সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র দেখার জায়গা নয়, বরং এটি চলচ্চিত্র-আমোদীদের জন্য একটি সম্মিলন স্থান (কমিউনিটি কনভার্জেন্স স্পেস) হিসেবে কাজ করত। যেখানে মানুষ একত্রিত হত, আবেগ ভাগ করে নিত এবং একসঙ্গে হাসত-কাঁদত। সিনেমার পর্দায় যা ঘটত, তা শুধুই দৃশ্যমান কাহিনি ছিল না, বরং তা দর্শকদের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটাত। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ– ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– প্রত্যেকে একই ছাদের নিচে বসে সিনেমার গল্পের সঙ্গে একাত্ম হত, যা এক অদৃশ্য সামাজিক বন্ধন তৈরি করত।
প্রচ্ছদ-ঋণ: বিজয় চৌধুরী
সে এক সময় ছিল। ‘সিনেমা’ মানেই জনতার ঢল, উৎসব উৎসব ব্যাপার। ছোট শহর, মফস্সল, এমনকী, গ্রামের প্রান্তে একটা সিঙ্গল স্ক্রিন হলই ছিল বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু। সকালের শো থেকে শুরু করে রাতের শেষ শো– টিকিট কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন, ব্ল্যাকে বিক্রি হত টিকিট। দর্শকের হাততালি, শিস। পর্দায় নায়কের এন্ট্রিতে উত্তেজিত ভক্তকুল আসনে দাঁড়িয়ে জামা খুলে নাচানাচি শুরু করে দিত। আর দর্শকের চোখে-মুখে থাকত উত্তেজনা, আবেগ ও রোমাঞ্চ। কিন্তু আজ প্রশ্ন উঠছে, এই ‘জনতার সিনেমা হল’ কি আর সত্যিই জনতার আছে?
১৯৯০ সালে ভারতে ২৫০০০ হাজার সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা (Single Screen Theatre) হল ছিল এবং বর্তমানে মাত্র ৬২০০ চালু রয়েছে। ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৭৫০ থেকে ৯০০ সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল ছিল। সংখ্যাটা এখন মাত্র ২০০ সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল-এ নেমে এসেছে। তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই জানেন না এই সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন বাঙালি সাংস্কৃতিক আইকন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। কলকাতার হাতিবাগানই একসময় পরিচিত ছিল ‘সিনেমাপাড়া’ হিসেবে। এই তরুণ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার আগেই হারিয়ে গিয়েছে নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে চলচ্চিত্র দেখার সংস্কৃতি। আর সিনেমাপাড়াও হারিয়েছে তার ঐতিহাসিক গৌরব।
গোটা হাতিবাগান এলাকায় মোট ১২টি সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার ছিল– ‘দর্পণা’, ‘মিনার’, ‘রূপবাণী’, ‘খান্না’, ‘বিধুশ্রী’, ‘পূর্ণশ্রী’, ‘স্টার’, ‘টাকী শো হাউস’, ‘রাধা’, ‘উত্তরা’, ‘শ্রী’ ও ‘মিত্রা’। বর্তমানে এই ১২টি থিয়েটারের মধ্যে ‘বিনোদিনী’ (স্টার) ও ‘মিনার’– মাত্র এই দু’টি থিয়েটার সক্রিয় রয়েছে আর বাকি সমস্ত থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে অথবা শপিং মল, চোখের চিকিৎসালয়, সোনার দোকান বা বসতবাড়িতে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কিছু জনপ্রিয় সক্রিয় সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার হল ‘প্রিয়া’ (কলকাতা), ‘নবীনা’ (কলকাতা), ‘চৈতালি’ (সিউড়ি), ‘রূপকথা’ (মালদা), ‘বিশ্বদ্বীপ টকিজ’ (শিলিগুড়ি) প্রভৃতি।
বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ সিঙ্গল স্ক্রিন (Single Screen Theatre) হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, নয়তো অস্তিত্ব সংকটে। সাধারণ জনগণের জন্য তৈরি হয়েছিল এই হলগুলো, বর্তমানে তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চমূল্যের মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতি। একে তো টিকিটের উচ্চ দাম, তার ওপর পপকর্ন-জলের বিল, আর অতিরিক্ত যাতায়াত খরচ– সব মিলিয়ে চলচ্চিত্র দেখা যেন এখন অভিজাত শ্রেণির বিনোদনে রূপান্তরিত।
