আজ দোল। আজ রং মাখার দিন। কিন্তু যাঁরা রোজই রং মাখেন, যাঁরা পেশাগতভাবেই রঙের সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁদের জীবনটা কীরকম? কীরকম সেই বহুরূপীর বহু রূপের অভিজ্ঞতা? এই দোলের দিনটাকেও বা তাঁরা কীভাবে দেখছেন? এইসবেরই একটা ধারণা পাওয়া যাবে এই সাক্ষাৎকার থেকে। বীরভূমের গ্রামে, নিজের বাড়িতে বসে কথা বললেন ধনেশ্বর বৈরাগ্য। রোববার.ইন-এর পক্ষ থেকে শুনলেন সম্বিত বসু।
সুবলদাস বৈরাগ্য– আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহুরূপী, তাঁর পুত্র আপনি, প্রথমেই জানতে চাইব, আপনার ছেলেবেলা কীরকম কেটেছে?
আমি কুলেগ্রামে থাকি। ‘কুলে’ আমাদের গ্রামের ডাকনাম। ভালো নাম ‘কুলিয়া’। এই গ্রামেই কেটেছে আমার ছোটবেলা। আর বাকি গ্রামের ছেলেদের মতোই। তবে, বাবার পেশার জন্যই বাবাকে নানারকমভাবে দেখতে পেরেছি। আমার বাবার অনেকরকম রূপ। ‘বহুরূপী’ ছাড়া অন্য কোনও পেশায় থাকলে এত রূপে দেখতে পাওয়া বোধহয় সম্ভব না। বাবা তিনবার বিদেশ গিয়েছেন এই শিল্পপ্রতিভার জন্যই। এমনই দক্ষতা ছিল তাঁর। বাবার এখন ৮২। শরীর দুর্বল হয়েছে। বহুরূপী আর সাজেন না। অনুষ্ঠান করেন না। সেই ছোটবেলাতেই বাবাকে দেখেছি নানারকম রং মেখে সেজে উঠতে। কখনও দেবদেবী, কখনও রাক্ষসী, ফকির কখনও। এখন সেগুলো আমি সাজি। তবে বলে রাখি, বাবার বহুরূপী সাজার যে রং তা আজকের বাজার চলতি সুলভে পাওয়া রং নয়।
তাহলে, প্রয়োজনমতো রং বানিয়ে নিতেন? কীভাবে বানাতেন?
গাছের বাকল থেকে, পাতা থেকে তৈরি করে নিতেন রং। সময় লাগত। কিন্তু সে সময়কার বহুরূপীরা এমনটাই করতেন। রঙের মেকআপ টিউব তো দোকানে পাওয়া যেত না তখন। মনে আছে, ঘরে মুড়ি ভাজা হত যে মাটির খোলায়, কাঠের জ্বালে, সেই মাটির খোলার পিছনে থেকে যাওয়া কালো অংশগুলো চেঁছে রাখতেন বাবা। তার সঙ্গে বোরোলীন মিশিয়ে কালো রং তৈরি করতেন। তা দিয়েই কাজল পরতেন। ওই রঙে বাবাকে কালীঠাকুর সাজতেও দেখেছি। সবুজ রং চাইলে গাছের পাতাকে পুরু করে বেটে তৈরি করতে হত।
আপনি এই পেশায় এলেন কবে?
আমি উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তারপর সেলসম্যানের কাজ নিয়েছিলাম। হোলসেল মেডিসিনের কাজ। ১৫ বছর ছিলাম ওই পেশাতেই। বোলপুর থেকে মাল নিয়ে আশপাশের নানা গ্রামের দোকানে ওষুধ দিয়েছি, টাকা বুঝে নিয়েছি। কিন্তু এরই মাঝে নানা মানুষ আসতেন বাড়িতে, সাংবাদিকরাও। তাঁরা বলতেন, আমি কেন এই পেশায় আসছি না? আমাদের পরিবারের যে নিজস্ব শিল্পধারা, সেটা তো হারিয়ে যাবে। একদিন এসব ভাবতে ভাবতে সত্যিই ছেড়ে দিলাম পুরনো পেশা। এখন মনে হয়, ওই ১৫ বছর– বড় ভুল করেছিলাম। বহুরূপী সাজেই আমার আনন্দ। ২০১৪ সালের ৯ জুলাই– আমি প্রথম আমার পাশের গ্রাম, নাম সরষে, সেখানে রাম সেজে শুরু করেছিলাম আমার বহুরূপী জীবন।
এতদিনের অন্য একটা পেশা ছেড়ে বহুরূপী হতে আসা, অনিশ্চয়তায় ভোগেননি? অন্তত প্রথম দিন?
