বাঙালিকে জাপান চিনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর সময়ের দোল খেয়ে জাপানকে দেখার চোখ বারবার বদলেছে বাঙালি। আমাদের অগ্রজদের অনেকের কাছেই জাপান ছিল শুধুই চন্দ্রমল্লিকা সামুরাইদের দেশ। ইউরোপীয়দের পুঁতে দেওয়া প্রাচ্যবাদের এই বীজ উপড়ে ফেলতে সময় লেগেছে আরও কয়েক দশক। আর এই ‘নতুন’ জাপানই আজকের বাংলাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। সেই প্রভাবে অনুঘটক হয়েছে সুসি থেকে মাঙ্গা, জাপানি গ্যাজেট থেকে ফুজি কালার, কিংবা ইকো পার্কের জাপানি গার্ডেন। এমনকী জাপানি তেলের প্রতি আড়চোখের আকর্ষণও। বাঙালি পাঠকদের মধ্যে মুরাকামি, মিশিমার মতো লেখকদের বিপুল জনপ্রিয়তা, বাঙালি ইনস্টাগ্রামারদের মাউন্ট ফুজি নিয়ে ভ্লগ, ফুজি দ্য জাপানিজ রেস্তোরাঁ, জাপানি সেলুন থেকে টুর এজেন্সি– এসবের রমরমা বুঝিয়ে দেয়, বাঙালি জীবনে জাপানি প্রভাব ঠিক কতখানি।
‘আমি যখন জাপানে ছিলুম, তখন একটা কথা বারবার আমার মনে এসেচে। আমি অনুভব করছিলুম, ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙালীর সঙ্গে জাপানীর এক জায়গায় যেন মিল আছে। আমাদের এই বৃহৎ দেশের মধ্যে বাঙালীই সর্ব প্রথমে নূতনকে গ্রহণ করেচে এবং এখনো নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করবার মত তার চিত্তের নমনীয়তা আছে।’ প্রথমবার জাপানযাত্রা (১৯১৬) থেকে ফিরে এসে এমনটাই উপলব্ধি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক অন্তত এরও অর্ধশতক আগে থেকে।
মেইজি যুগে একজন পরিব্রাজক বুদ্ধগয়া আটকে পড়েন, শেষমেশ পরিত্রাণ পান কলকাতায়, এ গল্প অনেকেরই জানা। পাথুরিয়াঘাটার সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সঙ্গে জাপানের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কিস্সাও সুবিদিত। জাপান ও বাংলার সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। ওকাকুরার এদেশে আগমন এবং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর আলাপ আলাদা দুটো সংস্কৃতির মধ্যে যে অনন্যসাধারণ সেতু বেঁধেছিল, তারই পথে আমাদের হাত ধরে নিয়ে গেছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখিয়েছেন কীভাবে অবন ঠাকুর, নন্দলাল বসুরা জাপানি শিল্পকলায় প্রভাবিত হওয়ার ফলে বাংলার শিল্পকলায় এক নতুন মিশ্র কলাসংস্কৃতির পথ চলা শুরু হয়। অন্যদিকে, প্রবীর বিকাশ সরকার নিরলস ঐতিহাসিকের যত্ন নিয়ে গ্রন্থিত করেছেন দুই সংস্কৃতির মধ্যেকার অজস্র কালানুক্রমিক তথ্য। কিন্তু বিংশ শতকের শেষ কিছু দশক এবং এই শতাব্দীর আড়াই দশকে বাঙালির রোজকার জীবনের আনাচে-কানাচে জাপানি প্রভাব যেভাবে অনুপ্রবেশ করেছে, তার সম্পর্কে খুব বেশি কথা হয়তো হয়নি।
