আত্মপ্রকাশেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল নাচঘর। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা দু’টি বার ছাপতে হয়েছিল, এমনকী, চতুর্থ সংস্করণও হয়েছিল বলে শোনা যায়। প্রথম সংখ্যা থেকেই সম্পাদকদের নাম থাকলেও অনেক লেখাই ছিল অস্বাক্ষরিত। প্রথম দফতর ছিল ৯০/২৩ হ্যারিসন রোড, পরে যা মৌচাক পত্রিকারও কার্যালয় ছিল। নিয়মাবলি পরিষ্কার জানিয়েছিল যে এ পত্রিকায় কোনও রকম রাজনৈতিক আলোচনা থাকবে না। তবে একটু মজা করে নাটক-থিয়েটারের খবর দিতে গিয়ে পলিটিক্সের কথাও এসেছে।
থিয়েটারের পরিবেশ তখন রীতিমতো একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের। থিয়েটারে যান না আর, বাড়িতে বসেই লেখালেখি করেন। একদিন হঠাৎ বাড়ির বৈঠকখানায় বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে শুনলেন বাজখাঁই গলার ডাকাডাকি। দরজা খুলে দেখলেন সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অভিনেতা সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। গোবরবাবু, মানে গোবর গুহের আখড়ায় কুস্তি লড়ে লড়ে বপুখান যাঁর বিপুল হয়ে উঠেছিল। তারপর কুস্তি ছেড়ে তিনি থিয়েটারে ঢোকেন। হেমেন্দ্রকুমারের বিবেচনায় যাঁর বুদ্ধি কিছু মোটা, কতকটা গোঁয়ার-গোবিন্দ মানুষ।
তা, শুনলেন এ হেন সতীশচন্দ্রের ওপর দায়িত্ব পড়েছে হেমেনবাবুকে নিয়ে মনোমোহন থিয়েটারে যাওয়ার। দায়িত্ব যিনি দিয়েছেন সেই প্রবোধচন্দ্র গুহ, মনোমোহন থিয়েটারের মালিক, বলে দিয়েছেন বেগড়বাঁই করলে হেমেন্দ্রকুমারকে যেন কোলে ক’রে তুলে নিয়ে আসা হয়।
প্রবোধচন্দ্র সম্পর্কে তখন কিছুটা বিরূপই হয়ে আছেন হেমেন্দ্রকুমার। তার কারণ তখন তিনি সম্পাদনা করেন ‘নাচঘর’ পত্রিকা, যার পাতায় পাতায় থাকত শিশিরকুমার ভাদুড়ীর প্রশস্তি। আর তখন স্টার থিয়েটারের অনুগত ছিল আর একটি সাপ্তাহিক, যারা নিয়মিত নাচঘর-এর বিপক্ষে লিখত। আর এর উৎসাহদাতা প্রবোধচন্দ্রই, সন্দেহ করতেন হেমেন্দ্রকুমার।
শতবর্ষ আগে যার আত্মপ্রকাশ সেই নাচঘর নিছক নাটক-সিনেমা-থিয়েটার ঘিরে একটি পত্রিকা ছিল না, ছিল প্রাণবন্ত একটি সাংস্কৃতিক সময়ের রোজনামচা।
সচিত্র পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ ২৬ বৈশাখ ১৩৩১, ১৯২৪-এর এপ্রিল মাসে। তার আগে থিয়েটার ঘিরে মাসিক নাট্যমন্দির, মজলিশ এবং শিশির প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছিল অমরেন্দ্রনাথ দত্তের মাসিক ‘নাট্যমন্দির’। সে কালের সংবাদ ও সাময়িকপত্রে থিয়েটারের অবহেলা নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাই সে পত্রিকার প্রকাশের কৈফিয়ত দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সকল সম্প্রদায়ের মুখপাত্রস্বরূপ সংবাদপত্র আছে, কিন্তু রঙ্গালয়ের কিছুই নাই। টিকিট না পাইয়া বিরক্ত হইয়া যাহা লেখেন, তাহা শুনিতে হয়। কিন্ত অনেকদিন শুনিয়া আসিতেছি, আর শুনিতে ইচ্ছুক নহি।’
