ডিএম লাইব্রেরী, হিন্দুস্তান লাইব্রেরী, বাণী লাইব্রেরী, ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরী, অভয় লাইব্রেরী, বীণাপানি লাইব্রেরী, দেব লাইব্রেরী, শশধর লাইব্রেরী, হুইলার লাইব্রেরী, রায় লাইব্রেরী– বলতে পারবেন এগুলোর মধ্যে মিল কোথায়? না, কোনওটিই সে অর্থে ‘লাইব্রেরি’ নয়। অর্থাৎ হাল আমলে ‘লাইব্রেরি’ বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা ভাবেন, বসে বই পড়া, বই নেওয়া ইত্যাদি কোনও কিছুই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় না। এদের মধ্যে কোনওটি বই প্রকাশনা সংস্থা, কোনও কোনওটি কেবলই বই-বিক্রেতা। কিন্তু এদের প্রত্যেকের নামেই রয়েছে ‘লাইব্রেরি’। গোটা বইপাড়ায় এমন অজস্র প্রকাশনা, বই বিপণি রয়েছে যাদের নামে ‘লাইব্রেরি’ শব্দটি রয়েছে। কেবল কলেজ স্ট্রিটই বা বলি কী করে, জেলায় জেলায় এমন হাজার হাজার বইয়ের দোকান রয়েছে, যারা ‘লাইব্রেরি’ শব্দটা দোকানের নামে ব্যবহার করে। দিল্লিতেও প্রকাশনা, বইয়ের দোকানের নামে এমন দেখা যায়।
কিন্তু এর নেপথ্য কারণ কী?
নামে ‘লাইব্রেরি’ থাকলে কি গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যায়? সংস্থাটি পাঠক, লেখকদের, বইপ্রেমী, ক্রেতাদের কাছে আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে লাইব্রেরি নামের দৌলতে? এটি কি নিছক বিপণন কৌশল? উত্তর: একেবারেই না! অন্তত নামে ‘লাইব্রেরি’ থাকা প্রকাশনা সংস্থা, বই-বিক্রেতাদের বক্তব্য গ্রহণযোগ্যতার কোনও ব্যাপার নেই। তখন এটাই চল ছিল।
তখন? তখন বলতে কখন? কবে?
লক্ষ করে দেখলাম বয়সে ১০০ বা ১০০ ছুঁই ছুঁই, নিদেনপক্ষে ৮০-৯০ বছরের পুরনো সংস্থাগুলোর নাম এমন। বাণী লাইব্রেরীর কর্ণধারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি জানালেন, ‘‘আমরা কেবল বুক সেলার্স। তিন পুরুষের দোকান, পূর্বপুরুষ নাম রেখে গিয়েছেন। লাইব্রেরি মানে ‘কালেকশন অফ বুকস’, ডিকশনারি দেখুন, তাই-ই পাবেন। আমাদের নামে লাইব্রেরির মানে ‘কালেকশন অফ বুকস ফর সেলিং’, লেন্ডিং নয়।’’ দোকানের বোর্ডে জ্বল জ্বল করছে ‘Bani Library Book Sellers Since 1943’
।
কথা হল ‘হিন্দুস্তান লাইব্রেরী’র বর্তমান কর্ণধার শিবেশ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘নাম তো আমার বাবা দিয়েছিলেন, কেন রেখেছিলেন জানি না। তবে তখন এমন নামই রাখা হত।’ উদাহরণ হিসেবে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম বললেন তিনি। ‘হিন্দুস্তান লাইব্রেরী’ ১৯৪৬ সালের দোকান। ‘ডিএম লাইব্রেরী’-র অরিত্রগোপাল মজুমদারের সঙ্গেও কথা হল এ ব্যাপারে। জানালেন, ‘এখনও লোক জিজ্ঞাসা করে, আপনাদের ওখানে কি বসে বই পড়া যায়?’
‘লাইব্রেরি’ শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের মতো অভিধানগুলো বলছে ‘কালেকশন অফ বুকস’ অর্থাৎ এমন এক জায়গা যেখানে বইয়ের ভাণ্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে বইয়ের দোকান, প্রকাশনাকে ‘লাইব্রেরি’ বলাই যায়। কারণ তারাও পুস্তকভাণ্ডার। বাঙালির মনে ‘লাইব্রেরি’ মানেই গেঁথে গিয়েছে এমন এক জায়গা যেখানে বসে বই পড়া যায়, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বই নিয়ে আসা যায় যেখান থেকে। ‘রিডিং লাইব্রেরি’ থেকে ‘রিডিং’ অংশটুকু লুপ্ত হয়েছে। অন্যদিকে, যে-সব বই বিক্রেতা সংস্থা বা প্রকাশনার নামে লাইব্রেরি হয়েছে, তারা ‘বুক সেলার্স ও পাবলিশার্স’ শব্দ দু’টিও ব্যবহার করেন। যেমন, ‘দেব লাইব্রেরি বুক সেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স’– ডিএম লাইব্রেরীও তাই। চলতি কথায় কেবল ‘ডিএম লাইব্রেরী’টুকুই ব্যবহৃত হচ্ছে।
বইপাড়ার প্রকাশনা, বই বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের নামে ‘লাইব্রেরি’ শব্দটা রাখা উনিশ, বিশ শতকে কার্যত নিয়মের মতো হয়ে গিয়েছিল। আজকের ভাষায় যাকে বলে ‘ট্রেন্ড’। একে ব্রিটিশ আমলের ফসল বলা যেতে পারে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এমনটা দেখা যায়। সে-সময় এমন নাম রাখা কোনও রকমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর কৌশল ছিল না। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বাড়তেই নামে ‘লাইব্রেরি’ শব্দের আগমন ঘটত। কিন্তু গত ৫০-৬০ বছরে যে প্রকাশনাগুলো গড়ে উঠেছে তারা আর ‘লাইব্রেরি’ শব্দের ব্যবহার করেনি। তার কারণ হয়তো ‘লাইব্রেরি’র কেবল পাঠাগার পরিচিতি নিয়ে মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসা। পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো; যারা আজও ব্যবসা চালাচ্ছে তাদের নামে এখনও ‘লাইব্রেরি’র দেখা মেলে।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: অরিত্রগোপাল মজুমদার
প্রচ্ছদ ছবি: সোমোশ্রী দাস