একসময় সিনেমা হল ছিল কেবল রুপালি পর্দা নয়, বরং একটি জনগণের ‘সাংস্কৃতিক পরিসর’– যেখানে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ একসাথে বসে জীবনের গল্প দেখত, আনন্দ করত, প্রশ্ন তুলত। কিন্তু আজ আমরা ক্রমেই এমন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করছি যেখানে সিনেমা হল আর ‘জনতার’ নয়– বরং এক ধরনের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনার প্রতীক হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তনের ফলে, শুধু একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ পার্থ চট্টোপাধ্যায় একটা পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল, তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণের সংস্কৃতি তখনই টিকে থাকে, যখন তার জন্য পরিসর বজায় থাকে। সেই পরিসর যদি সংকুচিত হয়, সংস্কৃতিও প্রান্তে চলে যায়।’
সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল ছিল এক ধরনের সমতা রক্ষাকারী ক্ষেত্র– যেখানে জাত, শ্রেণি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাই একসাথে বসে সিনেমা দেখত। সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারে দর্শকের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। আজ তা শুধুই স্মৃতি। এই প্রসঙ্গে ইয়ুর্গেন হাবারমাস তাঁর ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ তত্ত্বে যে যুক্তি তুলে ধরেন, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক পরিসর, যেমন সিনেমা হল ও হল চত্বর একসময় ছিল নাগরিক মত প্রকাশ ও সামাজিক সংলাপের ক্ষেত্র।
একসময় সিনেমা হলগুলো ছিল এমনই এক ‘পাবলিক স্ফিয়ার’। সিঙ্গল স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহে রিকশাচালক, দোকানদার, ছাত্র, নারী, বয়স্ক– সবাই একসঙ্গে বসে চলচ্চিত্র উপভোগ করতেন। এই অভিজ্ঞতা শুধুই বিনোদন ছিল না, বরং এক ধরনের সামাজিক সংলাপ ও অভিন্ন অভিজ্ঞতা তৈরি করত।
সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার শুধুমাত্র একটি চলচ্চিত্র দেখার জায়গা নয়, বরং এটি চলচ্চিত্র-আমোদীদের জন্য একটি সম্মিলন স্থান (কমিউনিটি কনভার্জেন্স স্পেস) হিসেবে কাজ করত। যেখানে মানুষ একত্রিত হত, আবেগ ভাগ করে নিত এবং একসঙ্গে হাসত-কাঁদত। সিনেমার পর্দায় যা ঘটত, তা শুধুই দৃশ্যমান কাহিনি ছিল না, বরং তা দর্শকদের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটাত। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ– ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত– প্রত্যেকে একই ছাদের নিচে বসে সিনেমার গল্পের সঙ্গে একাত্ম হত, যা এক অদৃশ্য সামাজিক বন্ধন তৈরি করত। চলচ্চিত্র দেখা ছিল শুধু বিনোদন নয়, বরং এটি ছিল উৎসবের মতো, যেখানে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি মানেই ছিল মানুষের ঢল, দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করা, পরিচিত-অপরিচিতদের সঙ্গে একসঙ্গে চলচ্চিত্র উপভোগ করা এবং হলের গর্জনে নায়কের সংলাপের প্রশংসা করা।
স্থানীয় সংস্কৃতি, রাজনীতি, প্রেম, বন্ধুত্ব এবং সামাজিক সম্প্রীতি– এইসব কিছুর সাক্ষী ছিল সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটার। এটি ছিল এমন এক স্থান, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকা প্রথমবার হাত ধরত, বাবা তার সন্তানের সঙ্গে প্রথম চলচ্চিত্র দেখতে আসত, বন্ধুরা একসঙ্গে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সিনেমা দেখত, আর সাধারণ মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাস্তব জীবনের কষ্ট ভুলে যেতে পারত। থিয়েটারের চারপাশে চায়ের দোকান, শিঙাড়ার দোকান ও ফুচকার স্টল এবং পরিবহন ব্যবস্থাকে প্রাণবন্ত রাখত। এগুলি