একটা মৌচাকে ৬০ হাজার মৌমাছি বাস করতে পারে! ডাকুন তো দেশের সেরা আর্কিটেক্টকে, বানিয়ে দিক একখানা বহুতল, ৬০ হাজার বাসিন্দার জন্য। অত সোজা না! মৌচাকের কুঠরিগুলো ছয়কোনা। স্কেল-কম্পাস ছাড়া পারবেন একটা নিখুঁত ষড়ভুজ আঁকতে? খালি হাতে অমন ছ’-কোনা খোপ বানানোও আপনার কম্মো না, তা বিলক্ষণ জানি। প্রকৃতিতে সবচেয়ে মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো হচ্ছে এই ছ-কোনা কাঠামো। সবচেয়ে কম মালমশলা লাগে এই ছ-কোনা ঘর বানাতে। তাই সবচেয়ে হালকা এবং সবচেয়ে বেশি আলো হাওয়া। গালভরা বিশেষণে ‘মোস্ট এনার্জি এফিশিয়েন্ট’। আরও শুনুন। নানাদিক থেকে মৌমাছিরা ঘর বানাতে বানাতে যখন এসে এক জায়গায় মেশে, সেই সংযোগের জায়গাটিও নিখুঁতভাবে ছ-কোনাই হয়। খুব দরকার পড়লে পাঁচ বা সাত কোণা। আগে থেকে মাস্টারপ্ল্যান বনিয়ে, ফিতে ফেলে মেপেজুকে তো আর মৌচাক গড়তে শুরু করে না মৌমাছিরা!
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
এই ক’দিন আগে সাতসকালে শুনলাম দিল্লি এয়ারপোর্টের একটা নতুন ছাদ ভেঙে পড়েছে। দিল্লিতে নাকি তুমুল বৃষ্টি! আরে বাপু, চিরকাল শুনে এসেছি, বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে গরিবের গোয়াল, চালা ঘর, নোনা ধরা ইশকুলবাড়ি কিংবা আদ্যিকালের হেলে পড়া পাঁচিল। তাই বলে এয়ারপোর্ট! দেশের গুমোর করার আর তবে রইলটা কী! আবার দু’দিন না যেতে শুনি, অযোধ্যার রাম মন্দিরের মাথা থেকে নাকি চুঁইয়ে জল ঢুকছে গর্ভগৃহে, টপটপিয়ে পড়ছে রামের মাথায়। লে হালুয়া! এত ঘটা করে, লড়ালড়ি করে, পাবলিকের সেকুলার ট্যাক্সের পয়সার শ্রাদ্ধ করে মন্দির হলো, তার মাথায় কিনা ফুটো! সীতা মাইয়া কি এখন লক্ষ্মণভাইরে কইব, ‘সাতা ধরো হে দেওরা…’? একটা কথা আমার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না, ঠাকুর-দেবতাদের এত ঘরবাড়ি কীসে লাগে! তাদের সত্যি-ই কি এত রিয়েল এস্টেট-প্রেম! যাকগে। থাক ওসব কথা। অন্তর্যামী আবার খ্যাক্ খ্যাক্ করে হাসতে শুরু করবেন।
এ তো শুধু আজ নয়, যুগযুগান্তরের গল্প। রাজা-বাদশাদের শখে গড়ে ওঠে স্থাপত্য নিদর্শন। কখনও ধর্মের মোড়কে, কখনো বা নিজেদের নাম অমর করতে। বহু যুগ আগের সেসব স্থাপত্য সময়ের চোখরাঙানি পেরিয়ে টিকেও আছে দিব্যি। খাজুরাহো থেকে কোনারক, তাজমহল থেকে মহাবলিপুরম, অজন্তা, ইলোরা। আহা! ভাগ্যিস তাদের দুচোখ জুড়ে ছিল