নাম না জানা দাদা আমায়, আমার স্ত্রী বাবলির জন্য একটা ফুল নেওয়ার অনুরোধ নিয়ে এসে আমার উত্তরে থমকে গেলেন। বাবলি আধা জার্মান আধা বাঙালি ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঙালিরা ওকে বাঙালি ভাবে না। আমি তো এমনিতেই আমার নিজের দেশেই রাবণ বংশীয় বা জংলি ক্যারিবিয়ান। এই দাদাও ইতালিয়ানে প্রশ্ন করে যখন উত্তরটা বাংলায় পেলেন, ‘না দাদা, অহন লাগবা না’ একটু থমকে গিয়ে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বাঙালি নাকি বাইয়া?’
ফুল বিক্রি করা দাদাকে নাম জিজ্ঞেস করা হল না। ভাঙা না, বেশ পোক্ত ইতালিয়ানে টেবিলে টেবিলে বিরক্ত করা এই হাসিমুখ দাদারা মিলানের গ্র্যান্ড ক্যানেলের ধারে ঘুরে ঘুরে ফুল আর ফোনের চার্জার বিক্রি করেন। একটু আধটু ইতালিয়ান গানও গুনগুন করেন। মাঝে মাঝে হাতে ভুট্টার দানা গুঁজে দিচ্ছেন বড় বড় চৌরাস্তার মোড়ে পায়রাদের খাবার দেওয়ার নাম করে, তারপর বলছেন ‘ফটো! গুড ফটো!’
এঁরা খুবই চেনা মানুষ। খুবই চেনা গল্প এঁদের। এঁদের আমরা সবাই চিনি। পৃথিবীর এক একটি প্রথম বিশ্বের বড় বড় শহরে এঁদের নতুন নতুন মোড়কে পাবেন। এক এক শহরে এক এক দেশের পরিযায়ীর এক একটা মোড়ক।
২০১৭-এ যখন এঁদের শেষ মিলানে দেখেছি, তখন ছিল পেন আর ফুল, চার্জারটা বোধহয় নতুন সংযোজন। এঁদের গল্প বেচে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল রমরমিয়ে চলছে সর্বত্র। এঁরা যত কষ্ট করে ফুল বিক্রি করেন, তার চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে এঁদের নিয়ে হিট ছবি বানানো। কোথায় যুদ্ধ, কোথায় রিফিউজি-ক্রাইসিস– এসবের নিয়মিত খবর ঠিকঠাক রাখলে আর মনে মনে পাপ দূরীকরণ করার বাসনা থাকলে বুঝবেন যে ইউরোপে শহরে শহরে এঁরাই, মানে এঁদের গল্পই প্রোগ্রেসিভ আর্ট প্র্যাকটিস করার মূলধন। সম্পদ। এঁদের খিদে, ক্লান্তি যতদিন আছে, ততদিন এঁদের নিয়ে সাহিত্য হবে, সিনেমা হবে। বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, নেপাল, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া কিংবা আফ্রিকার কোনও একটি দেশ থেকে আসা বহুভাষী সেজে ঘুরে বেড়ানোর এই গল্প এখন শুধু আর্ট হাউস ছবি বানানোর খোরাক না।
ফুলগুলো সম্ভবত বাসি। ফ্লোরিস্টের বেঁচে যাওয়া ফুল ফেলে দেওয়ার আগে সেগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে প্যাকেট করে ভরে নিয়ে এসে যত্ন করে তাঁদের কাঁটা আর শুকনো পাতা ছেঁটে বাদ দিয়ে বড়ভাই তাতে চিনির শিরা মিশিয়ে ফুলগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য পুনরায় বাঁচিয়ে তোলেন। এই গোলাপ ফুলগুলো, কিছু পচে যাওয়া প্রাচীন ইতালিয়ান নস্ট্যালজিক পপ গান, মিলানের চমকে দেওয়া মিহি কমলা রোদ্দুর, ক্যানালের ধারের হালকা মেছো পচা গন্ধ, সস্তার এপারাতিভো, বেড়াতে আসা মধ্য বয়স্ক দম্পতির হাতে হাতে খাবার প্যাকেজের সঙ্গে ফ্রি-তে পাওয়া সবুজ বা লাল বা অরেঞ্জ ককটেল, বহু স্টুডেন্ট প্রেমিক-প্রেমিকার ফিটফাট হয়ে সেজেগুজে সাহস করে একদিনের বেড়াতে বেড়িয়ে সিনেমার মতো করে ব্রিজে দাঁড়িয়ে চুমু খাওয়া, তারপর চট করে তাকিয়ে দেখে নেওয়া চেনা জানা কেউ আছে কি না, ইতালির সুপ্রাচীন ইটের দেওয়ালে ঘেরা অপূর্ব প্রাচীন বাড়ি, ক্যানেলের জলে একে একে চলে যাওয়া সুসজ্জিত ডিঙি বা গন্ডোলা, যাই বলুন সব মিলিয়ে মিলান কিন্তু রোজ বিকেলে রঙে, ঘ্রাণে, স্বাদে, শব্দে জমজমাট।
নাম না জানা দাদা আমায়, আমার স্ত্রী বাবলির জন্য একটা ফুল নেওয়ার অনুরোধ নিয়ে এসে আমার উত্তরে থমকে গেলেন। বাবলি আধা জার্মান আধা বাঙালি ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঙালিরা ওকে বাঙালি ভাবে না। আমি তো এমনিতেই আমার নিজের দেশেই রাবণ বংশীয় বা জংলি ক্যারিবিয়ান। এই দাদাও ইতালিয়ানে প্রশ্ন করে যখন উত্তরটা বাংলায় পেলেন, ‘না দাদা, অহন লাগবা না’ একটু থমকে গিয়ে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘বাঙালি নাকি বাইয়া?’
