বাসরঘর থেকে নিজের বউকেও খুঁজে নিতে হত। বিয়ের আসরে বরকে শালিরা এতই জ্বালাতন করত যে, বরকে সেদিকে নজর রাখতে হত। তাই কনের দিকে তাকানোর সময় ছিল না। শুভদৃষ্টির সময়ে একপলক দেখার পর বাসর ঘরে এসে বরকে নিজের বউকে খুঁজে নিতে হত। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বাসর ঘরে কনে খুঁজতে হয়েছিল।
বিয়েতে বাসর হবে না! এ আবার হয় নাকি? এখন বাসর হলেও বাসর জাগার লোকের খুব অভাব। রাত জাগলে শরীর খারাপ, পরের দিন অফিস– বিভিন্ন সত্যি-মিথ্যের অজুহাতে সদ্য বিবাহিত লোকটির পাশে চেনা লোকগুলো ভ্যানিশ হয়ে যায়। তাই এখন বাসর ঘরে সাপ না ঢুকলেও ঐতিহ্য হারিয়েছে অনেক।
একসময় লোক প্রচলিত ছড়া ছিল– ‘এয়োদের শুভশঙ্খ বাজে মিষ্টি মিষ্টি।/ উলু দিয়ে করছে বরণ, হচ্ছে শুভদৃষ্টি।/ মন্ত্রপাঠ সহযোগে হল বিয়েটা সাঙ্গ।/ বাসরঘরের আসরেতে চলবে রসের রঙ্গ।’ রঙ্গরসের বাসর ঘর অনেক দিন লুপ্ত। বিদ্যাসাগর একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আজকাল বিবাহে আর তেমন আমোদ নাই। বরকেও তেমন সঙ্কট পরীক্ষায় আজকাল আর পড়িতে হয় না।’ এই সংকটকে যদি রণক্ষেত্র বলা হয়, তাহলে কেমন হয়?
সত্যি কথা একসময় শালিদের চক্রব্যূহে বরকে অভিমন্যুর মতো অসহায় অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য অনেক যুদ্ধ করতে হত। সম্ভবত, এই কারণেই মহেন্দ্রনাথ দত্ত বাসর ঘরকে ‘শাস্তির ঘর’ বলেছেন। তবে এখন আর শাস্তির কোনও ব্যাপার নেই। বাসরযুদ্ধের বাড়াবাড়িও লুপ্ত। রসরাজ অমৃতলাল বসু এ প্রসঙ্গে খুব মজা করে বলেছিলেন, ‘ইন্দিরায় বঙ্কিমবাবু একটা বাসরের ছবি দিয়েছেন। বলতে ভয় হয়, তবে আমার চেয়ে তিনি অনেক দেখেছেনও বেশি, প্রতিভাও তাঁর অতুলনীয়, কিন্তু মোগল সাজটাজগুলো যেন একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়। তবে বাসরের শালী-শালাজের রসিকতাটা যে বদরসিকতায়ও সময়ে সময়ে উৎপাতেও গড়িয়ে গেছল, সে কথা সত্য, এখন সেটা শুধরে গেছে।’
এদেশে বাসর ঘরের এই রীতি যে কোনও গৃহস্থের মেয়ের বিয়ে উপস্থিত হলে বিয়ের দিন তার আত্মীয়রা বিয়েটা চরিতার্থ করার জন্য একটি বাসর ঘর সাজান। আর বরের সঙ্গে ইয়ার্কির সম্পর্ক যাদের, তাদেরই বাসর ঘরে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হত না, বাসরে আবালবৃদ্ধবণিতা সবাইকেই দেখা যেত। আর এই সকলকে এক করে দেখার জন্য সেকালে বাসর ঘরকে বলা হয়েছে ‘জগন্নাথক্ষেত্র’। ১৮৬৩-র ৩০ নভেম্বর ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা লিখল, ‘জগন্নাথক্ষেত্রে যেমন ব্রাহ্মণ ও শূদ্র বিবেচনা নাই, এক্ষণকার বাসরগৃহেও সেইরূপ সম্বন্ধাসম্বন্ধ বিবেচনা থাকে না। বরের সহিত যাঁহাদিগের বিরুদ্ধসম্বন্ধ, তাঁহারাও অবিরুদ্ধ সম্বন্ধের পরিচয় দিয়া আমোদ প্রমোদে প্রবৃত্ত হন। অশ্লীল সঙ্গীত, পরিহাস ও শ্লোকাদি পাঠও হইয়া থাকে।’
