টোটো আসার ঢের আগে বাসই একমাত্র গণমাধ্যম, যেখানে উঠলে গান শুনতে পাওয়া একরকম নিশ্চিত ঘটনা ছিল। ড্রাইভারের সিটের পেছনে লালকালিতে লেখা ‘টু সিট ২৭+১’, তার ওপরে পাই-আকৃতির স্পিকার, সেখানে গান বাজছে– বাসের নিয়মিত সওয়ারিদের এই দৃশ্য অতিচেনা। ফিরতি বাসে হা-ক্লান্ত মাথা জানালায় আলতো ঠেকানো, কানে ভেসে আসছে কুমার শানুর কণ্ঠস্বর।
‘স্পটিফাই’-এ একজন একটি প্লে-লিস্ট তৈরি করেছেন, নাম “ইন্ডিয়ান বাস ড্রাইভার’স প্লে-লিস্ট”। অদ্ভুত খেয়াল, সন্দেহ নেই। ভারতীয় বাসে, মূলত যেগুলো স্থানীয় বাস, যা-যা গান চলে, তার একটা সম্ভার ‘স্পটিফাই’-এর ওই শ্রোতা তৈরি করতে চেয়েছেন। সেই তালিকায় যেসব নামের আধিপত্য, প্রত্যেকেই নয়ের দশকের হিন্দি গানের প্রতিনিধিস্থানীয় চরিত্র: কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, অনুরাধা পঢ়োয়াল থেকে শুরু করে নাদিম-শ্রাবণ, কল্যাণজি-আনন্দজি প্রমুখ। গোটা ভারত না হলেও কলকাতার স্থানীয় বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ যে এই গানগুলোই, তা নিয়মিত শ্রোতা মাত্রেই জানেন। এইসব গানের প্লে-লিস্ট তৈরি করে ‘স্পটিফাই’-তে নিয়ে আসার কাজটি বরং খানিক আলোচনার দাবি রাখে।
টোটো আসার ঢের আগে বাসই একমাত্র গণমাধ্যম, যেখানে উঠলে গান শুনতে পাওয়া একরকম নিশ্চিত ঘটনা ছিল। ড্রাইভারের সিটের পিছনে লালকালিতে লেখা ‘টু সিট ২৭+১’, তার ওপরে পাই-আকৃতির স্পিকার, সেখানে গান বাজছে– বাসের নিয়মিত সওয়ারিদের এই দৃশ্য অতিচেনা। ফিরতি বাসে হা-ক্লান্ত মাথা জানালায় আলতো ঠেকানো, কানে ভেসে আসছে কুমার শানুর কণ্ঠস্বর। ট্রাফিকে যানবাহনের গতি স্তব্ধ, কিন্তু স্পিকারের উদ্যমে ভাটা পড়েনি একটুও– তা থেকে সমানে নিঃসৃত হচ্ছে অদম্য প্রেমিকের প্রেয়সীকে চাওয়ার গান। সেসব গানকে সুশীল সমাজ যতই ‘ক্যাওড়া’ বলে দাগিয়ে দিক না কেন, বাসযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ এমন গান শোনা। অন্তত, দীর্ঘসময় অবধি এমনটাই ছিল। তারপর ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়েছে স্থানীয় বাসের স্পিকার। খারাপ হয়নি, এগিয়ে গিয়েছে ধীরে ধীরে বিলোপের দিকে।
‘স্পটিফাই’, ‘জিওসাভন’, ‘ইউটিউব মিউজিক’-এর মতো অ্যাপ এসে শ্রবণকে করে তুলেছে ব্যক্তিগত, ‘কাস্টোমাইজড’। একেকটা মানুষ যন্ত্রে একেকরকম গানের সারি নিয়ে ঘুরে বেড়ান– কেউ ডেথ-মেটাল, কেউ বলিউড, কেউ-বা রবীন্দ্রসংগীত। যন্ত্রের সঙ্গে আর শ্রবণযন্ত্রকে জুড়েও রাখতে হয় না, ব্লুটুথ ইয়ারফোনের বদান্যতায় তারের ঝামেলা এড়ানো গিয়েছে। বাসে বা যে কোনও পরিবহনমাধ্যমে উঠে কেবল কানে