চার দেওয়ালের এই ঘর, তার বাইরেও একটা জগৎ আছে। দু’য়ে মিলে তৈরি হয় আমার-আপনার ঘরে-বাইরে। সেই ঘর আর বাইরের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে দেয় জানলা। বাইরেকে দেখার মধ্যে দিয়েই ঘরের মধ্যে তৈরি হয় আরও অনেক অদৃশ্য জানলা। সেই জানলার মালিক আমাদের মন। সেই জানলায় এসে দাঁড়ালে সময় থমকে দাঁড়ায়। বয়সের গাছপাথর বাড়ে না। তখন অতীত ছুঁয়ে বর্তমানে নিত্য অভিসার। থাকে কিছু মনখারাপের পিছুটান, আর ভালোলাগার আলগা শ্রী। জানলা আমাদের সেই খাপছাড়া জীবনের লাইভ টেলিকাস্ট।
১.
আদরে কুঁকড়ে যাওয়া সুতির জামার মতো নদী, এত কৌতূহল যে, খাদে ঝাঁপ দিয়ে, হয়ে ওঠে জলপ্রপাত, তার আবহ-নাদ-শীৎকার-গর্জনের তরঙ্গ রটিয়েছে হাওয়ায়, আজ নাকি নক্ষত্র পুঞ্জে জমাটি চড়ুইভাতি!
এই যে আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না, আমিও বুঝতে পারিনি। এই ধরুন– চাঁদ। চাঁদে নাকি যে কোনও জিনিসই পৃথিবীর তুলনায় অনেকটাই হালকা। মানে ২৩ বার লাফালেই মোটামুটি ধরুন, শ্যামবাজার থেকে আর জি কর পৌঁছে যাওয়া যাবে। কিন্তু চাঁদের কলঙ্কের যে বোঝা, এ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের তুলনায় বেশ ভারী। আবার ফুটবে ফুল তাই এত ভ্রমরের ওড়াউড়ি। আপনি সুযোগ পেলে হালকা হতে চাঁদে যাবেন কি না, এ ব্যাপারে আমি সত্যিই কিছু বলতে পারব না। কবিতা লিখবে হাওয়ায়, গান বাঁধা হবে কালি ছিটিয়ে ছিটিয়ে, চেলো বাজলে হরিণ সতর্ক হবে, পিয়ানোর সঙ্গে হরিণ দৌড়ে পালিয়ে যাবে আজীবন তোমার অপেক্ষায়, এমনকী নিজেকেও না জানিয়ে পরম গোপনে লুকনো থাকবে প্রেম। মৃত্যুর ঠিক আগে একদম শেষ কয়েকটা মুহূর্তে সে তোমাকেই একবার দেখতে চাইবে, কিন্তু মুখে বলবে– জল জল জল, একটু জল দেবে…
২.