বাসর যখন তার নিজের জৌলুস হারিয়েছে, তখন বাসরযুদ্ধও বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ৩০ নভেম্বর ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় চিঠিপত্র বিভাগে বাসরযুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক দোজবর লেখেন, ‘ভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে সে দিবস পুনরায় বিবাহ করিতে হইয়াছে। স্ত্রী-আচার সময়ে কানমলা, নাকমলা, ধাক্কা, চড় ও মুষ্ট্যাঘাত সহ্য করিয়া বাসরঘরে প্রবেশ করিলাম। তথায় দেখি, চতুর্দিকে কেবল স্ত্রীলোকের হাট। সুন্দরীগণ আমাকে প্রথমে মহাসমাদর করিয়া ক্রমশ হাত চালাইতে লাগিলেন।’
যুদ্ধক্ষেত্রে শালিরা কীভাবে প্রথম আক্রমণ রচনা করত, সে-সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘প্রথমে শালীরা আসিয়া কনেকে হুকুম করিবে বরের কান ধরিয়া উঠ-বোস করা। আর সেই সময় একটা গালের কথা বলিয়া-উঠ ইত্যাদি। সেই সাতবার তো কানমলা হল। বর বাবাজী বুঝিলেন কি ঝকমারী করেছি। কানমলা খেতে খেতে প্রাণ গেল।’ ভাগ্যিস এখন আর এই মারামারি নেই, তাহলে বাসর থেকে আদালত– এই ছবিই দেখা যেত বহুলাংশে।
বাসরঘর থেকে নিজের বউকেও খুঁজে নিতে হত। বিয়ের আসরে বরকে শালিরা এতই জ্বালাতন করত যে, বরকে সেদিকে নজর রাখতে হত। তাই কনের দিকে তাকানোর সময় ছিল না। শুভদৃষ্টির সময়ে একপলক দেখার পর বাসর ঘরে এসে বরকে নিজের বউকে খুঁজে নিতে হত। স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বাসর ঘরে কনে খুঁজতে হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, “আমার বিবাহের সময়ে বাসরঘরে পা দিতে না দিতেই আমাকে বলিল, ‘তোমার কনে খুঁজিয়া বাহির কর।’ কনে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে শুনিয়া মহা মুস্কিলে পড়িলাম। গৃহে প্রবেশ করিতে না করিতে আমার উপর কনে খুঁজিয়া লইবার হুকুম হইল; আমি দেখিলাম সেই মেয়ের দঙ্গলের ভিতর থেকে সেই অপরিচিতা অর্ধাঙ্গিনীকে খুঁজিয়া বাহির করা আমার কর্ম নয়– আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া শেষে আমারই বয়সের বেশ একটি টুকটুকে ফরসা মেয়েকে ধরিয়া বলিলাম, ‘এই আমার কনে।’ যেমন ধরা অমনি এক মহাগণ্ডগোল পড়িয়া গেল। কে কার ঘাড়ে পড়ে, কে কোথা দিয়ে পালাইবে, তার পথ পায় না। আমি যাকে ধরেছি, তাকে খুবই ধরিছি, তার আর পালাইবার পথ নাই। আমি তার হাত ধরিয়া বলিলাম, ‘তুমিই আমার কনে, তোমাকে হলেই আমার ঘর চলবে। আমি আর অন্য কনে চাই না।’ সে মেয়েটি বাপরে মারে বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। গিন্নীবান্নী গোছ দুই একজন নিকটে আসিয়া বলিল, ‘ও তোমার কনে নয়, ওকে ছাড়িয়া দাও।’ আমি বলিলাম, ‘ছাড়িব কেন? খুঁজে নিতে বলেছ, আমি খুঁজিয়া এইটিকেই বাহির করিয়াছি। এইটি হলেই আমার বেশ মনের মতো হবে।’ তারপর মেয়েটি হাতে পায়ে ধরিয়া বলিল, ‘আচ্ছা আমাকে ছাড়িয়া দাও, আমি তোমার কনে বার করে দিচ্চি।’ তখন আপনারাই কনে আনিয়া হাজির করিল।”
……………………………………………………
যুদ্ধক্ষেত্রে শালিরা কীভাবে প্রথম আক্রমণ রচনা করত, সে-সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ‘প্রথমে শালীরা আসিয়া কনেকে হুকুম করিবে বরের কান ধরিয়া উঠ-বোস করা। আর সেই সময় একটা গালের কথা বলিয়া-উঠ ইত্যাদি। সেই সাতবার তো কানমলা হল। বর বাবাজী বুঝিলেন কি ঝকমারী করেছি। কানমলা খেতে খেতে প্রাণ গেল।’ ভাগ্যিস এখন আর এই মারামারি নেই, তাহলে বাসর থেকে আদালত– এই ছবিই দেখা যেত বহুলাংশে।
……………………………………………………
