জয়েস প্রতিদিন রেস্তোরাঁয় পার্টি দিতেন। এবং প্রত্যেককে খাওয়াতেন অত্যন্ত দামি, শৌখিন সুরা। কিন্তু নিজে খেতেন সাধারণ সাদা ওয়াইন। সারাদিন মদ খেতেন না। সন্ধেবেলা তৃষ্ণার্ত জয়েস। সুতরাং ওয়েটার তাঁর গ্লাস খালি হতে দিত না। আকণ্ঠ পান করতেন জয়েস। তারপর অন্ধ এবং মাতাল জয়েস যখন টলমল করতে করতে পুরুষের টয়লেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, সে ছিল দেখার মতো এক দৃশ্য! সবাই তাঁকে সাহায্য করতে চায়!
অধিকাংশ বাঙালির কাছে ‘প্যারিস’ মানেই আইফেল টাওয়ার। পিছনে আইফেল, সামনে বাঙালি। এই ছবি বা সেলফি-তেই প্যারিস ভ্রমণ শুরু এবং তার রাগমোচন।
কিন্তু প্যারিসের ভুবনখ্যাত বইয়ের দোকানের সামনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত যে গ্রন্থাগ্রহী লাইনটি চলতেই থাকে, তিন-চারদিনে তার মধ্যে একটিও বাঙালি চোখে পড়েনি! আমি এতদিনে নিশ্চিত, বিশ্বজুড়ে বই যদিও রক্তমাংসে রগরগে হয়ে বেঁচে আছে, অধিকাংশ মল-আক্রান্ত, সেলফোন-গ্রস্ত বাঙালির জীবনে বই এখন সত্যিই মর্মন্তুদ মড়া! তা-ই প্যারিসের চিঠির শেষ দুই পর্ব শুধু বই আর লেখকদের গল্প নিয়ে, যে-গল্পের নায়ক অবশ্য বিশ্বের সেরা বইবিপণি, ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’!
প্যারিসে জেমস জয়েস, স্ত্রী নোরা, এবং তাঁদের দুই সন্তান। সবে প্রকাশিত হয়েছে ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’ থেকে জেমস জয়েস-এর বিপুল বিতর্কিত উপন্যাস ‘ইউলিসিস!’ দরিদ্র লেখক জয়েস, প্রবল বিদ্বান জয়েস, প্রায় অন্ধ জয়েস, ‘ইউলিসিস’-এর সাফল্যে ভাসছেন অর্থের প্লাবনে। কেমন তাঁর প্যারিসের প্রাত্যহিক যাপন, তাঁর লাইফস্টাইল জানাচ্ছেন সিলভিয়া বিচ তাঁর বই ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’-তে। ‘Joyce’s expenses were heavy, naturally with a family of four, besides, he enjoyed spending the way some people enjoy hoarding.’ যেমন মহানন্দে কিছু মানুষ টাকা জমায়, তেমনই মহানন্দে টাকা ওড়ান জেমস জয়েস প্যারিসে। জয়েসরা রোজ সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় পান করেন, খান, এবং খাওয়ান। ‘He spends money like a drunken sailor’– জয়েস মাতাল নাবিকের মতো টাকা খরচ করেন!
আমি প্যারিস থেকে দু’দিনের জন্য বেলজিয়ামে গেলাম। শুধুমাত্র জগৎবিখ্যাত গোয়েন্দা আরকিউল পয়রোর মতো বেলজিয়ান সেলিব্রিটিকে বুঝতে নয়, সেই সঙ্গে জেমস জয়েস কেন ঘনঘন বেলজিয়ামে যেতেন, সেই তথ্যের খোঁজেও। তথ্য হল: বেলজিয়ামে তিনি একটি বিশেষ সিরিজের প্রচুর পোস্টকার্ড কিনেছিলেন। সেই সিরিজের পোস্টকার্ডে পোস্ট অফিসের মুরাল পেন্টিংস বা দেওয়াল ছবিগুলো ছাপা হয়েছিল। সেই সঙ্গে বেলজিয়ামে দু’টি ভাষা একসঙ্গে শিখেছিলেন– ফ্লেমিশ এবং ডাচ।
জেমস জয়েসের যৌবন কেটেছিল দারিদ্রর ম্লানিমা এবং দুর্যোগে। ইউলিসিসের আন্তর্জাতিক সাফল্য জয়েসের জীবনে নিয়ে এল অর্থ। তিনি কৃপণ নন। টাকা জমালেন না। দেদার খরচ করে যৌবনের দারিদ্রকে যতদূরে সম্ভব সরিয়ে দিলেন।
ঠিকই করেছেন জয়েস– জানাচ্ছেন সিলভিয়া বিচ। তিনি বুঝেছেন, যা তিনি পেয়েছেন, তা তাঁর প্রতিভার দান। সুতরাং, খরচ করার অধিকার তাঁর আছেই। জয়েস শুধু যে পার্টি দিতেন, তা-ই নয়। সেই পার্টিতে জয়েস নিজে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। লেখক জয়েসকে সবাই চিনি। কিন্তু গায়ক জয়েসের খোঁজ পেলাম প্যারিসে, বেলজিয়ামে। সিলভিয়া বিচ লিখছেন: ‘Joyce would seat himself at the piano, drooping over the keys and the old Irish songs… his particular ways of singing them– these were things one can never forget. প্যারিসে আর বেলজিয়ামে এসে প্রথম আবিষ্কার করলাম গায়ক জেমস জয়েসকে।
জয়েসের লেখা এবং জয়েসের গান– এই দুই প্রসঙ্গের পর জেমস জয়েসের তৃতীয় মাত্রা। প্যারিসের রেস্তোরাঁয় তাঁর টিপস দেওয়ার প্রসঙ্গ। লিখছেন সিলভিয়া: ‘Joyce’s tips were famous; the waiters, the boy who fetched him a taxi, all those who served him, must have retired with a fortune… Joyce overtipped.’ ঠিক কেমন ছিল জয়েসের টিপস দেওয়ার বাড়াবাড়ি? যে ছেলেটা জয়েসের ট্যাক্সি ডেকে দিত কিংবা কোনও কাজে লাগত জয়েসের, তারা প্রত্যেকে ধনী হয়ে গিয়েছিল, এমনই ছিল জয়েসের ‘টিপস’।
এবার আসি জয়েসের মদ খাওয়ায়। জয়েস প্রতিদিন রেস্তোরাঁয় পার্টি দিতেন। এবং প্রত্যেককে খাওয়াতেন অত্যন্ত দামি, শৌখিন সুরা। কিন্তু নিজে খেতেন সাধারণ সাদা ওয়াইন। সারাদিন মদ খেতেন না। সন্ধেবেলা তৃষ্ণার্ত জয়েস। সুতরাং ওয়েটার তাঁর গ্লাস খালি হতে দিত না। আকণ্ঠ পান করতেন জয়েস। তারপর অন্ধ এবং মাতাল জয়েস যখন টলমল করতে করতে পুরুষের টয়লেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেন, সে ছিল দেখার মতো এক দৃশ্য! সবাই তাঁকে সাহায্য করতে চায়! ‘His blindness drew people to him a great deal’, লিখেছেন সিলভিয়া। কিন্তু কোন রেস্তোরাঁয় যেতেন জেমস জয়েস? ‘Joyce’s particular resturant was the one opposite the Gare Montparnasse, Les Trianons ’, জানাচ্ছেন সিলভিয়া। ১৯২০-এর ঘটনা। ২০২৩-এ সেই রেস্তোরাঁয় কোনও অস্তিত্বই নেই!
(চলবে)
যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রয় শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না?