কড়চা। চারপাশে কী হচ্ছে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কী কী বদল হচ্ছে, কী কাজ হচ্ছে নাটকে-গানে-কবিতায়। এই কলকাতা এবং কলকাতার বাইরেও, বাঙালির কী হালচাল, তা নিয়েই আমাদের ‘ক্ক’। প্রতি সপ্তাহে নজর রাখুন।
প্রচ্ছদ: সোমোশ্রী দাস
মৌসুমী বায়ু
‘তুমি চিল হও’। একটি অ্যালবাম। ১৯৯৪ সালে ধীরসুস্থে ছড়িয়ে পড়েছিল বাঙালির অন্তরমহলে। সেই গানের শ্রবণস্বাদ কীরকম? ছিমছাম, কিন্তু শব্দ ও সুরের ডালপালা বহুদূর ছড়িয়ে গিয়েছে। গায়িকার নাম মৌসুমী ভৌমিক। সারল্য তাঁর গানের দুয়েন্দে। সারল্য তাঁর লেখারও আত্মা। তেৎসুকো কুরোয়ানাগি-র ‘তোত্তো-চান’ অনুবাদ করেছিলেন তিনি। সে বই বাঙালির হাতে-হাতে ঘুরে বেরিয়েছে বহুকাল, এখনও। তাঁর অ্যালবাম বেরিয়েছে সময়ের ফাঁকে ফাঁকে, বাঙালি অনুরক্ত হয়েছে তাঁর অবিমিশ্র গলায়, যা কাঙ্ক্ষিতও ছিল। বাংলাদেশের জনপ্রিয় পরিচালক তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ সিনেমার সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। ২০০২ সালে কলকাতা ও লন্ডনের বেশ কিছু সদস্য নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘পারাপার’ নামে গানের দল। নিরন্তর ৪০ বছর, আমাদের কথা ও সুরের দেশে নিয়ে যান মৌসুমী ভৌমিক।
তাঁর এই দীর্ঘ সময়ের বর্ণময় শিল্পীজীবন নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চলেছে হাওড়া বিজ্ঞান চেতনা সমন্বয়। ১১ আগস্ট, রবিবার, হাওড়া বিজ্ঞান চেতনা সমন্বয়-এর ৪০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে হাওড়া শরৎ সদনে আয়োজিত হবে ‘কথায় ও গানে ৪০ বছর’। স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত থাকবেন মৌসুমী ভৌমিক। সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদানের পাশাপাশি আয়োজিত হবে বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। থাকছে ‘বিজ্ঞান চেতনা’র শুরুর কথা নিয়ে আলোচনাও।
রাজস্থান-মাহাত্ম্য
৫০ বছর পেরিয়ে নিজের দুই শহরকে ফের জুড়ছে মুকুল। খাস কলকাতায় জন্মানো সেই ছেলের পূর্বস্মৃতির দৌলতে রাজস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল ফেলুদা। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’-র সেই রোমাঞ্চ এখনও অটুট। সেকথা মনে রেখেই রাজস্থানি সংস্কৃতির উদযাপনেও ‘সোনার কেল্লা’-কে জুড়ে নিয়েছে কেসিসি রামঝোল ২.০। ৪ আগস্ট, সকালে সাড়ে এগারোটায় ‘ব্রিজিং কলকাতা অ্যান্ড রাজস্থান ইন সোনার কেল্লা’ শীর্ষক বক্তৃতায় অংশ নেবেন সন্দীপ রায়, সঙ্গে পর্দার তোপসে ও মুকুল, সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং কুশল চক্রবর্তী। কথা হবে সত্যজিৎ রায়ের চোখে দেখা রাজস্থান নিয়ে। রাজস্থানে ‘সোনার কেল্লা’-র শুটিংয়ের সময় ঘটে যাওয়া অজানা ঘটনার কথা ভাগ করে নেবেন বক্তারা। সমগ্র অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় পিনাকী দে।
তা বটে…
