আত্ম-অনুভবের দ্বারে মাঝেমাঝে থমকে দাঁড়াতেই হয়। দেহজীবীদের পাড়ায় নতুনকে বরণ। পয়লার আগমন। তাই দেহজীবীদের কাছে পয়লা বৈশাখ মানে জীবনকে কাছে নিয়ে দেখা। সে দেখা অন্যরকমের। জীবনের নাটচালায় মানুষের রিপু দমন করা সহজ নয়! দীর্ঘদিনের আত্মদমনের অনুশীলনে তা দমন করতে হয়। সে চর্চা ধারাবাহিক। এখানে অসুরদলন চলে রাতের বিছানার আগুনে নিত্যদিন। সেই ‘একলা’ বৈশাখে, বর্ধমানের রাজরাজাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা মহাজনটুলিতে আজও বৈশাখের পয়লা পুজো হয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ আর গিরিশচন্দ্র ঘোষের। কেন?
জীবন-নাটকের নাটচালায় এই দুই প্রাণপুরুষ আলো দেখিয়ে ছিলেন দেহজীবীদের। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই মহাজনটুলিতে এখনও একলা বৈশাখে তাঁদের স্মরণ করে দেহজীবীদের একটি বড় অংশ। রামকৃষ্ণ আর গিরিশ ঘোষের পথিকৃৎ জুড়ে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে, ফুল দিয়ে সাজানো হয়। তারপর নিজেদের চোখের জলে পুজো করেন তাঁরা! আত্মধূপ, দীপ জ্বালিয়ে হয় পুজো। বহুকালের এই রীতি আজও চলে আসছে। মহাজনের টুলিতে রাজার শহর জুড়ে তাঁদের যেন একলা বৈশাখের গল্প! গল্পের জীবন, জীবনকে গল্পের মতো দেখা রোজ। এই বৈশাখে একরাশ আঁধারের মাঝেও একবুক আলো নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। সে লড়াইয়ের আলোয় ভরে ওঠে দেহজীবীদের পাড়াটি আজও যেন। তবে ঘুমন্ত স্বপ্নে শব্দের স্বাদ– কখনও তৃপ্তির, কখনও তৃষ্ণার। দেহে শ্রমের গল্প।
সহস্র ভিড়ের আলোতেও তাঁরা আজকের একলা বৈশাখে স্মৃতির পিছন ফিরে দেখে। জীবন কতদূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শেষ চৈত্রের জীবন-উৎসবের হুল্লোড় গাজন পেড়িয়ে, ঢাকিদের শব্দের লড়াই শেষে, গ্রীষ্মের দাবদাহে খানিক জুড়োলে, নতুনের আগমনে প্রকৃতি-পুজোর আয়োজনে মনে হয়– এই একলা বৈশাখে প্রকৃতি-বসনে নতুন কলির আহ্বান যেন-বা জেগে ওঠে। সেখানেই তাঁদের আত্মনিবেদন। বৃহত্তমের মাঝে প্রাণের জেগে ওঠা। ভিতরে তখন মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনি আর ঘরের বাইরে আম, জাম, কাঁঠাল, নিমের কলি টাঙিয়ে নতুনকে কাছে ডাকার আত্মজাগরণ! উপায়হীন উপমায় সারাক্ষণ জেগে থাকা যেন।
রাজার শহর বর্ধমানের চিত্রাবলিদের পাড়ায় এখনও এক ‘একলা’ বৈশাখের লড়াই। অনেকের সে ইতিহাস আজও অজানা। চুপিচুপি সে লড়াই চলে নিজেদের নিয়ে জীবনের অন্ধকারে। এবং সেখানে তাঁদের একার একাকে নিয়েই লড়তে হয় নিত্যদিন। তাঁদের আজও অবহেলার আগুনে পোড়ামুখ নিয়ে, কলঙ্কের কালি মেখে দিন কাটে। তাঁদের নিয়ে ভাববার তেমন কেউ নেই। ভাবতেও বুক কাঁপে নগরজীবনের।
সকাল থেকে সন্ধেবেলা তাঁদের কাছে দেহই ঈশ্বর, দেহই পেটেভাতের জোগাড় করে, তাঁরা তাই দেহজীবী। আজও বর্ধমানের মহাজনটুলিতে তাঁদের একলা বৈশাখ শুরু হয় পথশিশুদের খাইয়ে। সারাবছরের দেহব্যবসার রোজগেরে আয়োজনে তাঁদের এইটুকু সৎ কাজ। শুধু তাই নয় সেই দিনটিতে কিছু দানখয়রাতও করেন তাঁরা। তবে সে সব খুব লুকিয়েই করেন। এই রীতি খুব পুরোনো বর্ধমানের মহাজনটুলিতে।
