রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পল্লি জীবনের কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি আজও নজরনগরের শিল্প সাধনার প্রতীক হয়ে রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের হট হুইল, ম্যাচ বক্সের বহুজাতিক সংস্থার নির্মিত খেলনা গাড়ির দাপটের সামনে নজরনগরের গরুর গাড়ি এখনও মাথা উঁচু করে বেঁচে রয়েছে। নজরনগরের গরুর গাড়ি নিছক খেলনা নয়, সে হয়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার সঙ্গে আজকের সময়ের এক মিলন সেতু। সে মনে করিয়ে দেয় যে, বাঙালির ঐতিহ্য ও পরম্পরা বহু গৌরবের।
খেলনা কথাটার মধ্যে শিশুমনের কোমল সরলতা প্রকাশ পেয়েছে। শিশুমনের ভাবনার পরিসরকে প্রসারিত করে থাকে খেলনা। তাই তো বহু যুগ ধরে খেলনা শিশুমনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নির্মাণ করে চলেছে। বড়দের পৃথিবী ক্ষুদ্র সংস্করণ খেলনা হয়ে শিশুদের কাছে আসে। আর সেই সংস্করণকে ভর করে শিশু নিজের ভাবনার ব্যাপ্তিকে প্রসারিত করে চলে।
ভারতীয় সভ্যতায় খেলনার গুরুত্ব অপরিসীম। সিন্ধুসভ্যতায় চাকা লাগানো পোড়ামাটির মাটির খেলনার নিদর্শন দেখা যায়। আমাদের বাংলাতেও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রত্ন খনন করে পোড়ামাটির চাকা লাগানো খেলনা পাওয়া গিয়েছিল। আজকের আধুনিকতার যুগে পোড়ামাটির চাকা লাগানো খেলনার সেই গৌরবের ঐতিহ্যকে সাড়ম্বরে বজায় রেখেছেন উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া নজরনগর পালপাড়ার শিল্পীরা। প্রতিবছর চড়ক মেলা উপলক্ষে পোড়ামাটির চাকা লাগানো নৌকা, গরুর গাড়ি, ঘোড়া বিপুল পরিমাণে তৈরি করে থাকেন শিল্পীরা। এছাড়াও সুদৃশ্য পালকি, টেপা শ্রেণির বর-বউ পুতুল, রান্নাবাটি, এবং আধুনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পোড়ামাটির তৈরি চাকা লাগানো বাস, গাড়িও তৈরি করেন শিল্পীরা। আজকের সময়ে যখন বিদেশি চিনা খেলনা বঙ্গের বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে; সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আঙুল ও তুলির অনুপম ছোঁয়ায় গ্রামীণ শিশুমনকে মোহিত করে চলেছে নজরনগর শিল্পীদের তৈরি মাটির খেলনা (Najarnagar Clay Dolls)।
পল্লি জীবনের প্রতীক হচ্ছে গরুর গাড়ি। নজরনগরের শিল্পীদের তৈরি গরুর গাড়িতে চারটি চাকা থাকে। পোড়ামাটির এই খেলনাটির চাকাগুলি প্রত্যেকটি মাটি দিয়ে তৈরি। মাটির আচ্ছাদন বিশিষ্ট এই গরুর গাড়ির সামনের দিকে একটি ছোট ছিদ্র থাকে। আলাদা করে এই গরুর গাড়িতে কোনও গরু-পুতুল থাকে না। শিশুরা ওই ছিদ্রের মধ্যে সুতো লাগিয়ে সেটাকে টানলেই গাড়িটি চলতে থাকে। আচ্ছাদনের ভেতরে জানালার মতো ছিদ্র করা থাকে। গোটা গাড়িটি খড়িমাটি দিয়ে রং করা হয়। আর গরুর গাড়ির আচ্ছাদনের ওপরে ফুল, পাখি ও সরল গ্রাম্য শৈলী অঙ্কন পদ্ধতি প্রয়োগ করে এক সহজ অনাবিল খেলনা তৈরি করা হয়। এই খেলনা দশকের পর দশক ও যুগের পর যুগ ধরে হাড়োয়ার শৈশবকে আকৃষ্ট করে আসছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পল্লি জীবনের কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি আজও নজরনগরের শিল্প-সাধনার প্রতীক হয়ে রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের হট হুইল, ম্যাচ বক্সের বহুজাতিক সংস্থার নির্মিত খেলনা গাড়ির দাপটের সামনে নজরনগরের গরুর গাড়ি এখনও মাথা উঁচু করে বেঁচে রয়েছে। নজরনগরের গরুর গাড়ি নিছক খেলনা নয়, সে হয়ে উঠেছে প্রাচীন বাংলার সঙ্গে আজকের সময়ের এক মিলন সেতু। সে মনে করিয়ে দেয় যে, বাঙালির ঐতিহ্য ও পরম্পরা বহু গৌরবের।
