ছেলেকে পিছনে বসিয়ে স্কুটি চালাচ্ছিলাম। সামনেই এক ব্লাইন্ড গলি। উল্টোদিক থেকে একটা সাইকেল বিনা হর্নে চলে এসেছিল। আমি ব্রেক কষলেও স্কুটি উল্টে গেছিল। আমি তখন আমার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করছি। কিন্তু কী আশ্চর্য সে স্কুটির পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছি লাগেনি তো? সে হেসে বলেছে ‘আমি তো নেমে গেছিলাম।’ কিন্তু অ্যাকসিডেন্টের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি জানি সে আমার কোমর জড়িয়ে বসেছিল। তাহলে তাকে নামাল কে? লিখছেন অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য
এই বাড়িতে আমরা পাঁচজন ছাড়াও কেউ ছিল। এখন আমরা তিনজন, কিন্তু এখনও কেউ আছে। ভুল বললাম, অনেকে আছে। চোখের পলকে যারা দৃশ্যমান হয়েও নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এখন কাউকে বলি না তাদের অস্তিত্বের কথা। বললে ভয় পাবে। একসময় আমিও ভয় পেতাম। এখন পাই না।
বিয়ে হয়ে যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসি, মানে এই বাড়িতে আসি, তখন সদ্য কলেজ পাশ করা এক যুবতী। সারা দুপুর দোতলার ঘরে বসে গল্পের বই পড়তাম। ভাতঘুমের অভ্যেস ছিল না।আমার চোখ-কান-নাক এই তিনটে একটু বেশি সজাগ। আমার শোয়ার ঘর পেরিয়ে লম্বা হলঘর তারপর আমার জ্যাঠশ্বশুরমশাইয়ের ঘর ছিল। তিনি দুপুরে নিচের ঘরেই শুতেন। কিন্তু আমি সারাদুপুর শুনতাম কেউ যেন সেই ঘরে হাঁটছে, ঝাড় দিচ্ছে।
ঠিকে কাজের মেয়েটির থেকে শুনলাম সে একা কখনও দোতলায় ঘর মুছতে আসে না। তার মনে হয় কেউ যেন ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে জ্যাঠশ্বশুরমশাইয়ের ঘরটিতে। একসময় এই ঘরেই ওঁর স্ত্রী থাকতেন। তবে তিনি এই বাড়ি বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। খুব কষ্ট পেয়ে মারা যান। আমার শাশুড়িমাও আমার বিয়ের আগেই মারা যান।এদের দু’জনেরই খুব প্রিয় ছিল দুটো ঘর। যেখানে আমি থাকি সেটিতে একসময় আমার শাশুড়িমা থাকতেন।
বিয়ের পরে পরে এই ভয় পাওয়ার জন্য আমি ঘরে বসে গীতা পাঠ করতাম। হনুমান চালিশা পাঠ করতাম। সারা বাড়িতে ধূপকাঠি দেখিয়ে মনে মনে বলতাম– এই বাড়িতে এখন জীবিতের বাস। আমি এখানে থাকতে এসেছি আমাকে কিছুতেই তাড়াতে পারবে না। বয়স বেড়েছে, পরে মনে হয়েছে নিছক ছেলেমানুষি। কারণ যারা এই বাড়িতে আছে, তারা আমার কোনও ক্ষতি করেনি কখনও।
আরও পড়ুন: জুলুকের হোমস্টের-র সেই রাত
এই বাড়িতে যাদের দেখেছি আমি– একজন বুড়িমা। যাকে আমি মাঝে মাঝেই দেখতাম আর মন খারাপ করা অগুরুর গন্ধ পেতাম। যখন দেখতাম চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেন। তারপরেই কোনও বাজে খবর পেতাম। কারও চলে যাওয়ার খবর। একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখতাম যে নিমেষে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেত। তার পায়ের শব্দ বাড়ির সবাই শুনতে পেয়েছে। কিন্তু আমি তাকে একঝলক দেখেছিলাম। রান্নাঘরে এক মহিলাকে দেখেছি ঢুকেই মিলিয়ে যেতে। ক্রমশ ভয় কেটে গেছে। হয়তো তারা আমাদের উপকার করার জন্যই এই বাড়িতে ছিল।
আরও পড়ুন: আড়াই দশক আগের দৃশ্য, আজও আমি স্পষ্ট দেখি