বাঙালি জীবনে জাপানি প্রভাব প্রসঙ্গে একটা নাম অবশ্য ধ্রুবক: রবীন্দ্রনাথ (যিনি জাপান যাওয়ার পথে ‘নিখিললুপ্ত অন্ধকারে দাঁড়ায়ে একাকী দেখেছে[ন] বিশ্বের মুক্তিপথ।’)। তার কারণ বুঝতে পারাও শক্ত নয়। রবীন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে প্রথম জাপান যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন (অবশ্য ১৯১৬-এর আগে তা সম্ভব হয়নি)। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই তিনি জাপান সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন, বিশেষ করে জাপানিদের সরল জীবনচর্যা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল অনেক আগেই। জাপান সম্পর্কে তাঁর ধারণা যে ভুল ছিল না, তা তিনি জাপানে প্রথমবার গিয়েই নিশ্চিত হন: ‘জাপানের শক্তির মূল কারণ… তারা বাজে চেঁচামেচি ঝগড়াঝাঁটি করে নিজের বলক্ষয় করে না।… শোকে দুঃখে আঘাতে উত্তেজনায়, ওরা নিজেদের সংযত করতে জানে।’ জাপানিদের যাপন যে শিক্ষণীয়, তা প্রথম বাঙালিকে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু একটা সংস্কৃতিকে অন্য আরেকটা সংস্কৃতির কাছে হাত পাততে গেলেও, উভয়ের মধ্যে কিছু অন্তত সাদৃশ্য আগে থেকেই থাকা প্রয়োজন, তা না হলে এক পক্ষের শেখাই হোক বা দু’পক্ষের পারস্পরিক আদানপ্রদান, কোনওটাই সম্ভব হবে না। জাপান আর বাংলার মধ্যে সেই সাদৃশ্যই বা কী? সেকথাও রবীন্দ্রনাথই বলেছেন। ‘নূতনকে গ্রহণ ও উদ্ভাবন করবার মত… চিত্তের নমনীয়তা…।’
১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে শিল্পাচার্য ওকাকুরা জুডো প্রশিক্ষক সানো জিনোসুকে-কে শান্তিনিকেতনে পাঠান। ওই বছরই দারুশিল্পী কুসুমাতো, কিনতারো কাসাহারা এসে শ্রীনিকেতনে যোগ দেন। এছাড়াও আসেন বেশ কিছু জাপানি সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক। ফলত, বোলপুরের বুকে এক খণ্ড জাপান বসতি গড়ে ওঠে। এ ঘটনার তাৎপর্য শুধু সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অন্য একটি সংস্কৃতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ, শিক্ষণীয়, তারই নির্যাসে কালপরম্পরায় পুষ্ট হতে থাকবে বাংলা, এই ছিল কবির অভিপ্রায়।
জাপানে কবি এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, ১৯০৭ সালে চট্টগ্রামে এক সভায় তিনি জাপানের রাশিয়া বিজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে বাঙালিকেও বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। যদিও এই রবীন্দ্রনাথই পরবর্তীতে জাপানে ইউরোপীয় ঘরানার ‘আধুনিকতা’র অতিরিক্ত প্রভাবে বিরক্ত হন। তাঁর অনুমান সত্যি হয় অচিরেই। ফ্যাসিবাদে জাপানের মতো সাজানো শান্ত দেশ হয়ে ওঠে জউঘর। কিন্তু তখনও জাপানি সংস্কৃতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ, তার গুণগ্রাহী রবীন্দ্রনাথ।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বাঙালি জীবনে জাপানি প্রভাবের ধরন অনেকটাই পালটাতে থাকে। সেই বিংশ শতকের শুরু থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশার অন্তিম পর্যায়, অর্থাৎ মোটামুটিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়া অবধি, বাঙালির কাছে জাপান ছিল একরকম। আর হিরোশিমা, নাগাসাকি পরবর্তী জাপান আরেক রকম। ১৯৪৫-এর পরের জাপান বাঙালির এতদিনকার চেনা কিমোনো, গেইশা, নো, কাবুকি, জুজুৎসুর জাপান আর ততটা থাকল না। এই নতুন জাপান জেন কিয়োটো ছাত্র আন্দোলনের জাপান, পপ মিউজিক, আধুনিক সাহিত্য আর পাব্ কালচারের জাপান। আর অবশ্যই হিরোশিমার ছায়া থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে পারা নতুন এক জাপান।