সৌন্দর্যের মায়া কাজল! একফোঁটা সিমেন্ট বালি না খরচ করে কেবল খাপে খাপ পাথর বসিয়েও কীভাবে গড়ে ফেলা যায় আকাশচুম্বী স্থাপত্য, তা জানত আমাদের পূর্বসূরিরা। এসব আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু সে ঐতিহ্য আর বইতে পারছি কই! আমরা তো ‘স্কোয়্যার ফুট’ প্রজন্মের মানুষ। বি-এইচ-কে’র বাসিন্দা। স্থাপত্যশৈলীর বাহার নেই, নেই নান্দনিক বৈচিত্র, তাই বুঝি নাম তার ফ্ল্যাট, মানে ‘গোদা’। এখন তো রিয়েল এস্টেট আকাশে বাড়ে। ভার্টিকাল স্পেস। বনজঙ্গল নালা-জলা সব সাবাড় করে এখন আর উপায় কী এ ছাড়া! ঠেকায় পড়ে আর্কিটেকচার নিয়ে বেশ নতুন নতুন ভাবনা চিন্তা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে আজকাল। তবে যাই বলুন, জীবকুলে আর্কিটেকচারের ‘গুরুদেব’ বলতে যদি কেউ থেকে থাকে সে হল মৌমাছি। ঠিকই শুনছেন, আমি মৌচাকের কথা বলছি। গাছের ডাল থেকে ঝুলতে থাকা মৌচাক। শ’য়ে শ’য়ে মৌমাছি ভন ভন করছে তাকে ঘিরে। কোনও দিন দেখেছেন ঝড়ে মৌচাক খসে পড়েছে? আইলা-আম্ফানও পারেনি ওদের ঘর ভাঙতে। শুধু আর্কিটেকচারের কেরামতি না, ওদের নিজস্ব স্থাপত্য-ঘরানার প্রতি পরের প্রজন্মের দায়বদ্ধতা এবং সেই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার যে চেষ্টা, তা যদি মৌমাছিদের কাছ থেকে মানুষ শিখে নিতে পারত, বড় ভাল হত। দাঁড়ান একটু খোলসা করে বলি।
বেলজিয়ামের বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ভিভিয়ান ডি পিয়েত্রো এবং কে লিউভেন ব্রাজিলে চারশোর বেশি মৌমাছি কলোনির ওপর দু’বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে সম্প্রতি তাদের উপলব্ধি সামনে এনেছেন ‘কারেন্ট বায়োলজি’ জার্নালে। ওঁদের গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল মৌচাকের গঠনশৈলী এবং তার ঐতিহ্যের বহমানতা। গবেষণা বলছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ মৌচাকই ‘ওয়েডিং কেক’-এর মতো স্তরে স্তরে গড়া। বাকি মাত্র ৫ শতাংশ মৌচাকের গড়ন প্যাঁচানো বা স্পাইর্যাল। স্পাইর্যালিং করেও যে মৌচাকের কুঠরি গড়া যায়, এটাই গবেষকদের অবাক করেছে। শ্রমিক মৌমাছিরা দুই ঘরানাই বয়ে নিয়ে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। গবেষকদের ভিডিওতে ধরা পড়েছে, দু’-ধরনের মৌচাকেই কুঠরি তৈরি করার সময় এবং কাজের গতি প্রায় একই। শ্রমিকদের দক্ষতা-জনিত কোন বাড়তি