একটি ইয়ারফোন গুঁজে নিলেই হল, তৈরি করে নেওয়া যায় নিজস্ব জগৎ। মনের বর্তমান হাল-হকিকত অনুযায়ী অ্যাপই বলে দেবে কোন গানগুলো শুনলে ভালো হয়। অতএব, কোনও গান জোর করে কানে আসার ঝক্কি নেই। এ-ব্যবস্থায় বিরোধ থাকার তো কথা নয়। সত্যিই তো, ঠিক যেমন সক্কাল-সক্কাল ট্রাফিকে ‘জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’ শুনে বিরক্তি আসে; তেমনই অফিস-ফেরতা বসের ঝাড় খেয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে গোবিন্দা-রবিনার নাচের গান শোনাও বিশেষ সুখকর নয়। কিন্তু এই গানগুলো ছিল বাসযাত্রার একটা পরিচিতিস্বরূপ। বাসের শেষ সিটে পা তুলে বসা লোকটি থেকে শুরু করে, যে লোকটি অফিস সেরে এইমাত্র বাড়ির দিকে এগোলেন, সকলকে মিলিয়ে দিত এই একটি প্রক্রিয়া– গণশ্রবণ। একটা বাস তার পেটের খোলে নিয়ে চলেছে কতকগুলো লোককে, কতকগুলো মানুষ শুনছেন একটিই গান– বাসটি নেহাতই আর ধাতব যান নয়, হয়ে উঠত একটি জ্যান্ত-সত্তা। যার যোগাযোগের নিজস্ব ভাষা আছে, আছে স্বতন্ত্র কথন। এখন প্রাণহীন লোহালক্কড়ের শব্দই তার সম্বল, সে বয়ে নিয়ে যায় কতকগুলো লোককে, যাদের অনেকেই আসলে বেঁচে আছে এক্কেবারে আলাদা আলাদা জগতে, তাদের ব্যক্তিগত প্লে-লিস্টের গড়া দুনিয়ায়। কেউ কারও কথা শুনতে পান না, টিকিটের জন্য কন্ডাক্টর কাঁধে টোকা মারলে অলসভাবে বাড়িয়ে দেন নোট, খুচরো আর টিকিটটি মুঠোয় নিয়ে ফিরে যান আপন পৃথিবীতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাসে বা যে কোনও পরিবহনমাধ্যমে উঠে কেবল কানে একটি ইয়ারফোন গুঁজে নিলেই হল, তৈরি করে নেওয়া যায় নিজস্ব জগৎ। মনের বর্তমান হাল-হকিকত অনুযায়ী অ্যাপই বলে দেবে কোন গানগুলো শুনলে ভালো হয়। অতএব, কোনও গান জোর করে কানে আসার ঝক্কি নেই। এ-ব্যবস্থায় বিরোধ থাকার তো কথা নয়। সত্যিই তো, ঠিক যেমন সক্কাল-সক্কাল ট্রাফিকে ‘জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’ শুনে বিরক্তি আসে; তেমনই অফিস-ফেরতা বসের ঝাড় খেয়ে বাড়ি ফেরার সময়ে গোবিন্দা-রবিনার নাচের গান শোনাও বিশেষ সুখকর নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই যে বাসের প্লে-লিস্টটি জনৈক শ্রোতা তৈরি করেছেন, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যিনি এই প্লে-লিস্টটা তাঁর সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির যন্ত্রে বয়ে বেড়াবেন, আসলে তো তিনি বয়ে বেড়াচ্ছেন বাসের গোটা যাত্রাপথ– প্রথম স্টপেজ থেকে শুরু করে গন্তব্যের শেষতম স্টপেজ অবধি বাসটির সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতাটি তিনি