–‘জী। আবনের ইহানে কুন যাগায় বাসা?’
………………………………………………….
মিলানের চমকে দেওয়া মিহি কমলা রোদ্দুর, ক্যানালের ধারের হালকা মেছো পচা গন্ধ, সস্তার এপারাতিভো, বেড়াতে আসা মধ্য বয়স্ক দম্পতির হাতে হাতে খাবার প্যাকেজের সঙ্গে ফ্রি-তে পাওয়া সবুজ বা লাল বা অরেঞ্জ ককটেল, বহু স্টুডেন্ট প্রেমিক-প্রেমিকার ফিটফাট হয়ে সেজেগুজে সাহস করে একদিনের বেড়াতে বেড়িয়ে সিনেমার মতো করে ব্রিজে দাঁড়িয়ে চুমু খাওয়া, তারপর চট করে তাকিয়ে দেখে নেওয়া চেনা জানা কেউ আছে কি না, ইতালির সুপ্রাচীন ইটের দেওয়ালে ঘেরা অপূর্ব প্রাচীন বাড়ি, ক্যানেলের জলে একে একে চলে যাওয়া সুসজ্জিত ডিঙি বা গন্ডোলা, যাই বলুন সব মিলিয়ে মিলান কিন্তু রোজ বিকেলে রঙে, ঘ্রাণে, স্বাদে, শব্দে জমজমাট।
………………………………………………….
এই দিয়ে গপ্পো শুরু, তারপর ওর মাদারীপুর থেকে জাহাজে পালিয়ে আসার ঘটনা, কতজন ক্যাম্প করে আছেন, এখন মাত্র ছয় মাসের একটা অ্যাসাইলাম অ্যাপ্লাই করে একটা কাগজ অবধি পৌঁছেছেন, বাসায় মাসে কত করে টাকা পাঠান এজেন্টের হাত দিয়ে, এইসব হয়ে গপ্পো যখন ‘আমার আম্মু আসলে বরিশালের’ এইখানে এসে পৌঁছেছে, তখন আমিও বলে উঠলাম, ‘আমার মার বাড়িও বরিশাল’। এটা এত পরিষ্কার কলকাতার বাংলায় বলে ফেলায় উনি হেসে ফেলে বাবলিকে একটা ফুল এমনিই দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন ‘আর বায়ার বাসা কি ইন্ডিয়া নাকি?’
‘জী, কলকাতা।’
‘এ কি আবনে আমায় টাকা দিসেন ক্যান?’ ২০ ইউরো অনেক টাকা! কনভার্ট না করলেও অনেক! প্রায় সারা বিকেল ফুল বেচলেও এত টাকা হয় না।
‘ঈদ গেসে কদিন মাত্র হল, হ্যার লিগা দিলাম।’
শুনে হাসলেন। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে হাসি আরেকটু উদাস হল, তারপর প্রায় বিদ্রুপের কাছাকাছি পৌঁছতে, সুপাড়ি খাওয়া দাঁত বেড়িয়ে এল দাদার।
‘হম! আর এ দেশে ঈদ বায়া! যাইগ্গা, বাসায় অন্তত পোলাপাইন, আম্মু-আব্বু কডা টাকা পাইসে, নতুন কাপড় জামা কিনসে, আলহামদুলিল্লাহ…’
এই আদল আমার পরিচিত আদল। এই হতাশা আমার আরও পরিচিত। এই পরিচয় আমায় স্বস্তি দেয়। মায়ের মতো করে বলে, ‘দুঃখ আছে, হতাশা আছে। অপেক্ষা আছে নতুনের। ভাগ্যিস আছে! এই হতাশ লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে আমায় দেশের গন্ডিতে মাপবে না।’
……………………………………….
