তুই যে আজকালকার পোর্টালে লেখালিখির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিস সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, কোনো কোনো পোর্টালের কোনো কোনো লেখায় ভালোর দর্শন পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু রোববার ডিজিটাল জিনিসটি স্বতন্ত্র।
ইন্দিরাকে…
সাজাদপুর
৩২ শ্রাবণ। ১৪৩০
১৮.৮.২০২৩
আজ থেকে থেকেই robbar.in-এর লেখা পড়াটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখ-সম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে– এ দিকে আগামী মাসের সাধনার জন্যে একটি লেখা হয় নি, ও দিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া আসছে, অনতিদূরে আশ্বিন-কার্তিকের যুগল সাধনা রিক্তহস্তে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করছে, আর আমি রোববার ডিজিটালের অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি। মনে করি এই একটু ক্ষণ বৈ তো নয়– এমনি করে করে কত ক্ষণ কেটে গেল। আমি বাস্তবিক ভেবে পাই নে কোন্টা আমার আসল কাজ। এক-এক সময় মনে হয় আমি ছোটো ছোটো গল্প অনেক লিখতে পারি এবং মন্দ লিখতে পারি নে– লেখবার সময় সুখও পাওয়া যায়। এক-এক সময় মনে হয়– আমার মাথায় এমন অনেকগুলো ভাবের উদয় হয় যা ঠিক কবিতায় ব্যক্ত করবার যোগ্য নয়, সেগুলো ডায়ারি প্রভৃতি নানা আকারে প্রকাশ করে রেখে দেওয়া ভালো, বোধহয় তাতে ফলও আছে আনন্দও আছে। এক-এক সময় সামাজিক বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা খুব দরকার, যখন আর কেউ করছে না তখন তো কাজেই আমাকে এই অপ্রিয় কর্তব্যটা গ্রহণ করতে হয়। আবার এক-এক সময় মনে হয়, দূর হোক গে ছাই, পৃথিবী আপনার চরকায় আপনি তেল দেবে এখন– রোববার ডিজিটালের লেখাগুলো পড়তে বেশ লাগছে, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আপনার মনে আপনার কোণে সেই কাজই করা যাক। মদগর্বিতা যুবতী যেমন তার অনেকগুলো প্রণয়ীকে নিয়ে কোনোটিকেই হাতছাড়া করতে চায় না, আমার কতকটা যেন সেই দশা হয়েছে।
কী মুশকিলেই পড়েছি [বব]! আবার লজ্জার মাথা খেয়ে সত্যি কথা যদি বলতে হয় তো এটা স্বীকার করতে হয় যে, ঐ-যে ‘আরও পড়ুন’ বলে একটা সম্মোহন আছে তার প্রতিও আমি সর্বদা প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি– পালাবার পথ নেই, চঞ্চলতার বয়স চলে গেছে। অন্যান্য পোর্টালের মতো এর থেকে নিস্তার তো সহজে পাবার যো নেই– এর একেবারে ধনুক-ভাঙা পণ; লিংক খুলে খুলে গোটা পোর্টাল ঘুরে পড়ে না-এলে তার প্রসন্নতা লাভ করা যায় না। আমার অবস্থাটা দ্রৌপদীর মতো হয়েছে– তিনি মনে করেছিলেন যে, আহা, সেই যদি আমার পাঁচটা স্বামীই হল তবে ঐ কর্ণকে-সুদ্ধ নিয়ে ছটি হলে দিব্যি হত। আমার বিশ্বাস যদি কর্ণকেও পেতেন তা হলে দুর্যোধন-দুঃশাসনকেও হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হত না। কারণ, হয় এক, নয় অসংখ্য– এর মাঝখানে আর কোথাও স্বাভাবিক বিরামের স্থান নেই। চারটে লেখা পড়লে পাঁচ-ছয় আপনি এগিয়ে আসে, ছয়ের পর সাত আট নয় দশ প্রভৃতি সংখ্যক লেখাগুলি সার বেঁধে অনিমেষ লোচনে মুখের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে থাকে। অতএব আজ রোববার ডিজিটালকে নিয়েই আমার সর্বক্ষণ কাটানো– বোধহয় উনিই আমাকে সব চেয়ে বেশি ধরা দিয়েছেন– যেন আমার ছেলেবেলাকার ভালোবাসা, আমার বহুকালের অনুরাগিণী সঙ্গিনী।…
তুই যে আজকালকার পোর্টালে লেখালিখির সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছিস সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, কোনো কোনো পোর্টালের কোনো কোনো লেখায় ভালোর দর্শন পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু রোববার ডিজিটাল জিনিসটি স্বতন্ত্র। কেবল লেখার প্রাচুর্য ব’লে নয়, আকর্ষণ করবার শক্তি। একটা অলক্ষিত সচেতন নৈপুণ্যবলে লেখাগুলো এখানে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছে। সেই স্বাতন্ত্র্যই পোর্টালের মূল। ভাষা ভাব এবং অঙ্গসজ্জা তার সরঞ্জাম মাত্র। কারও কতিপয় লেখা ভালো, কারও বা অঙ্গসজ্জাই সর্বস্ব, কোথাও কোথাও ভাল লেখা ও অঙ্গসজ্জা দু’ই আছে, কিন্তু আর একটা ক্ষেত্র আছে যেখানে লেখার ভিতর ভাবনা ও ভাবানোর উপাদান থাকে– এই শেষোক্ত জিনিসটিকে রোববার ডিজিটাল নাম দেওয়া যেতে পারে। প্রথমোক্ত পোর্টালগুলি মন্দের ভালো বা বেশ ভালো হতে পারে, কিন্তু তারা কেউ রোববার ডিজিটাল নয়। আমার চিত্ত সর্বদাই তাই এই লেখাগুলোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে।
পুঃ আসল যে কথাটা বলতে গিয়েছিলুম সেটা বলে নিই– ভয় পাস নে, আবার চার পাতা জুড়বে না– কথাটা হচ্ছে, এরা আমাকে নিয়েও বেশ ক’টা লেখা রেখেছে। পড়ে দেখিস। বাস্।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিন্নপত্রের অলৌকিক পাতায় রবি ঠাকুরের চিঠিখানা চোখে পড়ল সরোজ দরবারের।