এই জাপান আগের চেয়ে অনেক বেশি পশ্চিম-প্রভাবিত, অনেক বেশি প্রত্যয়ী, অনেক বেশি ‘আন্তর্জাতিক’। ‘আর্টিস্ট অব্ দ্য ফ্লোটিং ওয়ার্ল্ড’-এ কাজুও ইশিগুরো এ কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন: ‘পৃথিবী এখনও মনে করে, জাপানে এখনও সবাই কিমোনো পরে, হাঁটু গেড়ে কথায় কথায় অভিবাদন জানায়… কিন্তু সে জাপান প্রাগৈতিহাসিক। তার কোনো চিহ্ন আজ নেই।’ আজকের জাপান– অ্যানড্রয়েডের জাপান, টেকনোলজির জাপান, অ্যানিমে আর মাঙ্গার জাপান, গ্লোবাল জাপান। অস্কার ওয়াইল্ড ঠিক এই একই কথা অনেক আগেই বলে গিয়েছিলেন: ‘In fact the whole of Japan is a pure invention. There is no such country, there are no such people. One of our most charming painters went recently to the Land of the Chrysanthemum in the foolish hope of seeing the Japanese.’
বাঙালির জাপানকে দেখার, চেনার চোখ বারবার বদলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন বাংলা রবীন্দ্রনাথের মেধাবী মনকে সশরীরে হারিয়েছে, তখন ঔপনিবেশিক বশ্যতার গ্লানি থেকে নামমাত্র মুক্তি পেলেও, মনেপ্রাণে সে ততদিনে প্রাচ্যবাদে সুদীক্ষিত। তাই আমাদের অগ্রজদের অনেকের কাছেই জাপান তখনও শুধুই চন্দ্রমল্লিকা সামুরাইদের দেশ। ইউরোপীয়দের পুঁতে দেওয়া প্রাচ্যবাদের এই বীজ উপড়াতে আমাদের লেগে যাবে আরও কয়েক দশক। আর এই ‘নতুন’ জাপানই আজকের বাংলাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে।
নিন্দুকেরা যতই ‘পুঁজিবাদ আর পুরুষতন্ত্রের দেশ’, ‘একদলীয় গণতন্ত্রের দেশ’ বলে আধুনিক জাপানকে দাগিয়ে দিক, সাত ও তার পরবর্তী দশকগুলোতে রাশিয়া, আমেরিকা, চিন থেকে (অন্তত) সাংস্কৃতিক সমদূরবর্তিতা জাপানকে উত্তরাধুনিক নকলায়নের (simulation) যুগেও দিয়েছে অনন্যতা। তবে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরের দশকে যে নতুন ধরনের জাপানি প্রভাব বাঙালি জীবনে ইতিউতি পড়তে শুরু করেছিল, নতুন শতাব্দীর আড়াই দশকে তা সম্পৃক্ত হতে পেরেছে। এতটাই যে জনপ্রিয় সংস্কৃতির যেকোনও গবেষকের কাছেই আজকাল জাপান-বাংলা সম্পর্ক আলোচ্য।
