‘‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে আমাদের জানিয়েছেন ‘চপ বি [ E chop] ভাজা মাংস খণ্ড।’ চপ কৃতঋণ শব্দ। সংস্কৃতের সঙ্গে যোগ নেই।” একথা শুনে রকিরা উল্লসিত হয়ে উঠল। রকি নাম্বার থ্রি বলল, ‘তার মানে চপ মানেই মাংসের চপ। আহা আহা! আলুর চপ, মোচার চপ, ঢপের চপ সব পরে বাঙালির বানানো। বিলিতি চপ দেশি চপ শিল্পে রূপ বদল করেছে।’
নিত্যানন্দবাবুর টাকায় চা আর চপ খেয়ে খেয়ে পাড়ার পঞ্চরকবাজের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নিত্যানন্দবাবু খেয়াল করলেন তিনি যেমন ‘আনলার্ন’ করে রক থেকে নানা বিষয়-আশয় শিক্ষা করছেন তেমনই রকবাজদেরও উচিত তাদের অবস্থান থেকে সরে এসে তাঁর কাছ থেকে কিছু ‘লার্ন’ করা। কথায় বলে দিবে আর নিবে মিলিবে মিলাবে। তাই বিকেলবেলায় আলুর চপ খেতে খেতে নিত্যানন্দবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘তোমরা আলুর চপ নিয়ে কখনও ভাবনা-চিন্তা করেছ?’
পাঁচজনেই প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, ‘না, না। আলুর চপ ভাবার নয়, খাবার জিনিস।’
‘খাবার জিনিস সে তো টের পাচ্ছি। তাছাড়া তোমরা নিত্যদিন আমার পয়সায় আলুর চপ সাঁটাচ্ছ, তোমাদের মনে হবেই এমন খাবার কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। রাস্তায় রাস্তায় চপের দোকান হোক। আমবাঙালি আলুর চপে সন্ধে-রাতে তৃপ্তি পাক। রাতে সেই জন্য কম খাক। এ-ভাবে বাঙালি কম-পয়সায় জীবন কাটাক।’
গতকাল থেকে নিত্যানন্দবাবু রকবাজদের সাধারণ একটি নাম দিয়েছেন। ‘রকি’-এই স্মার্ট নাম পেয়ে তারা আহ্লাদে এক্কেবারে আটখানা। নিজেরাই ক্রমান্বয়ে ঠিক করে নিয়েছে রকি-1, রকি-2 থেকে রকি-5 পর্যন্ত কে কোনটা! রকি এক নয়, রকি ওয়ান। রকি নাম্বার ওয়ান হলে আরও ভালো। কারণ, ওদের বক্তব্য আজকাল টিভিতে নানারকম গেম শো হয়। তাতে ওদের কেউ ডাকে না। রকবাজ ব্যাচেলরদের পার্টিতে বাজার আছে, টিভিতে নেই। ওরা এমনিতে নিরামিষ রকি। তাই ওদের পার্টিতে বাজার নেই, টিভিতেও না। তাই নিত্যানন্দ ওদের রকি নাম্বার ওয়ান থেকে শুরু করে রকি নাম্বার ফাইভ বললে ওদের বেশ আরাম হয়। বলল, ‘স্যর, একটু চুলকানি কমে। মনে হয় আমাদেরও কিছু হল।’
সেই থেকে নিত্যানন্দবাবু ওদের রকি নাম্বার ওয়ান, রকি নাম্বার টু এভাবে ডাকছেন। ওরাও নিত্যানন্দবাবুর নাম একটু বদল করেছে। নাম দিয়েছে ‘নেতাই’। নিত্যানন্দবাবু মেনে নিয়েছেন। ওরা খুব খুশি। বারচারেক টুইক টুইক করে সিটি দিল। মাস্টারকে নেতাই ডার্লিং বলে চুমু-টুমু খেয়ে অ্যাকসা। নিত্যানন্দবাবু একটু শিউরে শিউরে উঠেছিলেন। তবে এ-সবই ভদ্রলোকের খোসা-খোলার শিক্ষা ভেবে মেনে নিয়েছেন। তবে প্রতিরোধ কি জেগে ওঠেনি? উঠেছে। তিনি ঠিক করেছেন রকিদেরও খানিক ‘লার্ন’ করাবেন। সে-জন্যই আলুর চপ নিয়ে দু’-কথা। নিত্যানন্দবাবুর মুখে চপ-কালচারের বেত্তান্ত শুনে রকিরা কথা বলতে শুরু করল।
রকি নাম্বার ওয়ান: নেতাই ডার্লিং। ঠিক ঠিক। আপনার টাকায় বিকেলে এই খান দুই করে চপ নিয়মিত খেয়ে রাতে আমাদের কম খাবারেই চলে যাচ্ছে।
রকি নাম্বার টু: বাংলা চপ হেব্বি। নেতাই ডার্লিং– ও বেবি।
নিত্যানন্দবাবু এতটা নিতে পারলেন না। পালটা প্রশ্ন করে থামিয়ে দিলেন। ‘পাড়ায় পাড়ায় আমজনতার জন্য এই আলুর চপের দোকান কি চিরকাল ছিল?’
