নিয়ে সূক্ষ্ম বিচার করছে। আজকের দর্শক প্রতিমা বোঝে, না হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা লাইন দিয়ে প্যান্ডেল, ঠাকুর দেখবে কেন? দূর থেকে দেখেও তো চলে যেতে পারত। বোঝে বলেই তারা দেখার চেষ্টা করে এবং দেখে ভালো-মন্দ বিচার করে।
তাহলে তো একটা কম্পিটিশন এসেই যায়।
হ্যাঁ, কম্পিটিশন তো বটেই। প্রতিমা শুধু তো নিছক প্রতিমা হচ্ছে না এখন। এখন লোকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে প্রতিমা কিনবে। সাবেকিয়ানার মতো ঠাকুর মালা দিয়ে ঢেকে রেখে, নমস্কার করে চলে গেল– এমন তো আর হয় না। এখন প্রতিমার সঙ্গে শিল্পের যোগসাধন চাই। প্রতিমা শুধু প্রতিমা হলেই হবে না, তার সঙ্গে শিল্প চাই।
প্রতিমা শিল্প এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে?
ভালোই তো। তা না হলে এই সম্মান আমাকে দেওয়া হল কেন? এখান থেকে তাদের কাছ বার্তা গেছে, তারাও খবর নিয়েছে, নিয়ে তারপর এই ঘোষণা করেছে। আমার তো তা-ই মনে হয়।
নতুন প্রজন্মকে আপনি কী বলবেন? এই সম্মান নিশ্চয়ই নতুন প্রজন্মকে আরও প্রতিমা শিল্পের দিকে নিয়ে আসবে?
একদম একদম। নতুন প্রজন্ম পদ্মশ্রী প্রাপ্তি দেখে উৎসাহিত হয়েছে। আমার কাছে প্রচুর ফোন আসছে, ওরা প্রচুর ধন্যবাদ জানাচ্ছে যে, তুমি একটা পরিবর্তন করে দিলে আমাদের শিল্পে। আমাদের মনে আরও জোর বাড়ল। যদি আমরাও আগামী দিনে ভালো কাজ করি, তাহলে আমরাও এমনটা পেতে পারি। এরকম বার্তা মাঝে মাঝে আমার কাছে আসছে গত কয়েকদিন ধরেই।
এখনও পর্যন্ত মূর্তি গড়ার আপনার প্রিয় অভিজ্ঞতা কী? কোন মূর্তিটি গড়ে আপনি নিজে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছেন?
কোন মূর্তি কীরকম দাঁড়িয়ে যাবে, আমরা কিন্তু স্টুডিওতে অতটা বুঝতে পারি না। মণ্ডপে পৌঁছনোর পর, চালচিত্র লাগার পর, সম্পূর্ণটা বোঝা যায়। আমার স্টুডিওতে মনে হচ্ছে ওই ঠাকুরটা ভালো, কিন্তু ওটা বাদ দিয়ে অন্য ঠাকুর ভালো দেখাচ্ছে প্যান্ডেলের পজিশন, প্যান্ডেলের আলো দেওয়ায়। প্যান্ডেলে শুধু ঠাকুরটা নির্ভর করে না, প্যান্ডেলে আলো দেওয়াটা কিন্তু একটা বিরাট জরুরি ব্যাপার। ঠিকমতো আলো না পড়লে ঠাকুর কখনও ফুটে উঠবে না। অনেক প্যান্ডেল আলোই দিতে জানে না। ঠাকুরের মুখে অন্ধকার, ঠাকুরের অঙ্গসজ্জার মধ্যে অন্ধকার। আলোটা একটা বিরাট ফ্যাক্টর। তার সঙ্গে পরিপাটি প্যান্ডেলের তো দরকার আছেই।
যিনি মূর্তি গড়েন, তিনি শিল্পী না ভক্ত?
যিনি মূর্তি গড়েন, তাঁকে তো শিল্পী হতেই হবে, সঙ্গে ভক্তও হতে হবে। ভক্ত না হলে মায়ের যে রূপ, মায়ের যে আদল, এগুলো প্রস্ফূটিত হবে না। মানে ভক্তের সঙ্গে শিল্পের চেতনার মিলমিশ চাই। শিল্পকে বাদ দিয়ে শুধু ভক্তি দেখালে হবে না, ভক্তি বাদ দিয়ে শুধু শিল্পের দ্বারা মায়ের ওই রূপ দেওয়া যাবে না।