সুবিধার বিষয়ও চোখে পড়েনি। এবার গবেষকদের মনে প্রশ্ন এলো, আচ্ছা, স্তরে স্তরে মৌচাক গড়ার কারিগররা প্যাঁচানো মৌচাক গড়তে পারে কি? সোজা কথা ওদের শ্রমিকদের মধ্যে কোনও স্পেশালাইজেশন আছে কি? যাচাই করে দেখা যাক। প্যাঁচানো মৌচাক থেকে শ্রমিকদের বের করে দিয়ে সেখানে স্তর মৌচাকের শ্রমিকদের ঢুকিয়ে দিতে দেখা গেল, তারা দিব্যি প্যাঁচানো কুঠরি বানাতে শুরু করে দিল। অর্থাৎ চট করে তারা স্টাইল বদলে ফেলল। এবার গবেষকদের ধারনা বদ্ধমূল হল, পূর্বসূরিদের ছেড়ে যাওয়া নির্মাণকাজের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরবর্তী প্রজন্মের মৌমাছিরা অবলীলায় নিজেদের অভ্যস্থ নির্মাণশৈলী থেকে অন্য পদ্ধতিতে সরে যায়। অর্থাৎ মৌমাছির নির্মানশৈলী কোনও জিনগত প্রক্রিয়া নয়। এ তাদের সামাজিক শিক্ষা, যাকে বলে ‘সোশ্যাল লার্নিং’। এই পুঁচকে পতঙ্গটির সমাজে নিশ্চয়ই আর্কিটেকচার কলেজ নেই। এ শিক্ষা তার সহজাত। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলে ঐতিহ্যের ধারা।
ড. টম ওয়েন্সেলিয়ার ব্যাপারটাকে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর মতে, মৌমাছিদের এটা একটা কালচার, সংস্কৃতি। যে কোনও অসমাপ্ত নির্মাণকাজ সবাইকে সম্পূর্ণ করতে জানতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একজনের কাজ অন্যজনকে প্রভাবিত করবে, অনুপ্রাণিত করবে নতুন ধারা রপ্ত করে নিতে। যেন একটা যৌথ জ্ঞানভাণ্ডার। সবাইকে তার ভাগীদার হতে হবে টিকে থাকার স্বার্থেই। ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট অ্যান্ড্রুজের জীববিজ্ঞানী ড. হুইটেন বলছেন, একশো বছর আগে অবধি মনে করা হত ‘কালচার’ শব্দটা কেবল মানুষের ক্ষেত্রেই খাটে। ভাবা হত, মানুষের মধ্যেই কেবল যৌথ শিক্ষার কালচার বা সামাজিক শিক্ষার ধারা ছিল। এখন তো দেখা যাচ্ছে, সে কালচার মৌমাছি সমাজে অনেক আগে থেকেই ছিল। আর সেটা অস্বাভাবিকও না। অন্তত হারারির ‘সেপিয়েন্স’ পড়লে এটা মনে হতেই পারে। কারন খাদ্যশৃঙ্খলের অনেক পিছন থেকে একলাফে অনেককে টপকে মানুষ সবার ওপরে উঠে এসেছে অনেক কম সময়ে। লাইন ভেঙে যাদের ডিঙিয়ে এসে সেরার সেরা বলে আমাদের মাতব্বরি, তাদের কিছু ঐতিহ্য তো আমাদের থেকে প্রাচীন হবেই। আমরা তো নিজেরাই নিজেদের সেরা তকমা দিয়ে পিঠ চাপড়াচ্ছি। এ ভুবনের কোন জীব যে কোথায় কত দিক থেকে মানুষের থেকে সেরা, সে খবর রাখি কী!