ফোনে ধরে রাখছেন। তিনি যে কেবলই ’৯০-এর গান, যা ক্যারকেরে স্পিকারে লজ্-ঝড়ে বাসে বাজত, ফোনে জমিয়ে রাখছেন না; তিনি আসলে উদ্দাম নাচের গান শোনার বিরক্তি, ঘামের গন্ধে অস্থির অবস্থায় আইটেম গান শোনার ক্রোধটিও অজান্তেই সরিয়ে ফেলছেন। এর কোনওটিই ফিরবে না সেই পরিশীলিত, সন্তর্পণে নির্মিত প্লে-লিস্টে– সেখানে শুধু কথা আর সুর। আসলে তো বাসের গানের প্লে-লিস্ট তৈরি করে, রক্তমাংসের বাসকে ছোঁওয়া যায় না, তার একটা অবয়ব মনে-মনে তৈরি করা যায় বড়জোর। ঠিক যেভাবে ঠান্ডা ঘরে পার্টিতে মিলবে না ভাটিয়ালির আত্মা, ভাটিয়ালি আসলে জলীয় বাষ্প, মাছের গন্ধমাখা ধুন; তেমনই ফেরার ক্লান্তি, বাসের টুকরো-টাকরা যন্ত্রাদির পথশ্রমে ক্লান্ত হওয়ার শব্দ ছাড়া বাসের প্লে-লিস্ট সম্পূর্ণ হয় না। ব্যক্তিগত শ্রবণ এই বিভ্রমটুকুই তৈরি করে। বিরান-পথ হাঁটতে হাঁটতে প্রেমের গানে অকস্মাৎ বদলে যায় চারপাশ, এক অলীক আফিমে ডুবিয়ে দেয় আজন্ম-প্রত্যাখ্যাত যুবককে। মুখচোরা মধ্য-বিশকে কল্পনার জগতে জিতিয়ে দেয় ব্যাটম্যানের থিম-মিউজিক। তেমনই বাসের প্লে-লিস্ট কানে দিয়ে উবার ধরে ফিরতে ফিরতে মুছে আসে একটা গোটা গণমাধ্যমের সত্তা। তার যাবতীয় অপ্রাপ্তি মুছতে, যাবতীয় হতাশা-ক্লান্তি কাটাতে তাকে শরণ নিতেই হয় তার প্লে-লিস্টে। পরিপার্শ্বের কণ্ঠস্বর যত রুদ্ধ হয়ে আসে, যত আপন জগৎটা স্পষ্ট হয়ে আসে; তত মুছে যায় আশপাশের জীবন্ত পৃথিবীটা। গণশ্রবণ আমাদের দেয়নি সেই কাঙ্ক্ষিত পলায়ন, অতএব গণশ্রবণ কালপ্রবাহে তলিয়ে গেছে ক্রমেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ইউটিউব কি রবীন্দ্রনাথের গান বদলে দেবে নাকি!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
’৯০-এর গান এখন রিমেক অথবা লো-ফাই হয়ে যুগধর্মের দৃষ্টান্ত হিসেবে বেজে চলে ইয়ারফোনে, তার সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি, টেকনিক্যাল অসঙ্গতিটুকু মুছে তাকে পেশ করা হয় সর্বোত্তম গুণমান-সমেত। উবারের অন্ধকার অভ্যন্তরে হলুদ আলো-জ্বলা বাস, স্পিকারের ওপরে শুকনো লঙ্কাজবা ঝোলানো কালীর ছবি কেবলই স্মৃতিতে রয়ে যায়। স্পিকার থেকে ‘স্পটিফাই’-তে বাসের গানের যাত্রা আসলে শহরের দীর্ঘতম বাসযাত্রার চেয়ে ঢের বেশি ক্লান্তিকর, ঢের বেশি হৃদয়বিদারী। বোবা বাস অতৃপ্ত আত্মার মতো তার যাবতীয় স্মৃতি নিয়ে রাজপথে চলে-ফিরে বেড়ায়, তার পেটের খোলে কতকগুলো মানুষ, যাদের অনেকেই বাস্তবটি ভুলে প্রাণপণ নির্মাণ করে চলেছে নিজের ভুবন। সেই বাসে আর কখনও বাজে না ক্যারকেরে গান।
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।