প্রশ্নটা শুনে রকিরা একটু থামল।
রকি নাম্বার থ্রি: ‘আমরা তো জন্ম থেকেই দেখছি। এই যে স্যর কালীপুজো আসছে। শুনেছি কালিকার চপের দোকান নাকি কালীপুজোর সময় খুলেছিল। কালী তো পুরনো ঠাকুর। তার মানে চপও পুরনো।’
নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘এ যুক্তি ভুল। কোনো একবার কালীপুজোর সময় কালিকার চপের দোকান খুলে গেল বলেই যতদিন কালী ততদিন চপ– এ-কথা বলা যাবে না। সুকুমার দত্তের কালিকার চপ পুরনো দোকান, তবে বিশ শতকের। উনিশ শতকে কি কলকাতায় চপের দোকান ছিল?’
রকি নাম্বার ফোর: নেতাই ডার্লিং। চুনুমুনু। ইতিহাস পড়ব না। পড়ালে মাংসের চপ খাওয়াতে হবে।
রকি নাম্বার ফাইভ: মাংসের চপ খাবো, ইতিহাস পড়ব।
নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘বেশ খাওয়াব। তবে বাকি কথা মন দিয়ে শুনতে হবে।’
রকি ফাইভ বলে উঠল, ‘শুনব, শুনব।’
নিত্যানন্দবাবু বুঝলেন মিড ডে মিলের উপকারিতা অস্বীকার করার উপায় নেই। আফটারনুন কিংবা ইভনিং চপেও একই কাজ হয়। বললেন, ‘আমার যা ধারণা উনিশ শতকে চপের দোকান রাস্তায় রাস্তায় ছিল না। ময়রারা কলকাতায় দোকান দিচ্ছে। ময়রার দোকানে বাঙালি ভাজা আর মিষ্টি খাচ্ছে। সেই ময়রার দোকানের খাবার-দাবার যে খুব স্বাস্থ্যকর নয়, তা অনেকেরই মনে হচ্ছে। এদের দলে বিবেকানন্দও ছিলেন।’
রকি নাম্বার ওয়ান: বিবেকানন্দ মানে গোলপার্কের স্ট্যাচু? কাছেই লেক মার্কেটে বেশ কয়েকটা চপের দোকান আছে।
নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, গোলপার্কের স্ট্যাচু। তবে একদিনে তো স্ট্যাচু হয়নি। আগে নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। গোপ্পে লোক। বাবা উকিল। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে নরেন আড্ডা মারত। গান গাইত। ব্রাহ্মসমাজে যেত। রাস্তার খবরা-খবর রাখত। পরে বিবেকানন্দ হয়ে কলকাতার ময়রা দোকানদারদের বেশ বকুনি দিয়েছেন।’
রকি নাম্বার থ্রি: কী বলেছেন?
নিত্যানন্দবাবু বাংলা ভাষা-সাহিত্যের শ্রুতিধর মাস্টারমশাই স্বর্গীয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে স্মরণ করে পকেট থেকে একটি চোতা বের করে পড়তে শুরু করলেন, ‘ময়রার দোকান, বাজারে খাওয়া এসব মহা অপবিত্র … ভাজা জিনিষগুলো আসল বিষ। ময়রার দোকান যমের বাড়ী। … আমাদের বাঙ্গলা দেশের জন্য এখনও দূর পল্লীগ্রামে যে সকল আহারের বন্দোবস্ত আছে, তাহাই প্রশস্ত। কোন্ প্রাচীন বাঙ্গালী কবি লুচি-কচুরীর বর্ণনা কচ্ছেন? … ক্ষিদে পেলে ও কচুরী-জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও– সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।’
পরম যত্নে নিত্যানন্দবাবু চোতাটি পকেটে ঢোকালেন। স্বামী বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ থেকে পড়লেন।
রকি নাম্বার টু: মুড়ি খাবো, কিন্তু আলুর চপ ছাড়া! গোলপার্কের স্ট্যাচুর কথা শোনা যাবে না।
রকি নাম্বার ফাইভ: নেতাই ডার্লিং, মাংসের চপটা অর্ডার দিয়ে আসি?
