বাঙালির প্রেতচর্চা বহুদিনের। তার আঙ্গিকের বদল হয়েছে বহুবার, সময় ও কালের আবহে। রাঢ়ের আধ্যাত্মিক জাতি বাউড়ি, বাগদি, বীরবংশী ডোম, কুশক্ষেত্র মেটেরা। তাঁদের গৌরব আর গরিমার বীরত্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালিদের প্রাচীন শিবচর্চা ও প্রেতচর্চা।
শেষ চৈত্রের গাজনে সেই বাঙালিদের আইকনিক চরিত্র শিবের আবির্ভাব! বাঙালি যেভাবে চায় তাঁকে– বীরত্বের আঁচ দিতে, ভালোবাসায় সাজাতে। বাঙালিদের সেই নিজস্ব উপাচারে শেষ চৈত্রের এই ক’দিন মদ, মাংস আর ভয়-ভীতি-বাহুবলের শ্মশান-ভৈরব হয়েই শিব আসেন মা পার্বতীর কাছে ধরা দিতে। সেখানে প্রেম, ভালোবাসা, গৃহস্থের সৌষ্ঠব, সুন্দর প্রেমের বান ডাকে শিব-সঙ্গীদের উন্মাদনায়। সেইসঙ্গে প্রেতচর্চার মড়ার মাথা বা খুলি নিয়ে চলে উদ্দাম নাচ! এ যেন জীবনে ত্যাগের ছবি।
শিবচর্চার প্রাচীন সাধনায় সাধকদের যেভাবে পাওয়া যায়, সেই অঘোরী, শৈব-সাধকের দল আসে শিবের মণ্ডপে মণ্ডপে। খানিকটা সেভাবেই শখের কৃষিদেবতা এসে ধরা দেন রাঢ়ের ভক্তদের হৃদয়ে, গাজনের এই কয়েকটা দিন। সেখানে শিব বীরত্বেরই প্রতীক! ক্ষমতা এখানে মাটির সঙ্গে লড়াই করে আসুরিক শক্তির পরাজয় ঘটিয়েছে, এসেছে আনন্দের ফসল। নন্দীভৃঙ্গীদের আস্ফালন তাই গাজনের বোলানে।
‘পোর বোলান’ শব্দটির অর্থ আঞ্চলিক লোকভাষায় প্রেতচর্চার বোলান বলেই চিহ্নিত। অনেকে প্রাচীনত্বের সঙ্গেও তুলনা করেন ‘পোর বোলান’কে। তবে এই লোকসংগীত বা লোকগীতি, যা মূলত পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশেষ ধরনের শিবপার্বতী-কেন্দ্রিক লোকসংগীত।
পূর্ব বর্ধমানের পাঁচুন্দি, কেতুগ্রাম থানার একটি পুরোনো গ্রাম। সেখানে শিবপঞ্চানন থেকে পাঁচুন্দি গ্রাম-নাম হয়েছে। বাসুদেব শিবের গাজন এখানে কয়েকশো বছরের পুরনো। সেখানেই দিবারাত্রি চলছে ভক্তদের বোলানগান আর সং প্রদর্শন। এখানকার প্রাচীন এই রীতি ‘পোর বোলান’ নামেই পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষায় এই ‘পোর বোলান’ আসলে পুরনো দিনের বোলান বলেই পরিচিত। ‘বোলান’ শব্দটি একটি বাংলা শব্দ, যা ‘বুলান’ শব্দের আকারেও উচ্চারিত হয় বহু অংশে। তবে এই দুইয়ের অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন। ‘বুলান’ শব্দের অর্থ ভ্রমণ করা বা ঘোরাঘুরি করা। এই শব্দটির সাথে সম্পর্কিত ‘বোলান গান’, যা বাংলার একটি প্রাচীন লোকসংস্কৃতির বহুরূপ যাপনে নৃত্যরত লোকগীতি। বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রাচীন ধারা বহন করছে এই ‘পোর বোলান’ও। যা চৈত্র মাসে শেষের দিকে সংক্রান্তিতে শিবের গাজন উৎসবে গাওয়া হয় মূলত। কেতুগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে নয়, মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে গাওয়া হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন উৎসবেও পরিবেশন করা হয় বোলান।