বাঙালির খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে পাঠাভ্যাস সবকিছুতেই রয়েছে জাপান। সুসি হোক বা মাঙ্গা, কিংবা রোজকার জাপানি গ্যাজেট, আঁকার জন্য ফুজি কালার, কিংবা ইকো পার্কের জাপানি গার্ডেন, কিংবা ক্রমশ বাড়তে থাকা জাপানি ভাষা শেখার চাহিদা (কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে ফরাসি, জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষার শেখার চাহিদার চেয়েও বেশি), বাঙালি পাঠকদের মধ্যে মুরাকামি, মিশিমার মতো লেখকদের বিপুল জনপ্রিয়তা, বাঙালি ইনস্টাগ্রামারদের মাউন্ট ফুজি নিয়ে ভ্লগ, কলকাতার বুকে শুধুমাত্র মাঙ্গা সাহিত্যের জন্য আলাদা করে বুকস্টোর, ২০৯-এ, শরৎ বোস রোডে ফুজি দ্য জাপানিজ রেস্তোরাঁ, মধ্যমগ্রামের জাপানি সেলুন কিংবা বারাসতের শাকুরা ট্যুর এজেন্সি (যারা শুধু জাপানেই ঘুরতে নিয়ে যায়, কেন না বিগত বিশ বছরে প্রচুরসংখ্যক বাঙালি প্রতিবছর জাপানের ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য আবেদন করেন)– সবকিছুই বুঝিয়ে দেয়, বাঙালি জীবনে জাপানি প্রভাবের মাত্রা ঠিক কতখানি।
বাঙালি জীবনে জাপানি প্রভাবের কথা বলতে হলে বাংলাদেশের কথাও না বললেই নয়। অনেকেরই হয়তো অজানা, জাস্টিস রাধাবিনোদ পাল যিনি টোকিও ট্রায়ালে তাঁর বিখ্যাত ৮০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ রায় দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচিয়েছিলেন, তিনি কুষ্টিয়ার মানুষ ছিলেন। তাঁর অবদানের কারণে জাপানের কৃতজ্ঞ সম্রাট বলেছিলেন, ‘যতদিন জাপান থাকবে, বাঙালি খাদ্যাভাবে, অর্থকষ্টে মরবে না। জাপান হবে বাঙালির চিরকালের নিঃস্বার্থ বন্ধ।’ সে কথাও অবশ্য রেখেছেন সম্রাট এবং তাঁর উত্তরসূরীরা। বাংলাদেশের বাঙালিদের জীবনেও জাপানি প্রভাব কোনও অংশে কম নয়। এর সাম্প্রতিক নিদর্শন বলা যেতে পারে, বাংলাদেশেরই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর মাঙ্গা জীবনী ‘ফাদার অব্ দ্য নেশন বাংলাদেশ’। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গেও মাঙ্গা লেখা হচ্ছে এবং তার চেয়েও বেশি হচ্ছে মাঙ্গা নিয়ে গবেষণা। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল: ‘জাপানি পাঠকের মনটা চোখে ভরা।’ যদি সে মনের হদিশ বাঙালিও পেয়ে থাকে, ক্ষতি কী?
……………………………………………………
আরও পড়ুন: সাবধান করে দেওয়া একটি আদিরসাত্মক চিনা বই
……………………………………………………
বাঙালি জীবন ঠিক কবে থেকে আর কতদিন পর্যন্ত কোন্ কোন্ উপায়ে জাপানকে আত্মস্থ করেছে, তা নির্ণয়ের চেষ্টা এই লেখায় নেই। এই লেখার উদ্দেশ্য ছিল মাত্র একটি: জাপান এবং জাপানিদের মধ্যে আমরা কী এমন পেলাম, যার অনন্যতা আমাদের এত দারুণভাবে প্রভাবিত করল, এই জিজ্ঞাসারই সম্ভাব্য উত্তর খুঁজে দেখা। এই সন্ধান, এই দেখার পথ এ যুগে নিশ্চয়ই দুর্গম। কেননা, ‘যখন দেখবার সামগ্রী বেড়ে ওঠে তখন দেখাটাই কমে যায়।’
জাপানি সভ্যতার আবহমানতার নির্যাসটুকু উপলব্ধি করে, আশ্রমের জুজুৎসু শিক্ষার্থীদের জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/ সঙ্কটের কল্পনাকে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।’ (পৌষ ১৩৩৬)।সঙ্কোচহীন, প্রত্যয়ী, দৃঢ়, ইতবাচক জাপানকেই তিনি আমাদের চেনাতে চেয়েছেন, দেখাতে চেয়েছেন। আমরা কি দেখব না? এই দেখাতেই হয়তো নিহিত বাঙালির মুক্তিপথ।
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..