হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার সবার কানে এল। দেখা গেল কয়েকজন লোক একটা বাচ্চা মেয়েকে বলির পাঁঠার মতো টানতে টানতে নিয়ে আসছে প্রতিমার দিকে। মেয়েটা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গেল। চারদিকে মাদলের প্রবল আওয়াজ আর উল্লাস। এবার মেয়েটাকে প্রতিমার পায়ের কাছে ছুড়ে দেওয়া হল। সবাই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎ গেরট্রুড প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠে মাতালগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে একেবারে পৌঁছে গেল দেবীর পায়ের কাছে।
গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭ সাল নাগাদ প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরে যে বইটি লেখেন, তা থেকেই জানা যায় যে যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহুশত বছর আগে থেকেই ভারতে নরবলির প্রচলন ছিল। তিনি নরবলি প্রথার উদ্ভাবক হিসেবে সিথিয়ান বা শক জাতির কথা বলেছেন, যারা তুর্কিস্থানে বসবাস করত। আনুমানিক খ্রি: পূ: দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে শক-রা ভারতে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। অতএব ভারতেও শকদের মাধ্যমেই নরবলি প্রথার প্রচলন হয়। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাংয়ের দীর্ঘ চোদ্দো বছরের (৬৩০-৬৪৪ খ্রি:) ভারত-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বই ‘Travels in India’ গ্রন্থেও কাপালিক, অঘোরী ও কলামুখ সম্প্রদায়ের মধ্যে দেব-দেবীর পূজায় নরবলি দেওয়ার বহুল প্রচলিত রেওয়াজের কথা উল্লেখ আছে। আর আমরা তো জানিই যে মহেঞ্জোদরো শব্দটির অর্থ ‘মৃতের স্তূপ’।
এই সুযোগে ইতিহাসের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। পৃথিবী জুড়ে প্রায় সর্বত্র, যথা রোম, গ্রিক, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, সোভিয়েত রাশিয়া, মেক্সিকো, আমেরিকা, মিশর, চিন, ইরান, মালয়, সুমাত্রা, প্রাচীন ওসিয়ানিয়া, ফিজিতে নরবলির রেওয়াজ ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন ব্যতিরেকেও প্রকৃতির রোষানল থেকে রক্ষা পেতে, নারীকে জয় করতে দু’টি গোষ্ঠীর লড়াইয়ে বিজিত গোষ্ঠীপতিকে সর্বসমক্ষে হত্যা বা বলিদান, পুণ্যের আশায় সাগরের জলে সন্তান নিক্ষেপ, যুদ্ধবন্দি, রাজদ্রোহের অভিযোগে বন্দি বা ক্রীতদাসদেরও বলি হিসেবে প্রদত্ত করা হত। আবার জমির মতোই নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অনুর্বর ভূমিকে উর্বর ও ফলবতী জমিতে রূপান্তরিত করতে নারীবলির প্রচলন হয়। এছাড়াও পাঞ্জাবের বেদি সম্প্রদায়ের মধ্যে চারশো বছর ধরে কন্যাহত্যা বা বলিদান সামাজিক রীতি হিসেবে চলে আসছিল। সেই সময় ইংরেজ কমিশনার জন লরেন্স দুই হাজার বেদি পরিবারের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে একটিও কন্যাসন্তান পাননি। এছাড়া ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশের কন্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যেও শিশুকন্যা জন্মানোর সাত দিনের মধ্যে তাকে হত্যা বা বলিদান করা হত।
ভারতে ধর্মীয় নরবলির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় যজুর্বেদ গ্রন্থে। তারপর থেকে ধারাবাহিক নরবলি পর্বের আলোচনাটিকে দীর্ঘায়িত না করে আমরা যদি রামায়ণ ও মহাভারত, অর্থাৎ মহাকাব্যিক যুগের নরবলি পর্ব বা কালিকা পুরাণ পর্ব ইত্যাদি দ্রুত অতিক্রম করে একেবারে বৌদ্ধ যুগে অবতীর্ণ হই, তাহলেও হিউয়েন সাংয়ের বর্ণনায় কাপালিকদের মধ্যে নরবলি প্রথার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। ভারত জুড়ে অনেক রাজাই কুলদেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি