দেশের এক নেতা কিছুদিন আগে দাবি করেন তিনি জৈবিকভাবে জন্মাননি। সেটা দেখে মহেশ্বরবাবু আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দেন তিনিও জৈবিকভাবে জন্মাননি, ঢিল থেকে তাঁর জন্ম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই পোস্ট করা মাত্র ওঁর বড় মেয়ের কাছে নোটিফিকেশন যায়, আর সে তৎক্ষণাৎ এসে বাবার কাছ থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পোস্টটা ডিলিট করে আর ঈশানী দেব্যাকে জানায়। মনঃক্ষুণ্ণ মহেশ্বরবাবু আবার একপ্রস্ত ঝাড় খেয়ে ভাবতে বসেন যে, তিনি অন্যায় কী করেছেন– ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছেন তাঁর বড় দিদি নাকি ভাই চেয়ে ধর্মরাজতলায় ঢিল বেঁধেছিলেন আর সেই কারণেই তাঁর জন্ম।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
বর্তমান
মহেশ্বরবাবু রবিবার সকালে প্রতি সপ্তাহের মতো গেঞ্জি-কাপড়ের একটা হাফপ্যান্ট পরে নগ্নগাত্রে বিছানায় বসে দুলছিলেন। ইদানীং আর গামছা পরে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করেছেন মেয়েদের প্রবল প্রতিবাদে– তারাই এই হাফপ্যান্ট কিনে এনে দিয়েছে। মিথ্যে বললে পাপ হবে– এই হাফপ্যান্টটা বেশ হয়েছে, বেশ হাওয়া-বাতাস ঢোকে এদিক-সেদিক দিয়ে। মহেশ্বর ভাবছিলেন তাঁর ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল বোধহয়– চমকে উঠলেন ঈশানী দেব্যার তীব্র কণ্ঠে, ‘আবার বসে বসে ঝিমচ্ছো! যাও নিচের দোকান থেকে গরমমশলার দুটো প্যাকেট নিয়ে এসো!’ ধড়মড়িয়ে উঠে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছেন, কানে এলো ছুটকির আর্তনাদ– ‘পেছন ফাটা প্যান্ট পড়ে তুমি রাস্তার দোকানে যাচ্ছ! মা, তুমি দেখেছ!’ মহেশ্বরবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘তাই জন্যেই বোধহয় হাওয়া বেশি খেলছে! বুঝতে পারিনি!’ ঈশানী দেব্যার কথা কানে গেল, ‘তাহলেই দ্যাখ কী লোককে নিয়ে সারাজীবন ঘর করলাম! ছুটকি, তুই চট করে এনে দে তো নিচ থেকে!’ সেখানে না-থেমে ঈশানী দেব্যা বলে চললেন, ‘মহাদেবের নাম থেকে নামকরণ যখন, স্থাণু নাম রাখতে পারতেন তো মা– নামের সাথে স্বভাব মিলিয়ে!’
ঈশানী দেব্যা আজকে ভারি ব্যস্ত– তাঁর মাতৃদেবী জামাইষষ্টির উপলক্ষে প্রত্যেক বছর জামাইকে চর্ব্যচোষ্য খাওয়ান। এই বছর সেটা হয়নি, মহেশ্বরবাবু তাঁর শাশুড়িকে মনে করিয়ে দেওয়াতে তিনি তাঁর কন্যাকে অবিলম্বে ব্যবস্থা করতে বলেছেন। মাতৃ-আজ্ঞা পালন করে ঈশানী দেব্যা সকাল থেকে রান্নাঘরে– আর মাঝেমাঝেই নিজের কপালকে গালমন্দ করছেন, তাই কথা না বাড়িয়ে মহেশ্বরবাবু আবার বিছানায় নিজের জায়গায় এসে বসে এই মানবজন্মের কথা ভাবতে বসলেন।
শুরুর কথা