নদীমাতৃক এই বাংলায় নৌকা ছাড়া জীবনধারণ করাটা কঠিন। আর প্রাচীন বাংলা জলযান তৈরিতে যে সিদ্ধহস্ত ছিল সেটা তার সিংহল-বিজয় ও গ্রিকদের সঙ্গে বাণিজ্য করার ইতিহাস থেকেই প্রমাণিত। অন্যদিকে বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থান করার কারণে নজরনগরে চাকা লাগানো ছোট আচ্ছাদন-বিশিষ্ট পোড়ামাটির নৌকা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রেও গোটা নৌকা খেলনাটির শরীর জুড়ে খড়িমাটি রং ও হালকা করে লোকজ শৈলীতে নৌকার পাটাতনে ফুল ও অন্যান্য রেখার আঁকিবুঁকি করা হয়। এই নৌকার ক্ষেত্রেও চারটি চাকা রয়েছে। মাটির দণ্ডের সঙ্গে চাকাগুলি খিল পদ্ধতিতে লাগানো হয়েছে। এই পদ্ধতি বংশপরম্পরায় ধরে শিল্পীদের শৈলীতে চলে আসছে।
বাঙালি ঘোড়ার প্রতি টান বরাবর অনুভব করে এসেছে। এমনকী, বনেদি-বাড়ির দুর্গাপুজোয় সিংহকে দেখতে অনেকটা ঘোড়ার মতোই। অন্যদিকে বাঁকুড়ার বিখ্যাত গলা উঁচু ঘোড়া থেকে মেদিনীপুর, হাওড়া, দিনাজপুর, নদীয়ার মানতের ঘোড়া– বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতীক হচ্ছে ঘোড়া। নজরনগরের ঘোড়ার পায়ের তলায় মাটির পাটাতন তৈরি করা হয়। তার সঙ্গে মাটির চাকা লাগানো হয়।
পাটাতনের সামনের দিকে যথারীতি একটা ছোট ছিদ্র থাকে। সেই ছিদ্রে সুতো ঢুকিয়ে লাগিয়ে টান দিলেই চলতে শুরু করে ঘোড়া। কোনও ব্যাটারি বা রিমোট কন্ট্রোল বা চাবি লাগে না। সে অনাবিল সরল ভঙ্গিতে চলতে থাকে। যথারীতি ঘোড়ার মুখমণ্ডলে বাংলার লোকজ শিল্প শৈলীর ছাপ রাখা হয়। লেজ, ঘোড়ার ঘাড়ের দিকে চুলের রেখাপাত করা হয়। পিঠেও বসার আসন অঙ্কিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়, উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের সুভাষগঞ্জে চাকা লাগানো ঘোড়া তৈরি হয়। কিন্তু সেই ঘোড়ার পায়ের তলায় নজরনগরের মতো পাটাতন বা ভিত থাকে না। সুভাষগঞ্জের চাকা লাগানো ঘোড়ার দু’টি পা একটি মাটির দণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা থাকে। দণ্ডের শেষ প্রান্তে চাকা লাগানো থাকে। আর রং করা থাকে না। সুভাষগঞ্জের নৌকায় চাকা থাকে। কিন্তু নজরনগরের মতো চার চাকা থাকে না। মাত্র দু’টি চাকা থাকে। নজরনগরের চাকার শৈলী হচ্ছে সরু। আর সুভাষগঞ্জে মোটা চাকা থাকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় পালকির উল্লেখ করেছিলেন। শহর হোক বা গ্রাম– একটা সময় সর্বত্রই বিরাজ করত পালকি। ভারতে প্রাচীন কাল থেকে পালকির প্রচলন রয়েছে। নজরনগরের শিল্পীরা সরল রীতিতে পালকি তৈরি করে থাকেন। পালকির মাথার ওপর তাঁরা নিজের মন থেকে শৈল্পিক আঁকিবুকি করে থাকেন। পালকিতে ঢোকার দরজাতেও নিজেদের শিল্প ভাবনার ছাপ রাখেন। উল্লেখ্য, হাওড়া জেলার নরেন্দ্রপুর, কুলগাছিয়ায় পালকি তৈরি করা হয়। কিন্তু সেই শিল্পধারা ক্ষয়ে গিয়েছে। নজরনগরের পোড়ামাটির পালকির মধ্যে শিশুরা আজও মনের অনাবিল আনন্দ খুঁজে পায়। পালকি নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্পীরা বাস্তবধর্মী রীতি মেনে চলেন। গোটা পালকিটাই পোড়ামাটির হয়।