উৎসর্গ করতেন। ত্রিপুরা, মণিপুর, ছত্রিশগড়ের জগদলপুর, ওড়িশার রাজাদের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন ছিল। বিহারে বনদেবীকে সন্তুষ্ট করতে সিংভূম অঞ্চলে নরবলির রেওয়াজ ছিল। আর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের ধলরাজা, মহিষাদলের গর্গরাজা, গড়বেতার রাজা এবং বর্ধমানের মৌলাগ্রামের ভূস্বামীদের দেবীপূজায় নরবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। আর কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ সিংহ রাজ্যবিজয় উপলক্ষে কালীপূজার রাতে একবার একসঙ্গে ১৫০ জন যুদ্ধবন্দিকে নরবলি দিয়েছিলেন।
কলকাতার প্রাচীনতম মন্দির চিত্তেশ্বরী মন্দির (১৬২০) নির্মাণ করেছিলেন চিতে ডাকাত, যার নামনুসারেই নাকি ওই অঞ্চলের নাম হয় চিৎপুর। চিতে ডাকাত যখন ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হতেন, তখন চিত্তেশ্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি উৎসর্গ করতেন। জেমস লং সাহেব এই প্রসঙ্গেই বলেছিলেন ‘It was then written chittrapur and was noted for the temple of chitreswari Devi or the Goddess of Chittru known among European as the temple of ‘Kali’ at Chitpur. According to popular and uncontradicted tradition this was the spot where the largest number of human sacrifice was offered to the Goddess in Bengal, before the establishment of British Government.’ এমনকী কালীঘাটের কালীমন্দিরেও নরবলি দেওয়া হত। এই প্রসঙ্গে নিশীথরঞ্জন রায় আমাদের অবহিত করেছেন ‘কালীঘাট একটি পীঠস্থান বলিয়া পরিগণিত হইবার পর অনেক বছর পর্যন্ত উহা জঙ্গলময় ছিল। সেই সময় ভৈরবী, কাপালিক এবং শক্তিপূজকগণ কালীঘাটে নরবলি দিত।’
পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারে দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুর মূলাজোড়ে ব্রহ্মময়ী নবরত্ন মন্দির ও দ্বাদশ শিবের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গোপীমোহন-মেনকার কনিষ্ঠ সন্তান ও একমাত্র মেয়ে ব্রহ্মময়ীর বিবাহের সময় সর্পাঘাতে মৃত্যু হওয়ায় শোকবিহ্বল গোপীমোহন মেয়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মূলাজোড়ে মন্দির নির্মাণ করেন। সেই মন্দিরে পূজায় ছাগ ও মহিষ বলি দেওয়া হত। দর্পনারায়ণের আরেক পুত্র হরিমোহন খুব অনাড়ম্বর ভাবে নিষ্ঠা সহকারে দুর্গাপূজা করতেন এবং তাঁর বাড়ির পুজোয় কোনওরকম বলি দেওয়া হত না। কিন্তু এই হরিমোহনেরই বংশধরেরা পরে শাক্ত ধর্মাবলম্বী হওয়ায় কালীঘাটে ছাগ বলি দেওয়ার রেওয়াজ চালু করেন। তবে দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বংশধরদের মধ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশাসন দেখা যায়। যেমন গোপীমোহনের পৌত্র শৌরীন্দ্রমোহনের বংশধরেরা দুর্গাপূজায় কোনওরকম বলি দিতেন না। আর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি যেহেতু বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী তাই দুর্গাপূজায় কুমড়ো বলি দেওয়া হত।
তবে শান্তিনিকেতনে দুর্গাপূজা না হলেও সেইসময় বিদ্যালয়ে ছুটি দিয়ে দেওয়া হত এবং বোলপুর, সুরুলে বা অন্যত্র বেশ ধূমধাম সহকারে দুর্গাপূজা হত।