একটা মৌচাকে ৬০ হাজার মৌমাছি বাস করতে পারে! ডাকুন তো দেশের সেরা আর্কিটেক্টকে, বানিয়ে দিক একখানা বহুতল, ৬০ হাজার বাসিন্দার জন্যে। অত সোজা না! মৌচাকের কুঠরিগুলো ছয়কোণা। স্কেল-কম্পাস ছাড়া পারবেন একটা নিখুঁত ষড়ভুজ আঁকতে? খালি হাতে অমন ছ’-কোণা খোপ বানানোও আপনার কম্মো না, তা বিলক্ষণ জানি। প্রকৃতিতে সবচেয়ে মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো হচ্ছে এই ছ-কোণা কাঠামো। সবচেয়ে কম মালমশলা লাগে এই ছ-কোণা ঘর বানাতে। তাই সবচেয়ে হালকা এবং সবচেয়ে বেশি আলো হাওয়া । গালভরা বিশেষণে ‘মোস্ট এনার্জি এফিশিয়েন্ট’। আরও শুনুন। নানাদিক থেকে মৌমাছিরা ঘর বানাতে বানাতে যখন এসে এক যায়গায় মেশে, সেই সংযোগের জায়গাটিও নিখুঁতভাবে ছ-কোণাই হয়। খুব দরকার পড়লে পাঁচ বা সাত কোণা। আগে থেকে মাস্টারপ্ল্যান বনিয়ে, ফিতে ফেলে মেপেজুকে তো আর মৌচাক গড়তে শুরু করে না মৌমাছিরা! তাও দেওয়ালের সঙ্গে দেওয়াল বা ছাদের সঙ্গে ছাদ জোড়া দিতে কিন্তু ওদের গলদঘর্ম হতে হয় না। ওদের ছাদ চুঁইয়ে জলও পড়ে না, ছাদ ভেঙেও পড়ে না। ওদের ঘরের প্রত্যেকটা কোণ একটু করে গোলাকার হয়, যার ব্যাস ওরা নিজেরা ভেবেচিন্তে ঠিক করে। দেয়াল যতটা মোটা হবে, সেই অনুপাতে হবে ঘরের কোণের কার্ভেচারের ব্যাস । তার ওপরেই কুঠরির শক্তি বা ভার বহনক্ষমতা নির্ভর করবে। এবার সব ঘেঁটে যাচ্ছে তো? কোন ইশকুলে এত ভাল অঙ্ক শিখল ব্যাটা ভনভনে মৌমাছি! জ্যামিতি-পরিমিতি তো মধু দিয়ে গুলে খেয়েছে মনে হচ্ছে! শুধু অঙ্ক বলছি কেন, ফিজিক্সও। ঘরের আয়তন ঠিক কত হলে গরমের দিনে ঘর ঠান্ডা থাকবে আর শীতে আরামদায়ক উষ্ণতা বজায় থাকবে তা-ও জানে ওরা। ওইটুকু তো ব্রেন! তার এত ধার! ওদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও বেয়াড়া রকম তুখড়। একবার কোনও পোকামাকড় ঢুকুক না মৌচাকে। হয় সে হাজার কুঠরির গোলোকধাঁধায় পথ হারাবে নয়তো মোম, মধু আর গাছ-পাতার রসে আটকে মারা পড়বে। লখনউ-এর ভুলভুলাইয়ার কনসেপ্টটা নবাব বাহাদুর আসাফ-উদ-দৌলা মৌচাক থেকেই হয়ত কপি করেছিলেন! কে জানে! আপনি তো ভাবেন ওরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানো মধুবাবু। খায় দায় গান গায়। আজ্ঞে না। জার্নাল অফ রয়্যাল সোসাইটিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘দ্য ইনক্রেডিবল আর্কিটেকচার অফ বিস’ বলছে, ‘মলিকিউল থেকে ক্রিস্টাল তৈরি এবং মৌমাছির মৌচাক তৈরির মধ্যে অপূর্ব এক গাণিতিক সাদৃশ্য আছে।’ চার্লস ডারউইন কি আর সাধে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে এ যাবৎ আবিষ্কৃত পতঙ্গদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর হল মৌমাছি!’ মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে না!
ওদের কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক। ওদের সরলতা, ওদের জটিলতা। সব। প্রকৃতির সঙ্গে মিলে মিশে থেকে নিজেদের ঐতিহ্যকে শক্ত হাতের ঘেরে বেঁধে রাখার পাঠ নিতে ওদের পাঠশালায় যেতেই হবে গো মানুষ তোমায়। ওদের কাছে নতজানু হয়ে চিনতে শেখো প্রকৃতির মধ্যেই কোথায় লুকিয়ে আছে তোমার সমস্যার সমাধানের পথ। বিনয়ী হও। বুকের মধ্যে আগলে রাখো তোমার অতীত ঐতিহ্যকে। মধুময় হোক তোমার ‘ঐতিহ্যের বিস্তার!’