দেশের এক নেতা কিছুদিন আগে দাবি করেন তিনি জৈবিকভাবে জন্মাননি। সেটা দেখে মহেশ্বরবাবু আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ফেসবুকে পোস্ট করে দেন তিনিও জৈবিকভাবে জন্মাননি, ঢিল থেকে তাঁর জন্ম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই পোস্ট করা মাত্র ওঁর বড় মেয়ের কাছে নোটিফিকেশন যায়, আর সে তৎক্ষণাৎ এসে বাবার কাছ থেকে ফোন ছিনিয়ে নিয়ে পোস্টটা ডিলিট করে আর ঈশানী দেব্যাকে জানায়। মনঃক্ষুণ্ণ মহেশ্বরবাবু আবার একপ্রস্ত ঝাড় খেয়ে ভাবতে বসেন যে, তিনি অন্যায় কী করেছেন– ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছেন তাঁর বড় দিদি নাকি ভাই চেয়ে ধর্মরাজতলায় ঢিল বেঁধেছিলেন আর সেই কারণেই তাঁর জন্ম। এ-ও শুনেছেন তাঁর মাতৃদেবী সিদ্ধেশ্বরী ঈষৎ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন এটা জেনে, কারণ বিষ্ণুপ্রিয়ার বংশে জন্মে তাঁর চৈতন্য আর কৃষ্ণের ওপর জন্ম থেকে ভক্তি– শিবের ওপর খুব একটা ভরসা কোনওদিন ছিল না তাঁর। তবু একটা ‘আশায় মরে চাষা’ গোছের ব্যাপার ছিল, সেই আশার মৃত্যু হল যেদিন তাঁর মামী-শাশুড়ি পাহাড় থেকে বাঘছাল পড়ে একজনকে নেমে আসতে দেখে ঘোষণা করেন যে, তিনি আসছেন, এইবার পুত্রসন্তান হবে। সিদ্ধেশ্বরী ক্ষীণকণ্ঠে যখন সন্দেহ প্রকাশ করেন আর বলেন– ওটা গামছা ছিল, মামী-শাশুড়ি গম্ভীর হয়ে জানান যে, পাহাড়ে লোকে গামছা পরে ঘুরে বেড়ায় না; তার পরে নিদান দেন শিবঠাকুরের নামে নাম রাখতে হবে আর প্রস্তাব দিলেন– দিগম্বর!
কৃষ্ণভক্ত সিদ্ধেশ্বরী বিষ্ণুবল্লভ নাম রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এটা যে শিবের আরেক নাম সেটা অনেকেই জানে না। অবশেষে মহেশ্বর নাম নিয়ে তিনি ধরাধামে এলেন। পরবর্তীকালে কৈশোরে শরদিন্দুর লেখা পড়ে মহেশ্বরবাবু কখনও ব্যোমকেশ হতে চেয়েছেন, প্রথম যৌবনে মহেশ্বরবাবু কৃত্তিবাসী কবিদের জীবনদর্শনে আকৃষ্ট হয়ে নাম বদলে কৃত্তিবাসা হতে চেয়েছেন– কিন্তু সিদ্ধেশ্বরী মনে করিয়ে দিয়েছেন জীবনের প্রথম প্রোগ্রেস রিপোর্টে লেখা ছিল ‘বসিয়া থাকিতে ভালোবাসে’– তাই নাম বদলালে স্থাণু নাম রাখতে হবে। অগত্যা তিনি মহেশ্বরেই থিতু হয়েছেন। আজকে ঈশানী দেবী এই নামটা বলতে চমকে উঠেছিলেন ভেবে আপন মনে একটু হেসে নিলেন।
…………………………………………………………………………
তখন মহেশ্বরবাবু এক মফঃস্বল শহরে পোস্টেড– স্টেশনের অদূরে এক বাড়ির তিনতলা ভাড়া নিলেন থাকার জন্যে। সেই মহল্লায় তিনতলা বাড়ি প্রায় ছিল না বললেই চলে, তাই সেখান থেকে শহরটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। বাড়ির সামনেই একটা ছোট শিব মন্দির ছিল। ব্যাঙ্কের দেওয়া টার্গেটে হাঁপিয়ে গেলে তিনি হুইস্কি আর মাংসের ব্যবস্থা করে ছেলেদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিতেন– সেই টঙের ওপরে ছাদে রাতের অন্ধকারে সবাই মিলে হইচই করে কাজের ক্লান্তি দূর করে ফ্রেশ হয়ে যেত। পরে জানতে পেরেছিলেন, ব্যাঙ্কের সহকর্মীরা তাঁর টঙের ওপরের বাসাকে নাম দিয়েছিলো কৈলাস।