বোলান সাধারণত গ্রাম্য পরিবেশে, বিশেষ করে পাড়া ঘুরে ঘুরে গাওয়া হয় দল বেঁধে। শিব-ভক্তরা দল বেঁধে এই বোলান গান করে। এই গানগুলিতে শিবের মাহাত্ম্য, বিভিন্ন দেবদেবীর লোককাহিনি, পৌরাণিক চরিত্রকথা এবং সামাজিক ঘটনাগুলোকে নিয়ে পালা তৈরি করে নাটকের আঙ্গিকে গাওয়া হয়। বোলান গানের সঙ্গে রাঢ়ের ঢাক, ঢোল-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, নৃত্য, গীত, বহুরূপীর আদল ধরা থাকে। যা একটি বিশেষ ধরনের লোকনৃত্যগীত সহযোগে তুলে ধরা হয়।
বোলান গানের বিভিন্ন প্রকারভেদও রয়েছে, যেমন– দাঁড় বোলান, পালা বোলান, সখী বোলান আর সাধকের শ্মশান বোলান, সে তো ভয়ংকর। এই গানগুলি মূলত বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য মেখে ঘুরে বেড়ায় রাঢ়ের উঠোনে। বাংলার লোকসংস্কৃতির সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক।
ভাগীরথীর তীরে বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন গ্রামে খুবই জনপ্রিয় পোর বোলান। কেতুগ্রামের পাঁচুন্দির পোর বোলানের ২০টি দল এসেছিল শিবস্নানে। বোলানের দলের সদস্য তন্ময় দাস, সন্ময় দাস, সুকুমার দাস, শামু দাস-রা মদ, গাঁজার সেবা নিয়েই গ্রীষ্মের গরমে নামে বোলান গাইতে। রাঢ় জুড়ে শিবের নানারকমের গাজন। মধ্যে রাঢ়ের বাঁকুড়া, পুরুলিয়াতে এবং বর্ধমানের একটি অংশের গাজনে বাণফোঁড়, আগুনঝাঁপ, ভক্তকামান আর লাঠিখেলা অংশ। বাঁকুড়ার বাণেশ্বর নাচান দেখার মতো। বর্ধমানের আউশগ্রামের ধনকোড়ার গাজনে অসময়ের কদমফুল লাগে চৈত্রের গাজনে। আউশগ্রামের লবণধারের গাজনে ভক্তরা তোলেন তালগাছ।
তেমনই মুর্শিদাবাদের কাঁধির রুদ্রদেব। সেখানে হোমের বাসন জলে ডোবানো থাকে সারা বছর। কাটোয়ার ভূতনাথ আর কেতুগ্রামের বিল্লেশ্বরের বিল্লনাথের গঙ্গাস্নানে গিয়ে মুখোমুখি দেখা হলে লড়াই হবেই। ভক্তদের আপ্রাণ চেষ্টা কীভাবে রক্ষা করবে অপর ভক্তদের থেকে।
পাঁচুন্দি, নহরল, কাঁদরা, বেনিনগর, ধাধলসা, কুর্মডাঙ্গা, বীরভূমের নানুর, খাজিরে শিবকে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়া হয় চৈত্রের শেষের ঠিক আগের দিন। সেখানে যায় কেতুগ্রামের গঙ্গাটিকুরি, বন্দর গ্রামের জমিদাররাও। আজও উদ্ধারপুর-ঘাটে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, নদিয়ার শিব স্নান করতে আসে ভক্তদের মাথায় চেপে, এক এক দলের টিমে। আর চারপাশে শিব-ভক্তদের ঘিরে গান করতে করতে হাঁটে বোলানের দল। সাধক বোলানের দলে সংগ্রহ করে আনা মড়ার মাথা সেদিন শিবস্নানে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় গঙ্গায়। তারপর শিব ফিরলে শেষ চৈত্রের গাজনে অংশগ্রহণ করে যোগেশ্বর পরমবৈষ্ণব শিব।
………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………….