সুরুলে গ্রাম-পুনর্গঠন কেন্দ্রের সূচনা হয় ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কবি অধ্যক্ষের দায়িত্বভার তুলে দেন এলমর্হার্স্টের বিশ্বস্ত কাঁধে, পল্লিসেবা বিভাগের দায়িত্ব দেন কালীমোহন ঘোষকে। সুরুল সমিতির প্রথম সভায় উপস্থিত ছিলেন কবি স্বয়ং, অধ্যক্ষ এলমহার্স্ট, কালীমোহন ঘোষ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অ্যান্ড্রুজ, ক্ষিতিমোহন ঘোষ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, সুরেন্দ্রনাথ কর, গৌরগোপাল ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন সন্তোষচন্দ্র মজুমদার। একটু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমরা পাই ১৭১০ সালে বর্ধমানের ছোট নীলপুর গ্রাম থেকে ভরতচন্দ্র সরকার সুরুলে তাঁদের পারিবারিক গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের কাছে চলে আসেন এবং গুরুর আশীর্বাদেই নিঃসন্তান দম্পতি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তাঁদের পুত্র কৃষ্ণহরির প্রপৌত্র শ্রীনিবাস রাজনগরের জমিদার বাহাদুর উল্ জমা খাঁর পত্নী সোনারানির কাছ থেকে ১৭৯০ সালে পাঁচটি তালুক কিনে সুরুলে সরকার পরিবারের জমিদারি পত্তন করেন। শ্রীনিবাসই ১৮ হাজার টাকা খরচ করে জমিদারিতে পুজামণ্ডপ নির্মাণ করেন। মাসিক তিন টাকা চার আনা বেতনের চুক্তিতে রানাঘাটের গোবিন্দ মিস্ত্রি ঠাকুরদালানটি নির্মাণ করেন।
তবে সুরুলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট কমার্শিয়াল নীলকর সাহেব জন চিপের সঙ্গে বিভিন্ন কারবারে যুক্ত হয়ে ক্রমে ফুলেফেঁপে ওঠে সুরুলের সরকার জমিদারি এবং রায়পুরের সিংহ পরিবারের জমিদারি। পরে এই দুই পরিবারের মধ্যে দেনা সংক্রান্ত একটি মামলায় সরকার পরিবার হেরে গেলে রায়পুরের ভুবনমোহন সিংহ টাকা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি নিলামে বিক্রি করেন এবং এইভাবে সুরুলের জমিদারির কিছু অংশ সিংহ পরিবারের হাতে আসে। আর বর্ধমান-সাঁইথিয়া লুপ লাইন তৈরির সময় ইস্টার্ন রেলওয়ে কাজের জন্য এই সুরুল কুঠিবাড়ি তৈরি করে এবং পরে রায়পুরের জমিদাররা রেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুরুল কুঠিবাড়ি কিনে নেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১২ সালে রায়পুরের জমিদার নরেন্দ্র প্রসাদ সিংহের কাছ থেকে সুরুল কুঠিবাড়ি এবং তৎসংলগ্ন ২০ বিঘা জমি ১০ হাজার টাকায় কিনে নেন। সুরুল কুটিরে ১৯১৪ অথবা ১৯১৫ সাল নাগাদ রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমা দেবী গৃহপ্রবেশ করেন। কবির উপস্থিতিতে তাঁদের মন্ত্রপাঠ করান ক্ষিতিমোহন সেন। ১৯১৫ সালে বসন্তে এই কুঠিবাড়িতে অবস্থানকালীনই রবীন্দ্রনাথ ‘ফাল্গুনী’ নাটকটি লেখেন এবং নাটকটি কবি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারিতেও কবি এই কুঠিবাড়িতে কিছুদিন ছিলেন।
সুরুলে চামুণ্ডাদেবীর চরণে শিশুবলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল বলে শোনা যায়। এমনকী, খোদ শান্তিনিকেতনে সেই স্বপ্তপর্ণী যুগলের নীচে বেদি প্রস্তুতির সময়ে করোটি পাওয়া গেছে। এই প্রসঙ্গে অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘মহর্ষির মুখে শুনিয়াছি বেদি প্রস্তুতের জন্য এই স্থান খনন করিবার সময় অনেক নরমুন্ডাস্থি পাওয়া গিয়েছিল।’ এবার সেই সুরুলের দুর্গাপূজারই যে প্রত্যক্ষ ঘটনার বিবরণ দেব, সেখানে উপস্থিত ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী, অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী হিয়রডিস সিগর বা কবির হৈমন্তী, প্রাচ্যবিদ তথা শান্তিনিকেতনে ইসলাম ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের অধ্যাপক হাঙ্গেরিয়ান জ্যুলা গ্যারমানুশ ও তাঁর স্ত্রী রোজা হইনোসি, জার্মান ছাত্র ভ্যালেনটিন ট্র্যাপ এবং জার্মান বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী পর্বতারোহী গেরট্রুড রুডিগ্যার। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মোটর গাড়িতে সবাই মিলে রওনা দিলেন। ড্রাইভারের সিটে ছিলেন অমিয় চক্রবর্তী আর তাঁর পাশে গেরট্রুড। সময়টা ১৯২৯-এর অক্টোবর এবং কবি তখন শান্তিনিকেতনে।