…………………………………………………………………………
মাঝের কথা ১
জন্মের আগে থেকেই শিবঠাকুর ঢিলের মধ্যে দিয়ে মহেশ্বরবাবুর ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকে গিয়েছেন। ছোটবেলায় খিদে পেলে বুঝতে পারতেন না, রেগে যেতেন। রাগ দেখলেই খেতে দিয়ে দেওয়া হত– শিবঠাকুরও নাকি খিদে পেলে বুঝতে পারেন না– এ তো সাংঘাতিক মিল! সময়ের সঙ্গে শিব এমনভাবে মহেশ্বরের মধ্যে মিশে গেলেন যে যাই হয়, শিব মহেশ্বরের ঢাল হিসেবে তৈরি থাকেন– উনি চান বা না চান। কিশোর বয়সে সব ছেলেমেয়েদেরই পাড়ায় বন্ধুবান্ধব হয়, তাদের একটা জগৎ তৈরি হয়– মহেশ্বরবাবুর ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ক্লাস নাইন-টেনে এই আড্ডা বিস্তৃত হয়েছিল যথাসময়ে, আর বন্ধু-বান্ধবরা ছিল সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। মহেশ্বরের ক্ষেত্রে বন্ধুরা ছিল বয়েস নির্বিশেষে। সিদ্ধেশ্বরী ছেলের সঙ্গে কোথাও যেতে চাইতেন না, কারণ রাস্তায় মহেশ্বরের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বন্ধুদের দেখা হয়ে যেত– সবার সঙ্গে খানিক কথা বলে দশ মিনিটের পথ পার করতে এক ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। মহেশ্বরবাবুর মা এই নিয়ে অনুযোগ করলে তাঁর ঠাকুরমা রক্ষা করতে তৈরি থাকতেন, ‘শিবের দোর ধরে হয়েছে, শিবের মতো চেলা-চামুণ্ডাই তো থাকবে চারপাশে; ও আর কী করবে!’
কলেজে পৌঁছে নেশার জগতের সঙ্গে যখন পরিচয় হল, কোনও হোঁচট না খেয়েই সেই পথে এগিয়ে চললেন। ছেলের ব্যবহারে আর স্বভাবে বিপুল পরিবর্তন দেখে সিদ্ধেশ্বরী মহেশ্বরের কলেজতুতো দাদা, তাঁর বিশ্বস্ত শিমুলকে অনুরোধ করলেন মহেশ্বরের দিকে নজর রাখতে আর তাঁর পাশে থাকতে। মহেশ্বরের সঙ্গে বার কয়েক শ্মশানে আর মর্গে ঘুরে রণে ভঙ্গ দিয়ে শিমুল যখন বিস্তারিতভাবে সিদ্ধেশ্বরীকে জানাল, তিনি সখেদে বলেছিলেন ‘শ্মশান আর গাজার সঙ্গে ওর জন্মলগ্ন থেকে সম্পর্ক ওর দিদির এক কাণ্ডের জন্যে– ওকে আর কী দোষ দেব!’
মাঝের কথা ২
হঠাৎ চাকরি জীবনের এক ঘটনা মনে পড়তে আপন মনে হাসলেন। তখন মহেশ্বরবাবু এক মফঃস্বল শহরে পোস্টেড– স্টেশনের অদূরে এক বাড়ির তিনতলা ভাড়া নিলেন থাকার জন্যে। সেই মহল্লায় তিনতলা বাড়ি প্রায় ছিল না বললেই চলে, তাই সেখান থেকে শহরটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। বাড়ির সামনেই একটা ছোট শিব মন্দির ছিল। ব্যাঙ্কের দেওয়া টার্গেটে হাঁপিয়ে গেলে তিনি হুইস্কি আর মাংসের ব্যবস্থা করে ছেলেদের ফ্ল্যাটে ডেকে নিতেন– সেই টঙের ওপরে ছাদে রাতের অন্ধকারে সবাই মিলে হইচই করে কাজের ক্লান্তি দূর করে ফ্রেশ হয়ে যেত। পরে জানতে পেরেছিলেন, ব্যাঙ্কের সহকর্মীরা তাঁর টঙের ওপরের বাসাকে নাম দিয়েছিল কৈলাস। মহল্লার কিছু বয়স্ক মানুষ ব্যাঙ্কে গিয়ে এই নিয়ে অনুযোগ জানালে রাজকুমার ওদের নাকি বলেছিল, ‘কি সর্বনাশ! আপনাদের বাড়ির সামনে শিবের মন্দির আর আপনারা নালিশ করছেন! জানেন স্যর শিবের অংশ?’ বলে এক সহকর্মীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে ‘স্যর কোথায় থাকেন?’ উত্তর আসে, ‘কৈলাস’। এই শুনে সেই মানুষগুলো কি বুঝেছিল জানি না, কিন্তু রাস্তায় মহেশ্বরবাবুকে দেখলেই হাতজোড় করে প্রণাম করতো। এই ঘটনা উনি জেনেছিলেন অনেক পরে। এর আগে ছোট মেয়েকে একদিন আদর করে লক্ষ্মী মেয়ে বলতে সে প্রতিবাদ করে বলেছিল, সে লক্ষ্মী মেয়ে নয়, সে সরস্বতী মেয়ে আর তার দিদি লক্ষ্মী মেয়ে। অবাক হয়ে মহেশ্বরবাবু যখন জিজ্ঞাসা করেন কোথা থেকে এই সব শুনেছে, জানতে পারেন তাঁর অফিসে বেড়াতে গিয়ে শিখে এসেছে।
………………………………………………………………
আরও পড়ুন সুপ্রতিম কর্মকার-এর লেখা: নদী-পুকুর-জলাশয়ের পাশেই কেন থাকে শিবের মন্দির কিংবা থান?
………………………………………………………………
বর্তমান ২
বেশ বসে বসে অতীতে বিচরণ করছিলেন, হঠাৎ কানে এলো ঈশানী দেব্যার গলা– ‘অনেকক্ষণ কোনও আওয়াজ নেই– দেখ্ গিয়ে তোদের বাবা হয় ঘুমোচ্ছে, নয় লুকিয়ে লুকিয়ে সাতসকালেই বোতল খুলেছে!’ মহেশ্বরবাবু আবার বসে বসে খানিক দুলে ভাবতে বসলেন ঈশানী দেব্যা এতো এনার্জি পায় কোথায় থেকে! বাড়ির রান্নার তদারকি, মেয়েদের পড়াশোনার দিকে নজর রাখা, বাড়ির আর আত্মীয়স্বজনের বাড়ির পুজো বা অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নেওয়া, কলেজের খাতা আর ওয়েব সিরিজ দুটোই সমান তালে দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, তাঁর ওপর নজরদারি সব কি করে একসঙ্গে ম্যানেজ করে– ওর কি দশটা হাত আছে সত্যিই! তাঁর প্রতি ভয়ে আর ভক্তিতে অন্যমনস্ক হয়ে মহেশ্বরবাবু আরেকবার ইন্হেলার নিয়ে ভাবলেন, ইন্হেলারের সিলিন্ডারের মধ্যে কন্ডেন্সড্ গাঁজার ধোঁয়া থাকলে বেশ হত। হঠাৎ মনে পড়ল, কালকে শ্রাবণের সোমবার– শ্যালক টোকনের কাছে শোনা একটা গানের লাইন মনে পড়তে হেসে ফেললেন– ‘কুমারীরা বলে বাবা তোমায় ভালবাসি, সেই ভালোবাসার চোটে বাবার হল সর্দি-কাশি’। একটু ভয় লাগল এই ভেবে যে কালকে আবার একটা গোলমাল লাগবে।
ঈশানী দেব্যার শাসনব্যবস্থায় সবাইকে শুতে যাওয়ার আগে গা ধুতে হয়। আগের সোমবার রাতে স্নান না করে বিছানায় শুয়ে পরেছিলেন। ঈশানী দেব্যা আপত্তি জানাতে উনি অনুযোগ করেছিলেন যে, সারাদিন ধরে তাঁকে স্নান করতে হয়েছে তাই শীত করছে। এমন কথায় হাসি চেপে ঈশানী বলেছিলেন, ‘মাথায় তো জল ঢালেনি! যাও স্নান করে এসো!’ মহেশ্বরবাবু উত্তর দিয়েছিলেন, ‘যেখানে জল দেয়, সেটাও তো শরীরের এক অঙ্গ!’
(বিঃদ্রঃ ঢিল, ইনহেলার আর গাঁজার ধোঁয়া ছাড়া এই লেখার আর সব কিছু কাল্পনিক)
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাজের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..