ন্যূনতম তুলির টানে অনবদ্য অভিব্যক্তিই হচ্ছে কাঁঠালি পুতুলের সৌন্দর্য। তা নির্মেদ। ছন্দের মতো গতিশীলতা নিয়ে সে জাঁতাকলে কাজ করে যাচ্ছে। আবার ঢেঁকিতে ধান ভানছে। ঐক্যবদ্ধ নারীত্বের প্রতীক হয়ে সহনারীর মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে। স্নেহশীলা ভঙ্গিতে শিশুকে কোলে বসিয়ে তেল মাখাচ্ছে। সংসার সীমান্তের তীব্র সংগ্রামে শিশুকে কোলে করে নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে দুধ দিয়ে সে হয়ে উঠছে গোয়ালিনী।
আষাঢ়ের আকাশে মেঘ ও রোদ্দুর নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলায় মত্ত। কাঁঠালিয়া রোডের নিঃসঙ্গ রেলস্টেশনে কখনও হালকা বৃষ্টি ঝরে পড়ছে, তো আবার কখনও রোদে গোটা প্লাটফর্ম চত্বর আলোকিত হয়ে উঠছে। ক্রমাগত একটা ঠান্ডা হাওয়া এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের মধ্যে সেতুর মতো সংযোগ স্থাপন করছে। প্রকৃতির এই খামখেয়ালির মধ্যে একাগ্র-চিত্তে নিজের সৃষ্টির ওপর তুলির শেষ মুহূর্তের টান দিয়ে চলেছেন বছর ৭৫-এর নিঃসঙ্গ বিদ্রোহী এক শিল্পী। পরনে ফতুয়া ও আটপৌরে লুঙ্গি। মেঝেতে বসে একটার পর একটা মাটির পুতুলকে প্রাণবন্ত করে তুলছেন। মাত্র দেড় মাস আগেই ব্রেন স্ট্রোক থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। শরীর দুর্বল। অন্যদিকে সহধর্মিনীর শরীরে বাসা বেধেছে ক্যানসার। জীবনের এই তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের শিল্পের প্রতি অধ্যবসায় বজায় রেখেছেন সাধন পাল।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ব্লকে অবস্থিত কাঁঠালিয়া। এখানকার পুতুল-শৈলীর নিজস্বতা শিল্পরসিকদের মনে স্থান করে নিয়েছে। বংশপরম্পরা মেনে প্রায় ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এই শিল্পকে আগলে রেখে একার কাঁধে বয়ে নিয়ে চলেছেন সাধন পাল। শৈশবে মা ফুলবাসিনী পালের কাছে পুতুল তৈরির হাতেখড়ি। শিল্পীর কথায়, একটা সময় ছিল যখন পুরো কাঁঠালিয়ার পালপাড়াই মাটির পুতুল তৈরি করত। গ্রামীণ উৎসব, যেমন– চড়ক, রথ, শিবরাত্রি, পৌষ সংক্রান্তির সময় বিভিন্ন মেলায় মায়ের সঙ্গে ঝুড়িতে করে শৈশবে পুতুল নিয়ে যেতেন তিনি। এমনকী স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরাও শিল্পীদের থেকে পুতুল নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে ফেরি করত। মূলত শিশুমনকে আনন্দ প্রদান করাই ছিল এই পুতুল তৈরির প্রধান লক্ষ্য। সেইসময় গ্রামের মহিলা শিল্পীরা এই পুতুল তৈরি করতেন। অন্যান্য মৃৎসামগ্রী তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকতেন পুরুষ শিল্পীরা। যেহেতু রমণীদের হাতে গড়ে উঠত কাঁঠালিয়ার পুতুল, তাই নারী জীবনের উপাখ্যান এই পুতুলের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে।
দৈনন্দিন সংসারিক সংগ্রামের পাশাপাশি নারীদের নিজেদের মধ্যে আত্মিকতা ও ঐক্যবদ্ধ মনোভাব কাঁঠালিয়ার পুতুলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। পুতুলের শারীরিক গঠন ও নির্মাণশৈলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিল্পী সাধন পাল জানিয়েছেন যে, পুতুলের গোটা শরীরটা চাকে তৈরি করা হয়। মুখ ছাঁচের তৈরি। হাত ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলিকে হাতে টিপে নির্মাণ করা হয়। পুতুল তৈরিতে শুধুমাত্র গঙ্গার পলিমাটি ব্যবহৃত হয়।