সেকালে ঠাকুরমা-দিদিমারা বাসর ঘরে কথায় কথায় ছড়া কাটত। মেয়েরা অবশ্য বর ও বরযাত্রী ঠকাতে হেঁয়ালি ও ধাঁধা মুখস্থ করে রাখত। মেয়েরা হয়তো নতুন জামাইকে বলত, ‘বারো মাস বয়স তার তেরো মাস কালে/ গণ্ডা গণ্ডা প্রসব করে অগণন ছেলে– বলেন তো কি?’ ভেবে উত্তর দেওয়ার সময় নেই। বর উত্তর দেওয়ার আগেই চিমটি বা চড়চাপড় মেরে বলত– ‘কলাগাছ। জানেন না?’ এমনি করেই বাসর জমিয়ে রাখা হত। বর বেচারা মার খেত এমনিই। মহেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় বলেছিলেন, ‘যদি কেহ এই বাসরঘরের ছড়া সংগ্রহ করিতে পারেন, তাহা হইলে বুঝিতে পারিবেন যে, বঙ্গ সাহিত্যের কিরূপ উন্নতি হইতেছিল।’
সেকাল থেকে একালেও টিকে আছে একমাত্র বাসরের গান, যদিও যুগের সঙ্গে গানের রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে। সেকালে বাসরে খেউড়, টপ্পা গানের সমাদর ছিল। ১২৭০ সনের ১৫ অগ্রহায়ণের ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে এই গানের সমালোচনা করা হয়েছে, কারণ, ‘বাসরঘর হইতে অনেকের ভদ্রনীতি শিক্ষার বিঘ্ন উপস্থিত হয়। বাসরঘরে গান ও শ্লোক পাঠ করিতে হইবে বলিয়া অনেকে বাল্যাবস্থায় অশ্লীল গানাদি করে।’
একবার এক দোজবরকে বাসরে গান গাইতে বলা হয়। প্রথমে তিনি একটি ব্রাহ্মসংগীত শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ওঠে ‘চুপ চুপ’ শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে কানমলাও। এরপর তিনি বলেন, “আমি তৎক্ষণাৎ একটি রামপ্রসাদী পদ ধরিলাম। সেবারও প্রশংসা পাইলাম না। শেষে হতাশ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম কি প্রকার গীত আবশ্যক? ইহা শুনিয়াই দশ যুবতী বলিয়া উঠিলেন ‘টপ্পা’, ‘খেয়াল’, একজন হরুঠাকুরের খেউড় শুনিতে চাহিলেন। আমার মাথা ঘুরিয়া গেল।” এটিও ১২৭০ বঙ্গাব্দের ১৫ অগ্রহায়ণ ‘সোমপ্রকাশ’ প্রকাশ করে।
শুধু তাই নয়, বাসর ঘরে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে আমোদ করা হত। ওই দোজবর বাসরে গান শুনিয়ে যখন আসর জমাতে পারলেন না, তখন ওই বাড়িরই এক জামাই হঠাৎ এক গান ধরে স্ত্রীলোকদের মধ্যে লাফ দিয়ে ঢুকে কারও ঘোমটা খুললেন, কারও গয়না টানলেন। এই রঙ্গ দেখে বাসর ঘরে হাসির রোল ছড়িয়ে পড়ল।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন পৌলমী গুহ-র লেখা: ‘বিয়েটা এবার করে ফেলো’ সিনড্রোম
…………………………………………………..
দেশীয় মেয়েরা তখন অন্দরমহলে বন্দি, গুরুজনদের ভয়ে ভীত। তবে বিবাহবাসরে হঠাৎ মুক্তির উল্লাসে এরা তাৎক্ষণিক ছড়া কেটে যেভাবে বিকৃত রুচির পরিচয় দিতে শুরু করেন, তা অনেকেই ভালো চোখে নেননি। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে এর সমালোচনা করে বলা হয়েছিল, ‘এই কি স্ত্রীজাতির স্বভাবসুলভ অপ্রগলভতা? এই কি বিনয় নম্রতা? এই কি লজ্জা শীলতা? বাসরঘরে যখন এইরূপ ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করিয়া যথেচ্ছাচার হইতে লাগিল তখন আর এ বিষয়ে প্রশ্রয় দেওয়া বিধেয় হয় না।’
এখন যেমন বাসরযুদ্ধ ইতিহাস, তেমনই আগামিদিনে বাসর ঘরও ইতিহাস হবে। আধুনিকতার হাওয়া যে চারপাশে।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………