গাড়িটাকে কোনওরকমে রেখে তাঁরা সরু লাল ইঁটের রাস্তা ধরে মন্দির চত্বরের দিকে এগোতে থাকলেন। চতুর্দিকে থিকথিক করছে ভিড়। নাকে আসছে চোলাই মদের উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধ। তবে মন্দিরের দেওয়ালের অপূর্ব কারুকার্য, ভাস্কর্য এবং নকশা দেখে তাঁরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা আরও প্রত্যক্ষ করলেন যে, দেবী মূর্তি খড়ের কাঠামোর উপর মৃত্তিকা দিয়ে নির্মিত এক ভয়ানক নারী, যাঁর বিভিন্ন হাতের মুঠোয় নানারকম অস্ত্রের বাহার। সাঁওতাল মেয়েরা মাদলের তালে তালে নেচেই চলেছে। এদিকে সবার আগে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করার জন্য শুরু হয়েছে ভক্তদের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কি আর ধস্তাধস্তি। সে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই উন্মাদনার মধ্যেই চলেছে অসহায় পশুগুলোর কাতর আর্তনাদ আর একের পর এক পাঁঠাবলি এবং সেই রক্তের ধারা এসে মিশছে মাটিতে। গর্ভগৃহের কাছে পৌঁছে দেখা গেল কত মানুষ মায়ের পায়ের কাছে পড়ে তাঁদের প্রার্থনা জ্ঞাপন করছেন।
হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার সবার কানে এল। দেখা গেল কয়েকজন লোক একটা বাচ্চা মেয়েকে বলির পাঁঠার মতো টানতে টানতে নিয়ে আসছে প্রতিমার দিকে। ওর গলা থেকে বের হচ্ছিল একটা অসহায় অস্ফূট আর্তনাদ। মেয়েটা ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে গেল। চারদিকে মাদলের প্রবল আওয়াজ আর উল্লাস। এবার মেয়েটাকে প্রতিমার পায়ের কাছে ছুড়ে দেওয়া হল। সবাই ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। হঠাৎ গেরট্রুড রোজার হাত ছেড়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠে মাতালগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে একেবারে পৌঁছে গেল দেবীর পায়ের কাছে। তখন গেরট্রুডের ইস্পাত কঠিন নীল চোখের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারল না। গেরট্রুডকে কেউ ছোঁয়ার সাহস পেল না। মেয়েটাকে কোলে করে নিয়ে গেরট্রুড দৃঢ় পদক্ষেপে মন্দিরের বাইরে আসতেই এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে এসে ওঁর পায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গেরট্রুডের বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওই হতদরিদ্র অসহায় মহিলাই বাচ্চাটির মা। বাচ্চা মেয়েটাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার একটু পরেই ওর জ্ঞান ফিরে এল।
বাইরের চারপাশে অসংখ্য মেয়েরা-মায়েরা তখন ঘিরে ধরেছে গেরট্রুডকে। সবাই এক আশ্চর্য মুক্তির আনন্দে ওঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন। ভিতরে বিগ্রহের সামনে ভিড়টা যেন একটু হালকা হতে শুরু করেছে।
তথ্যঋণ:
১. অগ্নিযুগে শান্তিনিকেতনে হাঙ্গেরীয় দম্পতির স্মৃতিলিপি: জি রোজা হইনোসি (অনুবাদ: বিচিত্রা ভট্টাচার্য)
২. রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন: সম্পাদনা তপনকুমার সোম
৩. নরবলির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: দুর্গাপদ চট্টোপাধ্যায়
৪. রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ: শিবনাথ শাস্ত্রী
৫. ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল: চিত্রা দেব
৬. রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ: পুর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
৭. ঠাকুরবাড়ির ভৃত্যমহল ও অন্যান্য: শান্তা শ্রীমানী
৮. একত্রে রবীন্দ্রনাথ (প্রথম খণ্ড): অমিতাভ চৌধুরী
৯. রবীন্দ্রবর্ষপঞ্জি: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
১০. বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ: অতনু কুমার বসু