তবে একলা বৈশাখের নির্জন রাত্রিতে সব আলো বন্ধ হলে, ঘরে-ঘরে কেউ কেউ এখনও উলঙ্গ শরীরে কান্নাকাটি করে পুরোনো জীবনকে কাছে এনে, স্মৃতিতে ইষ্টদেবতার চরণাশ্রয় প্রার্থী হয়ে। তখন তাঁদের চোখের জলে ভাসে বসনমাটি। বছর শুরুর বৈশাখের প্রথম দিনটিতে তাঁদের অনেকেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ আর নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের পুজো করেন বাড়িতে বাড়িতে। কেউ কেউ সেটি করে ভোগ নিবেদনও করে বেড়ায় মনের আনন্দে। এই রীতি আজও চলে আসছে দেহজীবীদের পল্লিতে পল্লিতে।
মানুষ ফেরে রকমফের। একদিন তাঁদের নিত্যকলায় মজে ছিল বর্ধমানের রাজারা। রাজবাড়ির মখমলের আলোকোজ্জ্বল নৃত্যকলায় জ্বলে উঠত তাঁদের দেহের ভাঁজ। সেসব এখন অতীত! পরবর্তীকালে ট্যাক্স-কালেক্টারদের মনোরঞ্জন করাতেই তাঁদের আনা হয়েছিল দেহের পসরা সাজাতে, বর্ধমানের পাখমারা গলিতে। তারপর বর্ধমান রাজাদের নির্দেশে বেড়ে উঠেছিল দেহের জাঁকজমক পাড়াটি একসময়। সেজে উঠেছিল মহাজনটুলি। জমিদারদের পাশাপাশি তাঁদের নায়েব, মুনশিরা ট্যাক্স জমা করাতে এসে রাজাদের রাতের বিনোদনে আটকে যেত।
এই ইতিহাসের শহর, রাজরাজাদের শহর বর্ধমান তার অনেক পুরোনো ঐতিহ্যকেই বুকে করে বহন করে চলেছে আজও। রাজাদের নর্তকীরাও এসে থাকতেন এখানে, রাজ-অন্তঃপুরের পর্দানশীন ঘরে। সুবল, মদন রিক্সাওয়ালারা একসময় নিয়মিত নিয়ে যেত ওদের পাড়ায়। এখন তাদের টোটো হয়েছে। তবুও তারা এ-পথের বাঁধা কাহার, বহুকালের। তারা বলল ‘বাবু, আজও শেষরাতে চাঁদের হাট বসে এখানে’। এখানকার বৈশাখের বৈকালিক গলি আলো করে বহু রূপ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রংমহলের লছমি, মুন্না আর মুনিয়ারা। একসময় তাঁদের দেহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায় রাস্তায়। আজও এ-গলি, ও-গলি, তস্যগলি জুড়ে সাজা মুখগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেদের প্রদর্শন করে। রং মাখা বিশ্বাসের বহু রূপ ধরে। এখানকার বৈশাখে হাট বসে দেহের। সেখানে প্রেম ও পাপের মাপজোক চলে নিজেদের জীবনের উঠোনে, নিত্যদিন।
বর্ধমানের মহাজনটুলি, আসানসোলের লছিপুর কলোনি, কালনা শহরের গলি, দুর্গাপুরের কাদারোড, বোলপুর শহরের বল্লভপুরের চিরকুটিবন, সিউড়ির তালতলা বস্তি, কলকাতার হাড়কাটাগলি কিংবা সোনাগাছির মতো জায়গায় আজও একইভাবে শরীরে প্রেমের পাশাপাশি পাপও বিক্রি হয়। তাঁদের কাছে কোনও বৈশাখ নেই, কোনও দাবদাহ নেই, কোনও মায়া নেই। শুধু দেহ আর দেহ। দেহই এখানে সমাদৃত। মা ধরিত্রীর যেন প্রকৃত আধার তাঁরাই। শান্ত বৈশাখে প্রতিদিনই নতুন নতুন পশুত্ব হনন হয় তাঁদের দেহের চামড়ায়। তাঁদের মনের গভীরে বাজে অসভ্যতার মাদল। না চাইলেও সেখানে বধ হন মনুষ্যালয়ের ঘাতক অসুর!
[লেখার মধ্যে ব্যবহৃত ছবিগুলি বিকাশ ভট্টাচার্য চিত্রিত]
………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?