পড়ুন মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: যে গ্রন্থাগার তৈরি করেছে কমিউনিটির বোধ
……………………………………….
লোকটা চলে যাওয়ার পর অন্তত আরও জনা-বিশেক দাদাদের ‘লাগবা না বায়া’, ‘নো, থ্যাংক ইউ’ বললাম। তারপর যখন ঘণ্টাদুয়েক আরও আড্ডা মেরে খাবারের বিল চুকিয়ে, বেশ উঠব উঠব করছি, মিলানের ক্যানালে তখন সন্ধ্যের লালচে কমলা আভা নেমেছে। মেঘগুলো ছোট ছোট উড়ে যাওয়া জন্তুর মতো মাঝে মাঝে সূর্যকে ঢেকে ফেলছে। তারপর একটু পরে, বেঘোরে সরে গেলেই দেখছি সূর্য আরও নিচে নেমে এসেছে। প্রায় সাড়ে আটটায় সূর্যাস্ত। লাল আরও গাঢ় হয়েছে। দু’জন কিশোর-কিশোরী প্রবল মুখ ভার করে বসে সিগারেট খাচ্ছে। ঝগড়া, অভিমান, প্রেম, সিনেমা, গান যাই বলি না কেন মিলানের এই টুরিস্ট গ্র্যান্ড নাভিলির ধার এখনও বেড়াতে আশা মধ্যবিত্ত সাধারণের জন্য অনেক কিছু।
হঠাৎ মনে হল, ওই লোকটার নাম জানলে মন্দ হত না।
এটাই মজার যে বেনামি এমন খেটে খাওয়া বেআইনি হাসিমুখ বহুভাষী নাটুকে দাদাদের ২০ ইউরোর চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষা নেই। ওটুকু টাকা উঠে এলে সেদিনের মতো হাওয়া। অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে লোকটাকে খুঁজেছি। সবাই আছে, সব আছে, দেখা না দেখা মুখ, হোর্ডিং, পোস্টার, গন্ধ…
কিন্তু ওনাকে আর দেখলাম না।
মাদারীপুর যাইনি। বরিশাল একবার গেছি। আমাদের সবার মা-বাবার মুখের বর্ণনা মতো দেশের জমিজমা এক করলে তিন-চারটে বাংলাদেশ হবে। লর্ড ভানুর মতো আমরা সবাই মনে মনে লর্ড। মানে হওয়ার কথা ছিল ল্যান্ডলর্ড, শুধু ল্যান্ডটুকু নেই, এই যা। যদি ওই দাদার মতো অল্পে খুশি হতে পারতাম, বেশ হত!
একটা পুরোনো কবিতা খুঁজে পেলাম।
‘যতই খুঁড়ি যতই বার করে আনি
এই সব পাকের তলায়
এখনো সোনালী সিনেমা
আর কারিগর বিড়ি ফ্যাক্টরি।
ভাদ্রের সোনালী আলোয়
ঝলমলে কীর্তনখোলার গায়ে ঘাটে বাঁধা নৌকোর সারি
টাউনহলের সামনে বেল বটম পরা কিশোর
তর্ক জুড়েছে শিক্ষকের সাথে
রজনীগন্ধার গন্ধ ছড়িয়ে
পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সাইকেল নিয়ে
হাফ প্যাডাল করে
ফ্রক পরা কোঁকড়া চুলওয়ালা একটি মেয়ে
আমি তাই চুল কাটিনা
নেপালের মহাপ্রাচীন রাস্তায়
ওই টাউনহলের কিশোরীকে পাবো কি?
কিংবা পাহাড়ি গ্রামের ড্রেনের ওপারে
যেখানে দেশের সীমানা হারিয়ে যায়,
সেখানে ফুলের গন্ধে ম ম করছে রাতে,
ও কি গো?
রডোডেনড্রন না রজনীগন্ধা?
আমার ছাদে পড়ে থাকা আমের বোলে
বরিশাল এসে হাজির হয়।
তাও কান্নার প্লাবনে ভেসে যায় আম্রপল্লব
কোন দেশে যাবে জানে না ওরা
এইটুকু জানে
আরো অনেক পথ পেরোনো বাকি।
চাঁদপুরের জ্যোৎস্না বলে কথা
তারপর তো বরিশাল।
সেখানেই আমার বৃদ্ধা কিশোরীর বাড়ি।’