ব্রো, তুমি জানো না জীবন ভীষণ ক্রেজি জিনিস! আমরা দিনের বেলা ছাতুর শরবত খেয়ে কাজে বেরই অনেকক্ষণ পেট ভর্তি থাকে, তারপর দুপুরে ভিরমি খাই, সন্ধের দিকে নাকানিচোবানি আর রাতে কাতুকুতু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। মিল সিস্টেম। হাতের বাইরে চলে যাওয়া একমাত্র ছেলেরা মিলে একটা জয়েন্ট বানিয়েছি। খাব। এই সিঙ্গেল মল্টের জামানায় আমি আপনাকে একটা বিড়ি খাওয়াতে পারি। একটা সময়ের পর কাঁচা জল খেলে গলায় লাগে, তাই জলটা একটু পাতলা করে গুলে এক ঢোঁকে মেরে দেবেন। দেখুন পৃথিবীর তিন ভাগ জল, আপনার শরীরেও তিন ভাগ জল আছে। আমারও। এই যে মেন্টেনেন্সের একটা খরচ আছে, আপনি এক কাজ করুন, দুটো কুড়ি কিলোর বস্তায় যতটা করে পারবেন টাকা, বেশ উপচে পড়ছে এরকম টাকা ভর্তি দুটো বস্তা আমাকে দিয়ে যাবেন। হাওয়ায় দু’-একটা নোট উড়ে খসে পড়ে রাস্তায় পড়ুক, তাতে অসুবিধে নেই। আমি টাকা চাইছি অন্য কোনও কারণে নয়। এমনিই, ওই খাটের তলায় রেখে দিলাম। ‘খাটের তলা’ ব্যাপারটা বেশ ট্রেন্ডিং। আপনি ভাবছেন বস্তায় কেন? দেখুন, সে এক সময় ছিল যখন মানুষ– শ, হাজার, লাখ, কোটিতে টাকা গুনত। এখন পৃথিবী এগিয়েছে, পৃথিবীতে মানুষ অন্যান্য প্রাণী ধ্বংসফংস করে একদম ৩০ তলার ব্যালকনিতে লুকোচুরি খেলছে। আগে মানুষ শিকার করে খেত, তারপর ছিনিয়ে নিয়ে খেত, তারপর চেয়ে খেত… এখন ডেলিভারি বয় এসে দিয়ে যায়। মানিব্যাগে সব হাতড়ালে ৪০-৫০ খুচরো বেরবে ম্যাক্সিমাম। কিন্তু আপনি ভাবুন, খাটের তলায় হাতড়ালেন আর নটে-কলমি পালং-এর মতো ক্ষমতার দাপটে টাকার চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করলাম খাটের তলা থেকে! এলাহি ব্যাপার! একটা গাম্ভীর্য আছে।
সেই গাম্ভীর্য নিয়ে রাতে জঞ্জালের প্যাকেট ফেলতে গিয়ে দেখি, একটা পাগল ডাস্টবিন থেকেই কুড়িয়ে কুড়িয়ে এঁটো খাচ্ছে! বাবলুদারা সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, বাড়িতে বয়স্ক লোকজন থাকে, মে বি। ওদের জঞ্জালটা পাগলটা খাচ্ছে, কুকুর খাচ্ছে, বিড়াল খাচ্ছে…
জীবন, তুমি কিছুই জানো না, ব্রো ভীষণ ক্রেজি জিনিস।
৩.
লোডশেডিং-এর দিন একটা আদিম ছোটবেলা হাওয়া খেতে বেরিয়েছে পাড়ায়। তখন আলো আসত। এখন আলো এখানেই থাকে। ছড়িয়ে থাকে এমনভাবে, ছাই বোঝাও যায় না ওটা আদৌ আলো না এলোমেলো। এত আলোতে ভালো দেখতে পাওয়া যায় বলে মনে হয় না। তবুও যখন আপনি বলছেন এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করো, তাহলে তিনি না হয় আপনার কথামতো এ বিষয়ে আলোকপাত করলাম। তাতে কী হল? ব্যাঙের মাথা হল। ব্যাঙের ছাতা হল। ছাতার বাঁট হল। বাঁটের দুধ হল। দুধ থেকে ঘি, মাখন, পনির, ছানার জিলিপি, নানারকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হল। বিভ্রান্তির উচ্চতম শৃঙ্গের নাম ইতস্তত। বিভ্রান্তির গভীরতম সমুদ্রের নাম সন্দেহ। আমি আগেই বলেছিলাম। মিলল?