শিল্পীর কথায়, মুর্শিদাবাদের মাটির গুণমান অনেক বেশি উন্নতমানের। তাই অন্য কোনও প্রকারের মাটি এতে মেশানো হয় না। পুতুলের গায়ে রঙের মিশ্রণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিল্পী জানিয়েছেন, প্রথমে ভেষজ আঁঠার সঙ্গে খড়িমাটি মিশিয়ে পোড়ামাটির পুতুলের গায়ে প্রলেপ দেওয়া হত। এই ভেষজ আঁঠা তৈরিতে বাবলা, ভেন্ডি গাছের ছাল ব্যবহার করা হত। বর্তমানে তেঁতুলের কাইয়ের গুঁড়ো জলে ফুঁটিয়ে আঠা তৈরি করা হয়। পরে তা খড়িমাটিতে মিশিয়ে পুতুলের গায়ে মাখানো হয়। তারপর অ্যারারুটের সঙ্গে অভ্র মিশিয়ে আরও একটি প্রলেপ দেওয়া হয়। পুতুলের গায়ের রঙকে অমলিন রাখতে মেশানো হয় অভ্র। সবশেষে লাল ও কালো রঙের ব্যবহার করা হয়।
কাঁঠালিয়া পুতুলের সাদা শরীরে রেখার মতো কালো ও লাল রঙের ব্যবহার। দুই খোল ছাঁচের রঙিন পুতুলের মধ্যে নারীর শরীরে যেভাবে বিভিন্ন রঙ মিশিয়ে শাড়ি ও অলংকার দেওয়া হয়, এখানে তেমনটা নেই। ন্যূনতম তুলির টানে অনবদ্য অভিব্যক্তিই হচ্ছে কাঁঠালি পুতুলের সৌন্দর্য। তা নির্মেদ। ছন্দের মতো গতিশীলতা নিয়ে সে জাঁতাকলে কাজ করে যাচ্ছে। আবার ঢেঁকিতে ধান ভানছে। ঐক্যবদ্ধ নারীত্বের প্রতীক হয়ে সহনারীর মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে। স্নেহশীলা ভঙ্গিতে শিশুকে কোলে বসিয়ে তেল মাখাচ্ছে। সংসার সীমান্তের তীব্র সংগ্রামে শিশুকে কোলে করে নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে দুধ দিয়ে সে হয়ে উঠছে গোয়ালিনী।
এখানে বিশেষ দ্রষ্টব্যের বিষয় হচ্ছে– কাঁঠালিয়ার প্রতিটি পুতুলই সধবা! নারীত্বের এই জয়জয়কারের মধ্যে হাতি ও ঘোড়ায় বসা লাল টুপি গোঁফওয়ালা পুতুলটি বিশেষ কৌতূহল তৈরি করে থাকে। সাধনবাবুর কথায়, এই পুতুলকে ‘সেপাই’ বলা হয়। স্বাধীনতার আগে থানার দারোগারা ঘোড়া ও পরিস্থিতি অনুযায়ী হাতির পিঠে চড়ে বিভিন্ন গ্রামে টহল দিয়ে বেড়াত। গ্রামীণ জনগণ এদের ‘সেপাই’ বলে ডাকত। তবে থেকেই এই পুতুলকে সেপাই বলা হয়। কাঁঠালিয়া পুতুলের নারীত্ব প্রসঙ্গে শিল্পী জানিয়েছেন, রাজা শশাঙ্কের স্মৃতিবিজড়িত কর্ণসুবর্ণ অঞ্চলে যখন প্রত্নখনন হয়েছিল, তখন পোড়ামাটির পুতুল উৎখননে বেরিয়ে এসেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সেই পুতুলগুলো সঙ্গে কাঁঠালিয়া পালপাড়ায় তৈরি পুতুলের মিল ছিল।
পরবর্তী প্রজন্ম শিখছে? এই প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী সাধন পালের মুখ হতাশায় ভরে উঠল। উদাস কণ্ঠে তিনি বললেন, বহুবার এলাকার নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পুতুল তৈরির সেই সংস্কৃতিটাই এখানকার পরিবারগুলোর মধ্যে থেকে উঠে গিয়েছে! আসলে শিল্পচর্চার অভ্যাস থাকা চাই, তা নেই বলেই সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। মৃৎশিল্পীরা অন্যান্য মৃৎশিল্প তৈরি করলেও পুতুলের প্রতি তাদের মনোযোগের অভাব। আর এই সকল মৃৎশিল্পীদের কল্যাণের জন্য শিল্পী সাধন পালের চেষ্টা গড়ে উঠেছে কাঁঠালিয়া মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি লিমিটেড। তার সঙ্গে যুক্ত ৩৮৬ জন স্থানীয় মৃৎশিল্পী।
কথায় বলে সংকট শিল্পীকে সমৃদ্ধ করে। অকাল অনলে ঘর পুড়ে যাক বা মন ভেসে যাক প্রলয়ের জলে, তবুও সাধনবাবুর মতো শিল্পীরা সৃজনের পথেই থাকবেন। বাহাদুর শাহ জাফর যেমন মুঘল বংশের শেষ সম্রাট ছিলেন বা সিরাজ যেমন স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব, তেমনই কাঁঠালিয়া পুতুলের শেষ রক্ষক সাধন পাল নিজের সাধ্যের ঊর্ধ্বে উঠে এই শিল্পশৈলীকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ৭৫-এর বিদ্রোহী তরুণ আজও গর্জন করে তার তুলির টানের মাধ্যমে।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………………