স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারের পরিবেশ ছিল ব্যক্তিগত নয়, বরং এক সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা, যা আজকের ডিজিটাল যুগে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও মাল্টিপ্লেক্সের ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিনোদন ব্যবস্থায় হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় যে স্থান ছিল আনন্দ ও সংযোগের কেন্দ্র– প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা এবং আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স সংস্কৃতির ফলে তা ধ্বংসের পথে। এর অস্তিত্ব কেবলই একটি সিনেমা হল নয়, বরং একটি সময়ের সাক্ষী হিসেবে, যেখানে আবেগ, সংস্কৃতি, স্মৃতি ও সামাজিক সম্পর্ক এক সুতোয় গাঁথা ছিল– যা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এবং তার সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সম্মিলিত অভিজ্ঞতার মূল্যবান মুহূর্তগুলো।
গত আড়াই বছর এই বিষয়ে গবেষণা করার সূত্রে লক্ষ করেছি যে, কলকাতার মধ্যবয়স্ক ও বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ‘সিনেমা-গোয়িং’-এর ক্ষেত্রে ‘কালচারাল মেমোরি’ নিয়ে বেঁচে আছেন। এই অভিজ্ঞতা স্থান, কাল এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে– যা স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। ‘লিটারেসি’ শব্দটা বহুল প্রচলিত হলেও ‘সিনেমাসি’ কথাটা সচরাচর শোনা যায় না। সিনেমা হলে যে কেউ যেতে পারেন এবং একজন নিরক্ষর মানুষও নিজের মতো করে চলচ্চিত্র বোঝার ক্ষমতা রাখেন। হয়তো বোঝার ক্ষেত্রে তারতম্য হতে পারে। এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার সূত্রে কিছু মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে যে, বর্তমানে এমন এক শ্রেণির দর্শক রয়েছেন, যাঁদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা থাকা সত্ত্বেও মলের মধ্যে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে চলচ্চিত্র দেখায় তাঁরা আগ্রহী নন। আবার এমন অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁদের পক্ষে ৩০০ টাকার টিকিট কেটে মাল্টিপ্লেক্সে চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। এবং এমন এক শ্রেণির যুব দর্শক রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন সিঙ্গল স্ক্রিন থিয়েটারে চলচ্চিত্র দেখতে যাওয়া ভদ্র সমাজের জন্য অনুমোদিত নয়। একুশ শতকের তৃতীয় দশকে দাঁড়িয়ে এক পর্দার সিনেমা হল শুধুমাত্র গরিব, শ্রমজীবী মানুষ, গ্রামীণ ও শহরতলির সাধারণ দর্শকদের বিনোদন গ্রহণের স্থান হয়ে থেকে গেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, যখন ‘সিনেমা’ শব্দটি নিজেই গণমাধ্যম বা গণ-মনোরঞ্জনের প্রতীক, তখন তা থেকে জনসাধারণের বঞ্চিত হওয়া নিছকই অর্থনৈতিক নয়– এটি সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাও। জনতার সিনেমা হল অর্থাৎ সিঙ্গল স্ক্রিন যদি আবার ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে দরকার এমন উদ্যোগ, যা সিঙ্গল স্ক্রিন সংস্কৃতিকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে রক্ষা করবে এবং প্রান্তিক দর্শকের জন্য টিকিটের মূল্য ও গল্পের অন্তর্বস্তু– উভয় ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দেবে। সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল শুধু ইট-পাথরের কাঠামো নয়, এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক ডিএনএ-এর অংশ। সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হল শুধু একটি ভবন নয়; এটি ছিল, এবং আজও হতে পারে– একটি অভিজ্ঞতা, একটি সমতাভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চা। আর সেই চর্চা যেন আবার ‘জনতার’ হয়ে ওঠে, এই কামনাই।