ইতিহাস আমাদের ধ্বংসাবশেষ পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে ঝিনুকগুলো ফিরিয়ে দিলাম। কাটখোট্টার রং-পেনসিল ক্ষয়ে যাওয়ার ভয়ে একে অপরের পিছনে লুকোচ্ছে। ভরা বর্ষার জঙ্গলের গন্ধ খুঁজে পেয়েছে ঝুলবারান্দার কার্নিশের শ্যাওলা ধরা আঁতুর ঘর। চৌবাচ্চায় পাম্পের জল এল, হাবুডুবুর শব্দটা, একটা পায়রা ভাতঘুম গিলে গিলে ডাকছে। তুমিই তো এসব মন ভাঙার খেলা শিখিয়ে ছিলে। মোমবাতির গায়ে গলে যাওয়ার তারিখ লেখা বুক পকেটে একটা লোডশেডিং নিয়ে একটা আদিম ছোটবেলা হাতড়াচ্ছে। আপেল কেন ধপাস করে পড়ল, আর পালক কেন ফুঁ মেরে ব্রহ্মাণ্ড কন্ট্রোল ম্যাক্স প্রো অস্ত্র হয়ে উঠল। তুমি এখন হিরো, তুমিই নাকি ব্র্যান্ড। তুমিই ব্রহ্মাণ্ড। এখানেই শেষ নয়, তা নিয়ে আবার ছ’পাতা অঙ্ক! এমন অঙ্ক, যা পাতা উল্টে না দেখলে মেলানোই যাবে না।
অঙ্কটা পারলাম না, এটা ঠিক, কিন্তু সব এলাকায় সব সময় মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না।
আজ আমাদের ব্যান্ড পার্টি। আউট অফ কন্ট্রোল মোচ্ছব। সাপ-লুডো নাচ। বেপরোয়া দিল দিওয়ানা নেশায় ফ্লুয়েন্ট ইংরেজি। ঝিকমিক আয়না লাগানো বল, আলো ঠিকরোচ্ছে। তুমি প্রেমিক না পাথর– সত্যি করে বলো? চোখের দিকে তাকাও, তুমি যদি ভালো না বেসে থাকো, তুমি চুমু খেলে কেন? কেন? কেন?
উনি বয়স্ক মানুষ, বাড়ি থেকে খুব একটা আর বেরতে পারেন না। এসব প্রশ্নের উত্তর উনি দেবেন বলে মনেও হয় না। তাই উনি বারান্দায় নিজেকে একটু মেলে রেখেছেন। উল্টোডাঙার রাস্তায় মোচ্ছব অথবা ঘরের টিভিটা যে ওঁর কেউ হয় না, এটা আর কেউ জানে না। একদিন যেদিকে দু’চোখ যাবে এসব ফেলে উনি চলে যাবেন। তাহলে এত মায়া, এত পিছুটান, এসবের কী হবে? আসলে তোমাকে শেখানো হয়েছে বিচ্ছেদে গভীর শোক জন্মায়। তাই তুমি প্র্যাকটিস করছ, এতদিন ধরে। একদিন আর এসব হবে না, দেখো। আমাদের ব্যান্ড পার্টি হবে না, আউট অফ কন্ট্রোল মোচ্ছব হবে না, সাপটা লুডোর ছক্কা-পাঞ্জা-পুট সব খেয়ে ফেলবে। নেশায় ভেতো বাঙালির ইংরেজি বেরনো বন্ধ হয়ে যাবে, ঝিকমিক আয়না লাগানো আলো ঠিকরোনো বলটা পশ্চিম দিকে অস্ত যাবে। পাথর ক্ষয়ে যাবে, তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবে তোমার প্রেমিক। সেদিন তুমি বুঝবে প্রেমিকের চুমু অথবা ভালবাসার প্রয়োজন ফুরিয়েছে তোমার। এবার তুমি হয় নিজেকে বারান্দায় মেলে রাখবে, না হলে যেদিকে দু’চোখ যায়, সব ফেলে ঠিক চলে যাবে।
৫.
বস্তাপচা স্কন্ধকাটা তালমিছরির ডাল
পদ্য লেখা হদ্দবোকা নিধিরামের ঢাল
গর্তগুলো দন্ত ইকিরমিকিড় কী উত্তাল
মাছগুলো সব পালিয়ে গেছে, পড়ছে জলে জাল।
চিমটি কেটে দেখছি কেন কামরাঙাটা টক
জাহাজ সে আর কোথায় এত পানসি ভরা ডক
আগেই গেছি বুঝে এসব ফাঁদে ফেলার ছক
ওষুধ আছে একটা শক ট্রিটমেন্ট। শক।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..