বটতলা প্রকাশনার বই। কীরকম ছিল তা? কাগজ কিংবা প্রচ্ছদ? রবীন্দ্রনাথই তাঁর কবিতায় এ ব্যাপারে খানিক বক্তব্য রেখেছেন: ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ সে বটতলাতে ছাপা,/ দিদিমায়ের বালিশ-তলায় চাপা।/ আলগা মলিন পাতাগুলি, দাগি তাহার মলাট/ দিদিমায়ের মতোই যেন বলি-পড়া ললাট।’ বোঝাই যাচ্ছে, তা মোটেই সুদৃশ্য, সুসম্পাদিত ঝকঝকে কেতার কিতাবি ব্যাপারস্যাপার নয়। তবুও বটতলায় জনপ্রিয়তা তাতে একবিন্দু আটকায়নি। বাঙালি কেচ্ছা-সংস্কৃতির জলছাপ যেমন এসে পড়েছিল, তা ছাড়াও ছিল বিবিধ বিষয়ের ঝাঁক– যেমন বিধবা বিবাহ, বাল্য বিবাহ, ফিরিঙ্গিপ্রীতীকে কেন্দ্র করে লেখা বই। ১৮১৮ সালে বিশ্বনাথ দেবের প্রেস দিয়ে বটতলার উত্থান বলে ধরা হয়। ১৮২১ সালেই যদিই চারটি প্রেসের দৌরাত্ম্য দেখা যায় এ কলকাতায়, যা এদেশীয় লোকেরাই চালাত। হিন্দুস্থানী প্রেস, বাঙালি প্রেস, সংস্কৃত প্রেস এবং বিশ্বনাথ দেবের প্রেস। শ্রীপান্থ একথাও লিখতে কসুর করেননি যে, ‘‘বটতলা সেদিক থেকে সাধারণ বাঙালির কাছে যেন এক খোলামেলা বিশ্ববিদ্যালয়, আজকের ভাষায় ওপেন ইউনিভার্সিটি।’’
সেই বটতলার হালহকিকত জানাতেই আসছে ‘হাটুরে বটতলা’। অসিত পালের লেখা বই। প্রকাশিত হবে ৬ আগস্ট। সন্ধে সাড়ে ৬টা থেকে চারুবাসনায় বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান। একইসঙ্গে প্রকাশিত হবে লেখক অসিত পালের আরও একটি বই, ‘মুক্তকথা’। দু’টি বইয়েরই প্রকাশক কারিগর। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন পার্থ দাশগুপ্ত, তাপস কোনার, শমীন্দ্র ভৌমিক-সহ আরও অনেকে। বইপ্রকাশের পাশাপাশি দেখানো হবে অসিত পালের কাজ ও জীবন নির্ভর একটি তথ্যচিত্রও। অনুষ্ঠানে সূচনা সংগীত গাইবেন দেবশ্রী ভট্টাচার্য।
গ্রন্থাগারে চলচ্চিত্র
‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া-পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত।’ বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ন্যাশনাল লাইব্রেরির বিপুল জ্ঞানজগতের ক্ষেত্রে এ উপমা আরও যথাযথ। কিন্তু সেই নীরবতা আর নিস্তব্ধতার অন্য পিঠেই আলো পড়ল এবার। ফেস্ট ফাইভ এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরির যৌথ উদ্যোগে ন্যাশনাল লাইব্রেরি প্রেক্ষাগৃহেই হয়ে গেল চলতি বছরের ‘ফেস্ট ফাইভ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। ন্যাশনাল লাইব্রেরির ১৮৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনও চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হল গ্রন্থাগার চত্বরে। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও আলোচনা হয়। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন মুনমুন সেন, তনুশ্রী চক্রবর্তী, ড. শিবপ্রসাদ সেনপতি, ড. অজয় প্রতাপ সিং, ড. কল্যাণ রুদ্র এবং রথীন কাঞ্জি।
নবারুণ ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতা
বিষাদের কবি, মৃত্যুচেতনার কবি, রূপসী বাংলার কবি– এহেন বিচিত্র বিশেষণে জীবনানন্দর কবিতাকে যখন ক্রমাগত ঘা মারা হচ্ছে, তার উল্টোদিকে হেঁটে নবারুণ ভট্টাচার্য জীবনানন্দকে বলেছিলেন ‘টিকরমবাজ’, তাঁর কবিতাতেই। বলেছিলেন, দূরপাল্লার দৌড়বিদ ও কবিদের মধ্যে একটা মিল রয়েছে যা নিয়ে কোনও ঝগড়া নেই। খুবই ক্লান্ত হয়ে তারা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তাদের জেতা সব মেডেল চুরি হয়ে যায়। নবারুণ ভট্টাচার্য চিরব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ৯ বছর হতে চলল। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আড্ডালাপ বা লেখালিখির কোনও অভাব নেই। যা নিয়ে কথা কম হয়, তা সম্ভবত নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা। ‘ছোট্ট একহাত মুঠোকরা ন্যাড়ামাথা পোস্টার/ সে বলছে/ অন্ধ আকাশে লক্ষ বিদ্যুৎ/ লক লক করে উঠলেও/ছোট ও নিরীহ গাছেরা ভয় পায় না’। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশকে মনে করলে, এ কবিতা কি আন্দোলনরত পড়ুয়াদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না? এ বছরের নবারুণ ভট্টাচার্য স্মারক বক্তৃতা দেবেন বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী। ‘সংগীত, ভাষা, সংগীতের ভাষা’– এই তাঁর বলার বিষয়। সরোদে থাকবেন ঋক রৌণক। ‘ভাষাবন্ধন’ এবং নবারুণ ভট্টাচার্যের পরিবারের উদ্যোগে আজ, ৩ আগস্ট সন্ধে সাড়ে ৬টায় ১০ লেক টেরেস-এ, বরুণ দে সভাকক্ষে রয়েছে এই অনুষ্ঠান।
রবিপ্রকৃতি
মানুষের ভালো থাকার জন্য পরিবেশের ভালো থাকাও জরুরি। ‘সভ্যতার সংকট’ বলতে তো শুধুই মানব-সংকটকে বোঝায় না। একইভাবে পরিবেশের সংকটের কথাও তাৎপর্যপূর্ণ। গত এক দশকে এই নিয়ে আলোচনা, তর্কবিতর্ক চলছেই। সবুজের অভিযান, কিংবা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা নিয়ে নানা আইনকানুনও হয়েছে, যদিও তা কতটা কার্যকর, চারপাশে তাকালেই স্পষ্ট হয়। একদিনের জন্য ঘটা করে বৃক্ষরোপণ এর সমাধান নয়। সবদিক দিয়ে নিজেদের সচেতন হওয়াটা জরুরি। তার জন্য মানুষের নিজস্ব পরিসরের বাইরে তাকানো একান্ত প্রয়োজন। অবশ্য এই প্রয়োজনের কথা বলে গিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি বলেছিলেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।’ তাঁর বিভিন্ন লেখায় যেভাবে পরিবেশ ভাবনা ধরা পড়েছে, তা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও একইভাবে প্রাসঙ্গিক। বলাই-এর মতো গল্পের মধ্যে দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন ঠাকুর, তা বোঝা যায় এই সময় পৌঁছে। রবীন্দ্রনাথের গানেও বারবার ধরা পড়েছে প্রকৃতিপ্রেম। এছাড়া ‘পল্লী প্রকৃতি’, ‘শহর ও নগর’, ‘অরণ্য দেবতা’-র মতো প্রবন্ধ পরিবেশের প্রতি সচেতন হওয়া কতটা জরুরি, তা বুঝিয়েছে। কবিগুরুর এই পরিবেশ ভাবনা নিয়েই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ রাজ্য কমিটি। ৭ আগস্ট অর্থাৎ কবিগুরুর প্রয়াণ দিবসে বিকেল ৫ টা থেকে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের এন আর সেন প্রেক্ষাগৃহে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ ভাবনা বিষয়ে আলোচনা করবেন অনিতা অগ্নিহোত্রী। উপস্থিত থাকবেন আরও অনেকে।
সহায়তা: রণিতা চট্টোপাধ্যায়, শুভদীপ রায়, সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়, সম্বিত বসু