আধুনিকতার সঙ্গে তাল রেখে শিল্পীরা মাটির তৈরি বাস, ছোট গাড়িও তৈরি করে থাকেন। এক্ষেত্রে তাঁরা ছাঁচ ব্যবহার করেন। শিল্পীরা নিজেদের মনের ভাবনাকে এই নির্মাণ-শিল্পে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। গাড়ির মধ্যে চালক বসে থাকবে। সেই ভাবনাও বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন তাঁরা। এক দরজা, দু’টি জানালা-বিশিষ্ট হচ্ছে তাঁদের বাস। সারা শরীরে সাদা রঙ মেখে বাসগুলো শিশুমনের কল্পনার রাজত্বে এগিয়ে যেতে থাকে।
চাকা লাগানো খেলনার পাশাপাশি নজরনগর তার নিজস্ব শৈলী টেপা শ্রেণির পুতুলের ধারা আজও বজায় রেখেছে। এই ধরনের পুতুলকে শিল্পীরা ‘বর-বউ’ বলেন। ছেলে পুতুলের মাথায় টোপরের আদলে মাটির চূড়া। আর মেয়ের পুতুলের মাথার মাঝখানে সিঁদুর লেপা। পা নেই। তলার দিকটা গোলাকৃতি। মুখের মধ্যে অভিব্যক্তি রয়েছে। মেয়ে পুতুলের মাথার পেছন দিকটা খোপার মতো করে সাজানো। হাতে টিপে তৈরি করার পাশাপাশি বর্তমানে টেপা পুতুল নির্মাণের ছাঁচ ব্যবহার করা হয়। এখানকার একমাত্র শিল্পী জয়দেব পালই দুই খোল ছাঁচের পোড়ামাটির বাস্তবধর্মী পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। এখানে বাস্তবধর্মী বলতে মানুষের মতো দেখতে। তিনি বিভিন্ন ধরনের দু’-খোল ছাঁচের পুতুল নির্মাণ করে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাউল, ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা গাজী, কাখে কলসি ও হাতে সন্তানকে ধরে থাকা মা। শিল্পী অনন্ত পালও বাস্তবধর্মী মেয়ে পুতুল তৈরি করে থাকেন। এ ছাড়া নজরনগরের উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন রাধেশ্যাম পাল, ভারতী পাল, সবিতা পাল, বিশ্বনাথ পাল, সুকুমার পাল।
প্রতি বছর চড়ক উপলক্ষে হাড়োয়া লাল মসজিদের কাছে একটি মেলা বসে। সেখানে বেতের ঝুড়ি ভর্তি করে পুতুল নিয়ে বসেন এই সকল শিল্পীরা। নজর নগরের শিল্পীদের সম্পর্কে প্রথমবার সকলকে অবগত করান বিশিষ্ট গবেষক সাগর চট্টোপাধ্যায়। তার গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘সুন্দরবনের কারুশিল্প ও কারুশিল্পী’-তে নজরনগরের উল্লেখ রয়েছে। নজরনগর ছাড়া হাড়োয়ার বেড়াচাপায় মাটির খেলনা তৈরির প্রচলন থাকলেও তা আজ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে।
নজরনগরের চাকা লাগানো খেলনার ঐতিহাসিক দিক আলোচনা করতে গিয়ে বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও শিল্পীসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘ভারতের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলিতে খনন কার্য করে যেসব পুতুল বা ছোটখাটো মৃত্তিকা প্রভৃতি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির সঙ্গে আমাদের গ্রাম্য কুম্ভকারদের তৈরি পোড়ামাটির নানাবিধ পুতুল খেলনাগুলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, আবহমান কাল ধরে এক প্রথাগত শিল্পধারা যেন প্রবাহমান রয়েছে।’ বিশিষ্ট গবেষকের মতে, চন্দ্রকেতুগড়ের পাশাপাশি হরিনারায়ণপুর, মেদিনীপুরের তমলুকে অজস্র চাকা লাগানো খেলনা পুতুল প্রত্ন খননে উঠে এসেছে।
সভ্যতার চাকা ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। বিশ্ব খেলনা শিল্পেও বিবর্তন ক্রমাগত হয়ে চলেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের ভাবনার সীমারেখাকে আগামী সময় নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু তার মধ্যেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলার এই আদি অকৃত্রিম চাকা লাগানো খেলনার ঐতিহ্যকে।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………………