না। কোথা থেকে যেন বিশ্বাস এসেছিল একটা। আর বাবা তো একটা প্ল্যাটফর্ম করেই দিয়েছিলেন। সেই প্ল্যাটফর্মে এখন আমি দাঁড়িয়ে। আমাদের ঐতিহ্য আমি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমার ছেলে– এখন ক্লাস নাইনে পড়ে, ওকেও আমি নিয়ে বেরই। ওকেও তালিম দিচ্ছি বহুরূপীর। মাধ্যমিক পেরলে ইচ্ছে আছে সবসময়ই সঙ্গে নেব ছেলেকে। আমি চাইছি তিন প্রজন্মের বহুরূপী হয়ে উঠি আমরা।
আপনি মূলত কী কী সাজেন?
কোনও গ্রামে যদি বহুরূপী শিল্পকলা দেখাতে যাই, তাহলে সাতদিন ধরে দেখাতে হয়। তখন এক-এক দিন এক-এক রূপ। প্রথম দিন নারদ সাজি। পরের দিন কোনও হাস্য-কৌতুকের কিছু হয়তো। তারপর মনসা, কালী, দুর্গা। ছোট ছেলেমেয়েদের ভয় দেখানোর জন্য রাক্ষসও সাজি। তারাসুন্দরীও সাজি কখনও। শেষের দিন সাজি গোয়ালিনী। গোয়ালিনী সেজে গোটা গ্রাম ঘুরি, তখন গ্রামের লোকজন নিজেদের সাধ্যমতো পয়সা, চাল-ডাল ইত্যাদি দেয়। এখন সরকার যদিও ভাতা দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও নিয়মিত তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে ডাক পাই আমরা।
বহুরূপী সাজতে কীরকম সময় লাগে আপনাদের?
রাক্ষস সাজলে সময় অল্পই লাগে। টিনের হাত-টাত লাগিয়ে নিই, মুখোশ আর পোশাক পরলেই হয়ে যায়। কিন্তু দেবদেবী সাজি যখন, তখন প্রায় পৌনে এক বা এক ঘণ্টা লেগে যায়।
এই যে আপনি দেবদেবী সাজেন, আপনাকে কেউ প্রণাম করতে আসে না?
হ্যাঁ, দেবভক্তি তো বহুরূপীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কালী-মনসা-দুর্গা সাজলে দেখেছি, অনেক বয়স্ক মহিলারাও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে আসেন। অনেকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করবেনই করবেন! আমি বলি, এ কী, আমাকে কেন প্রণাম করছেন? ওঁরা বলেন, তোমাকে না, তুমি যে রূপে সেজেছ, সেই রূপকেই আমি প্রণাম করছি। নারদ সেজে যে প্রভুর গুণগান করি, সংলাপ বলি, তখনও এই ভক্তি দেখতে পাই সকলের চোখে-মুখে।
গ্রামের মানুষের দোরে দোরে যে বহুরূপী সেজে ঘুরে বেড়ান– সেটা কতক্ষণ?
সাধারণত সকাল ৯টা থেকে ৩টে। কম করে ৫-৬ ঘণ্টা। পায়ে হেঁটেই।
অনেকটা সময় তো! রোদের মধ্যে দিয়েও হাঁটেন নিশ্চয়ই। জলতেষ্টা, খিদে কিংবা শৌচ– কীভাবে সামলান তখন?