আর নাচঘর ২ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১-এর ২য় সংখ্যায় লিখছে, ‘‘কোন দৈনিক পত্রে সাধারণকে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছে যে শ্রীযুক্ত শিশিরকুমার ভাদুড়ী নাচঘরের ব্যয়ভার বহন করছেন এবং আমরা নাকি স্টার রঙ্গালয়ের শক্রপক্ষ। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, ‘নাচঘরে’-র সঙ্গে শিশিরবাবুর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। ‘নাচঘরে’-র স্বত্বাধিকারী হচ্ছেন এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স-এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী শ্রীযুক্ত সুধীরচন্দ্র সরকার। শিশিরবাবু কেন, কোনো রঙ্গালয়ের স্বত্বাধিকারীর সঙ্গেই কোনোরূপ আর্থিক সম্বন্ধ রাখা আমাদের চলবে না। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য কোনো রঙ্গালয়ের জন্য দালালি করা নয়—তার দোষ গুণ বিচার করা।…আমরা যে স্টার রঙ্গালয়ের শত্রু, তার উত্তরে এইটা বল্লেই যথেষ্ট হবে যে কর্ণার্জুনের প্রথম অভিনয়ের পরে আমরা প্রকাশ্যভাবে নাম দিয়ে তার সুখ্যাতিমূলক সমালোচনা করেছিলুম। স্টারের কর্তৃপক্ষ বোধ হয় সে কথা এখনো ভোলেননি। প্রশংসার অবসর পেলে ভবিষ্যতে প্রশংসা করব– সে বিষয়েও আমাদের কোন সংশয় নেই।’’
শিশিরকুমারকে, তাঁর নতুন অভিনয়রীতিকে নাচঘর যে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখত সে কথা না-মেনে উপায় নেই। নাচঘর-এর মালিক সুধীরচন্দ্র তাঁর আমার কাল আমার দেশ স্মরণীতে লিখেছেন, ‘‘বাংলার নাট্যজগতের কর্মতত্পরতা যখন ১৯২১ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত পূর্ণোদ্যমে চলেছে– অর্থাৎ নাট্যমন্দিরে শিশির সম্প্রদায়ের সীতা, আলমগীর, ষোড়শী, দিগ্বিজয়ী, শেষ রক্ষা প্রভৃতি, আর্ট থিয়েটারের পরিচালনাধীনে স্টারে কর্ণার্জ্জুন, সাজাহান, চাঁদ সদাগর, চণ্ডীদাস, মন্ত্রশক্তি, মিনার্ভায় কিন্নরী, আত্মদর্শন, ব্যাপিকা বিদায় প্রভৃতি– তখন রঙ্গালয় সম্বন্ধে কয়েকটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় থিয়েটারের খবর ফলাও করে প্রকাশিত হতে শুরু করে। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আর্ট থিয়েটারের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয়। তাতে শিশির সম্প্রদায়কে নানারকম কুৎসা করতে শুরু করে। শিশিরকুমারের সঙ্গে আমাদের দলের হৃদ্যতা ছিল অত্যন্ত বেশী। আমিও তখন একটি পত্রিকা প্রকাশ করি– নাম ‘নাচঘর’। এতে শিশির সম্প্রদায়কে সমর্থন করে যাবতীয় খবর নানারকম বিবরণ, নাট্য-সাহিত্য সম্বন্ধে উচ্চাঙ্গের লেখা প্রভৃতি থাকত। সে পত্রিকার আমিই ছিলাম প্রকাশক ও স্বত্বাধিকারী।’’
হেমেন্দ্রকুমার রায় আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সম্পাদিত নাচঘর-এর প্রথম সংখ্যায় অবশ্য কেবল নাটকই ছিল না। সূচি বলছে, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে বায়োস্কোপের কথা, নৃত্যকলার নতুন প্রস্তাব, রঙ্গালয়ের বাইরে, চলচ্চিত্রের চলতি কথা-র মতো লেখা। পত্রিকা বেরত আট পৃষ্ঠার, অনেকটা খবরের কাগজের চেহারায়। তবে এ চেহারা বেশিদিন টেকেনি। প্রথম সংখ্যায় ঘোষণা করা হয়েছিল, আসছে হপ্তা থেকে নাচঘরে নিয়মিত অভিনয়-সমালোচনা শুরু হবে।
আত্মপ্রকাশেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল নাচঘর। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা দু’টি বার ছাপতে হয়েছিল, এমনকী, চতুর্থ সংস্করণও হয়েছিল বলে শোনা যায়। প্রথম সংখ্যা থেকেই সম্পাদকদের নাম থাকলেও অনেক লেখাই ছিল অস্বাক্ষরিত। প্রথম দফতর ছিল ৯০/২৩ হ্যারিসন রোড, পরে যা মৌচাক পত্রিকারও কার্যালয় ছিল। নিয়মাবলি পরিষ্কার জানিয়েছিল যে এ পত্রিকায় কোনও রকম রাজনৈতিক আলোচনা থাকবে না। তবে একটু মজা করে নাটক-থিয়েটারের খবর দিতে গিয়ে পলিটিক্সের কথাও এসেছে। টুকরো খবরের মতো করে লেখা হয়েছে,
শ্রীযুক্ত নির্মলচন্দ্র দত্ত মহাশয় ‘বৈকালী’র সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন এবং এই কাগজখানির সঙ্গে এখন স্টার-রঙ্গালয়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়েছে। এখন দেখা যাক্ বাংলার পলিটিক্স রঙ্গালয়ে পরিণত হয়, কি বাংলার রঙ্গালয় পলিটিক্সে পরিণত হয়।
থিয়েটার-সিনেমার টুকরো খবর দিতে গিয়ে নাচঘর-এর প্রথমে দু’টি নিয়মিত বিভাগ প্রকাশিত হতে থাকে। ‘রঙ্গ-রেণু’ ও ‘নাট্য-জগৎ’। দু’টিই অস্বাক্ষরিত। রঙ্গ-রেণু বেশ ব্যঙ্গমূলক ছিল। নাট্য-জগৎ ছিল অনেকটা সম্পাদকীয় গোছের।
বাংলা থিয়েটারের নাচের পরিকল্পনা এবং গান লেখা– এই দু’টি বিষয়ে হেমেন্দ্রকুমার রায় ইতিহাস হয়ে আছেন। অভিমান করা সত্ত্বেও তাঁকে দিয়ে গান লেখানোর জন্যই প্রবোধচন্দ্রের ওই কোলে-তুলে-নিয়ে-যাওয়ার ফরমান ছিল। আর, নাটকে আধুনিক ও সমকালীন নাচের প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। নাচঘর তার একটা প্রধান সহায় ছিল। প্রথম সংখ্যাতেই তাই নৃত্যকলার নতুন প্রস্তাব দিয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার। পরে স্মৃতিচারণ আমি যাঁদের দেখেছি-তে লিখেছেন,
ভারতনাট্যম্, কথাকলি, মণিপুরী বা কত্থক প্রভৃতি নৃত্য প্রচুর প্রশস্তি লাভ করেছে, কিন্তু ওদের কোনটির মধ্যেই প্রকাশ পায় না আধুনিক যুগধর্ম, ওরা প্রাণপণে আঁকড়ে আছে অতীতকেই। আমরা ওদের দেখি, খুসি হই, উপভোগ করি, অভিনন্দন দি, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার কোলে মানুষ হয়ে ওদের প্রাণের আত্মীয় ব’লে মনে করতে পারি না, কারণ ওদের মধ্যে খুঁজে পাই না বর্তমানের প্রাণবস্তু। এইজন্যেই উদয়শঙ্কর যখন অতীতের সঙ্গে যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন রেখে নব নব পরিকল্পনায় আধুনিক মনের খোরাক জোগাবার ভার গ্রহণ করলেন, তখনই তিনি হয়ে উঠলেন আবালবৃদ্ধবনিতার প্রেয় স্বজন। তাঁরও বিশেষ গুণপনা এবং সৃষ্টিক্ষম প্রতিভার দিকে সর্বপ্রথমে বাংলাদেশের রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিল মৎসম্পাদিত “নাচঘর” পত্রিকাতেই।
শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়, উদয়শঙ্করের নাচ– বিশ শতকে বাঙালির সাংস্কৃতিক আধুনিকতাকে নিয়মিত উতসাহের আলো জুগিয়েছে যে পত্রিকা, শতবর্ষে তা-ই এখন বিস্মৃতির ধুলো-পড়া অন্ধকারে!
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।