‘বাকিটা শোনো, আমি মোবাইলে বলে দিচ্ছি।’ নিত্যানন্দবাবু হাইটেক পদ্ধতিতে মাংসের চপ অর্ডার দিয়ে বললেন, ‘সেকালের ময়রার দোকানে ভাজা-ভুজি ছিল কিন্তু উনিশ শতকের ময়রার দোকানগুলো ঠিক আজকের তেলেভাজার দোকান হয়ে উঠেছিল বলে মনে হয় না।’
এরই মাঝে রকি নাম্বার থ্রি-র কৌতূহল বেশি। সে আগের দিন ধ্রুপদী বাংলা ভাষা ইত্যাদি শুনেছিল তাই জিগ্যেস করল, নেতাই ডার্লিং চপ কি সংস্কৃত শব্দ? কালী ঠাকুরের যা চেহারা তাকে তো সংস্কৃত থেকে আসা ধ্রুপদী দেবতা বলে মনে হয় না। কালী পুজোর দিন কালিকার চপের দোকান যখন খুলে গিয়েছিল তখন চপও সংস্কৃত থেকে আসা ধ্রুপদী শব্দ নয় বলেই মনে হয় !
নিত্যানন্দবাবু শুনে বাক্যিহারা! তিনি কী ‘আনলার্ন’ করছেন কে জানে! কিন্তু এরা যে ‘লার্ন’ করছে সন্দেহ নেই। তিনি অন্য পকেট থেকে আরেকটি চোতা বের করে বললেন, ‘‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে আমাদের জানিয়েছেন ‘চপ বি [ E chop] ভাজা মাংস খণ্ড।’ চপ কৃতঋণ শব্দ। সংস্কৃতের সঙ্গে যোগ নেই।”
রকিরা উল্লসিত হয়ে উঠল। রকি নাম্বার থ্রি বলল, ‘তার মানে চপ মানেই মাংসের চপ। আহা আহা! আলুর চপ, মোচার চপ, ঢপের চপ সব পরে বাঙালির বানানো। বিলিতি চপ দেশি চপ শিল্পে রূপ বদল করেছে।’
…………………………………………………
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: ধ্রুপদী ভাষা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটানো একটা রকের আধুনিক আড্ডা
…………………………………………………
নিত্যানন্দবাবু বললেন, ‘‘এক্কেবারে ঠিক কথা। তবে উনিশ শতকে রাস্তায় রাস্তায় চপের দোকান তৈরি না হলেও বাঙালি বাড়ির আহার তালিকায় চপ ঢুকে পড়েছিল। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী রান্নার রেসিপি লিখতেন। সুন্দর সোজা সাপটা বাংলা। পত্রিকার ফাল্গুন-চৈত্র ১৩০৫ সংখ্যায় লিখেছিলেন ‘আলুর চপ’-এর রেসিপি। সে চপ শুধু আলুর নয়, মাংসের কিমা সহযোগে ভাজা আলুর চপ।”
এরপর নেতাই ডার্লিং তিন নম্বর চোতা বের করে পড়তে লাগলেন:
“তৈয়ে বা ফ্রাইপ্যানে আধপোয়া ঘি চাপাও। ঘিয়ের ধোঁয়া বাহির হইলে পর বিস্কুট-গুঁড়া মাখা পাঁচটী আলুর চপ একেবারে ছাড়। এক পিঠ লাল হইয়া আসিলে আর এক পিঠ উল্টাইয়া দিবে। বাদামী রং হইলেই বুঝিবে ভাজা ঠিক হইয়াছে, তখন সেইগুলি নামাইয়া অন্যগুলি ভাজিবে। … আলুর চপের সহিত দুটি ভাত দিয়া খাইতে ভাল। ইহা ইংরাজী ডিনারে একটা … সাইড ডিসরূপে ব্যবহার হইবে। আমাদের সকালে ডাল ভাতের সঙ্গে এবং রাত্রে লুচির সঙ্গে দেওয়া যাইতে পারে।”
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..
রকিগণ বলিয়া উঠিলেন, ঊনবিংশ শতক বিগত হইয়াছে। তাঁহারা রাস্তার দোকান হইতে আলাদা করিয়া আলুর চপ ও মাংসের চপ খাইবেন। প্রজ্ঞাসুন্দরীর বিধি চুলোয় যাক। আসন্ন কালীপুজোয় নেতাই ডার্লিং তাহাদের নানাবিধ চপ কালিকায় না খাওয়াইলে তাহারা নেতাইকে কিছুই শিখাইবেন না।
অতঃপর, জয়কালী কলকাত্তাওয়ালি/ চপে চপে ভরাও দেওয়ালি।