এ এক আশ্চর্য ব্যাপার! মেকআপ নিয়ে নেওয়ার পর খিদে-তেষ্টা-শৌচ কিছুই পায় না। গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে কখনও, কোনও কোনও গৃহস্থ বলেন, বাইরে রোদ খুব, আসুন একটু ঠান্ডা জল খান। কিংবা কেউ হয়তো শরবত করে দিলেন। কিন্তু এমনই অভ্যাস যে খিদে পায় না। সবটা মিটে যাওয়ার পর, অভিনয়ের পর, এই সমস্ত বোধ আবার ফিরে পাই।
আচ্ছা, এই পেশায় কি মেয়েদের দেখেছেন তেমনভাবে?
আগে তেমন ছিল না, জানেন? ইদানীং দেখি, মহিলারাও আসছেন একটু একটু করে। লাভপুর থানার অন্তর্গত ভালকুটি নামে একটা গ্রাম আছে। ওই গ্রামে প্রায় ৫০টা বাড়ি আছে বহুরূপীদের। ওরা যাযাবর জাতি। সরকার যে বহুরূপী শিল্পীদের কার্ড দিয়েছে এখন, ওঁরাও করিয়েছে সেসব। ওই গ্রামের মহিলাদের দেখেছি যে, রং মেখে নানা রূপে বেরিয়ে পড়েছে। অনুষ্ঠানেও যাচ্ছে। কিন্তু ওই গ্রাম বাদ দিয়ে আর কোনও মহিলাদের দেখিনি বহুরূপীর সাজে।
কোনও মেয়ে যদি চায় এই পেশায় আসতে, তালিম দেবেন?
অবশ্যই দেব। কেন দেব না! আমার পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ আগ্রহ দেখায়নি এখনও। কেউ যদি চান এই শিল্প শিখতে, আমি শেখাবই।
বহুরূপী হিসেবে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় দিন কী?
প্রথম দিনই। সেদিন বাবা আমাকে ডাক্তার সাজিয়ে দিয়েছিলেন। পাশের গ্রাম সরষে-তে এক ডাক্তারবাবু ছিলেন। হেলথ সেন্টারে কাজ করতেন। তিনি বাড়ি ছিলেন না তখন। আমরা ডাক্তার সেজে ওঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, ওপরমহল থেকে পাঠিয়েছে, চেক আপ করতে এসেছি। ওঁরা সকলে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। পরে বুঝতে পারেন যে, আমি বহুরূপী। বাবার মেকআপ ছিল এতটাই নিখুঁত। দাড়ি-গোঁফ, স্টেথোস্কোপ। আর গ্রামে যেহেতু ডাক্তার বিশেষ নেই, এই পোশাকে দেখতে পাওয়া যায় না, তাই অনেকে দেখতে এসেছিল আমাকে। আবার রাক্ষস সেজেছি যখন, তখন অনেকে এমন দৌড় দিয়েছে যে, পড়ে হাত-পা ছড়ে গিয়েছে। ওদের লেগেছে, খারাপই লেগেছে তাতে। কিন্তু আমি যে রাক্ষস রূপে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিলাম, তার সার্টিফিকেট ওই ছড়ে যাওয়া দাগ। বাকি সব চরিত্র দিনের বেলায় করলেও, রাক্ষস-রাক্ষসী আমি করি বিকেল-সন্ধে নাগাদ। তখন অন্ধকার আসছে আসছে, ওই সময় চরিত্রটা জমে ভালো।
আপনার গ্রামেও তো দোল খেলা হয়, রং মাখে অনেকে, আপনার দেখে কেমন লাগে? যদিও এই রং মাখা আর রোজকার রং মাখার দূরত্ব অনেক।
হ্যাঁ, দুটো রং মাখার তাৎপর্য দু’রকম। রাধা-কৃষ্ণকে উপলক্ষ করে এই বিশেষ দিনটা আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আলাদা হয়ে যায় রোজের পেশায়, সংলাপে, অভিনয়ে। বাকিদের দৈনন্দিন জীবনে এর কোনও প্রভাব নেই, আমার রয়েছে। রং সত্যিই আমার মর্মে লেগেছে।
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।