একদিনের ঘটনা বলি। বাড়ির সামনে ছেলেকে পিছনে বসিয়ে স্কুটি চালাচ্ছিলাম। সামনেই এক ব্লাইন্ড গলি। উল্টোদিক থেকে একটা সাইকেল বিনা হর্নে চলে এসেছিল। আমি ব্রেক কষলেও স্কুটি উল্টে গেছিল। একদম ধরাশায়ী। সাইকেলের চাকাও বেঁকে গেছিল। সাইকেল আরোহী ঝগড়া জুড়েছে। সে কিছুতেই তার ভুল স্বীকার করবে না। আমি তখন আমার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে চিন্তা করছি। কিন্তু কী আশ্চর্য সে স্কুটির পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুই হয়নি। তাকে যখন জিজ্ঞেস করেছি লাগেনি তো? সে হেসে বলেছে ‘আমি তো নেমে গেছিলাম।’ কিন্তু অ্যাকসিডেন্টের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি জানি সে আমার কোমর জড়িয়ে বসেছিল। তাহলে তাকে নামাল কে? তার নিজের একার পক্ষে নামাটাও অসম্ভব। জানি না সেদিন আমার ছেলেকে কে রক্ষা করেছিল ভগবান নাকি সেই অদৃশ্য মানুষগুলো।
এখন আমরা তিনজন। জ্যাঠশ্বশুর মারা গেছেন ২০১৬ সালে আর আমার শ্বশুরমশাই মারা গেছেন ২০২০, হার্ট অ্যাটাকে। জানুয়ারি, তখনও কোভিড আসেনি। এখন আমার ভয় নেই।বলতে গেলে ভূতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পরও নিচে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ঘর থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ আসত। যেন উনি এখনও ওখানেই বসে আছেন। রাতে লাইট অফ করে গেলেও সকালে দেখতাম ওই ঘরের লাইট জ্বলছে। অনেকদিন জেঠুর পায়ের শব্দ পেয়েছি। মৃত্যুর আগে শেষ পাঁচ বছর উনি নিচেই শুতেন ভাইয়ের পাশে। ওই খাটেই জেঠুর মৃত্যু হয় হার্ট অ্যাটাকে ২০১৬ সালের এক শীতের রাতে।
তারপর থেকে নিচে রাতে কেউ শুতে চাইত না। একদিন মাঝরাতে আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হয়। আমার ঘরে ওষুধ থাকলেও নিচে রান্নাঘরে ছিল বিস্কুটের কৌটো। অন্তত চারটে বিস্কুট না খেয়ে ট্যাবলেট খাওয়া উচিত নয়। তাই সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাথরুম থেকে কল খুলে বালতিতে জল ভরার শব্দ পেলাম। কিন্তু রাতে তো কল বন্ধ করে গেছি। ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে তিনটে। আমার শ্বশুরমশাই রোজ এই সময় উঠে চা খেয়ে বাথরুম সেরে চারটের মধ্যে হাঁটতে বেরতেন। এটা খানিকটা ওঁর বাতিক ছিল। আমি জোরে কাশতেই বাথরুমে জল পড়ার শব্দ বন্ধ হল। আমি বিস্কুটের কৌটো নিয়ে দৌড়ে দোতলায়। মৃত মানুষের সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলাই ভালো।
আরও পড়ুন: আঁধার রাতের অচেনা সঙ্গী
এই বছরের প্রথম দিকে পিণ্ড দান করা হয়েছে। আমার মনে হত অনেক মানুষ তাদের অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে প্রেত হয়ে এই বাড়িতে বন্দি। এবার তারা মুক্তি পেয়েছে। গতমাসে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাঝরাতে বদহজম হয়ে বাথরুমে বমি করছি। হলঘরের লাইট অন করিনি। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি বাথরুমের বন্ধ দরজার বাইরে জেঠুর পায়ের শব্দ। আসলে জেঠুর পায়ে অসুবিধা থাকায় ডান পা কিছুটা টেনে চলত। এর জন্য মেঝেতে চটি ঘষে চলার একটা শব্দ হত। আমরা বুঝে যেতাম জেঠু আসছে।
বাথরুমের বন্ধ দরজার ভিতর থেকে মনে হচ্ছে জেঠু অন্ধকারে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আমাদের কিছু হলে এমনভাবেই অস্থির হয়ে উঠত। দরজা খুলে অন্ধকারে দেখলাম কেউ নেই। ঘরে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। আমি জানি না পিণ্ডদানে আত্মার মুক্তি হয় কি না।কিন্তু আমি নিশ্চিত সেদিন সত্যি জেঠু এসেছিল।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved