বৃষ্টিঘেরা এক জুলাই মাস চলছে এখন। আজ থেকে ১১৩ বছর আগে, এই জুলাই মাসেই রবীন্দ্রনাথের দু’টি বই মাত্র দু’দিনের ফারাকে প্রকাশিত হয়েছিল– ২৫ জুলাই ও ২৮ জুলাই, ১৯১২। দু’টি গ্রন্থেরই একই প্রচ্ছদপট– আচার্য নন্দলাল বসু অঙ্কিত সূ্র্যের দিকে চেয়ে থাকা সেই আশ্চর্য কমললতাটি।
একটি আন্দোলিত পদ্ম। খসে পড়ছে তার পাপড়ি। চামড়ার মলাটে সোনার রঙে ‘এমবস’ করা এক অনিন্দ্যসুন্দর রেখাচিত্র। ছবির ওপরে সোনার রঙেই খোদাই করা– ‘ছিন্নপত্র’ ও তার নিচে লেখকনাম ‘রবীন্দ্রনাথ’। ছিন্নপত্রের প্রতীকরূপে লাবণ্যময় এই ছবিটি আঁকলেন আচার্য নন্দলাল বসু। গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বেঙ্গল লাইব্রেরী’ ক্যাটালগ অনুসারে, ২৮ জুলাই, ১৯১২, রবিবার ‘ছিন্নপত্র’ প্রকাশিত হয়।
১৫৩টি চিঠির সংকলন ছিন্নপত্র। তার মধ্যে বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে ৮টি এবং ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা ১৪৫টি চিঠি। এগুলি লেখা হয়েছিল সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ থেকে ডিসেম্বর ১৮৯৫ সময়কালের মধ্যে। সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন কবি স্বয়ং। ‘ছিন্নপত্র’ রবীন্দ্রজীবনের নিবিড় অধ্যায় এক। তাই এ রচনা পড়ার জন্য বিশেষ মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন এবং নিভৃত পাঠেই এই পত্রকাব্যটিকে উপলব্ধি করা সম্ভব।
প্রচ্ছদে পদ্মের পাপড়ি খসে পড়ার অনুষঙ্গটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এ যেন জীবনের উদযাপন। এক নূতনের সূচনা। মায়া ত্যাগ করে জ্ঞান ও মুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার আভাস ছিন্নপত্র-র পাতায় পাতায়। চিঠিগুলির উৎস পদ্মা ও পদ্মা-তীরবর্তী নানা অঞ্চল। নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে জীবনের চক্রাকার আবর্তন কোথায় যেন একাত্ম হয়ে যায়! পদ্মের পাপড়ি ঝরে পড়া সেই ভাবনারই অনুরণন। ছিন্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের সমগ্র চৈতন্য উদ্ভাসিত! তাঁর জগৎবোধ, প্রকৃতি চেতনা প্রতিটি চিঠিতে সীমাহীন অনুভবে ও অধীর আবেগে ঝরে ঝরে পড়ে, যেন কমলদল খসে খসে পড়ছে।
যে-চিত্র একান্তভাবে ‘ছিন্নপত্র’র জন্যই নির্মাণ, আশ্চর্য লাগে সেই চিত্রই ব্যবহৃত হল ‘জীবনস্মৃতি’র মলাটে। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল, জীবনস্মৃতি-র প্রচ্ছদে রোটেনস্টাইনের আঁকা একটি রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি মুদ্রিত হয়। সেই সূত্রে তিনি নগেন্দ্রনাথ-মীরাদেবীকে ১২ জুলাই ১৯১২-তে লেখেন, “Mr. Rothenstein has done some very fine drawings of father’s-one of which I am having reproduced here and will shortly send you out a thousand copies…” কিন্তু জীবনস্মৃতি তার ক’দিন পরেই ২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়। সুতরাং, রথীন্দ্রনাথের প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না। বলা বাহুল্য, জীবনস্মৃতি-র প্রকাশকও নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
গ্রন্থ অলংকরণের এক অসামান্য দৃষ্টান্ত ‘জীবনস্মৃতি’। চাইনিজ ইঙ্ক ও তুলির সাহায্যে জীবনস্মৃতির চিত্রায়ণ করেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সময় কোনও উড-ব্লক নির্মাতার সাধ্য ছিল না গগনেন্দ্রনাথের ছবির তরল রঙের ছড়িয়ে পড়া আর ঘন হওয়াকে মুদ্রণোপযোগী রূপ দেওয়া। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছাপাখানা ‘ইউ. রে. এন্ড সন্স’ বাংলা মুদ্রণ জগতে তখন আলোড়ন তুলেছিল। বিভিন্ন পত্রিকার অলংকরণের বহু ব্লক তৈরি হত তাঁর ছাপাখানাতেই। তিনিই ভারতে প্রথম হাফটোন ব্লক নির্মাণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন এবং রঙিন ব্লক তৈরি ও তার ব্যবহারের সূচনা করেন। পুত্র সুকুমার রায়কে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাপার আধুনিক কলাকৌশল শেখার জন্য ভর্তি করেন। হাফটোন পদ্ধতিতে ছবি ছাপার উন্নতি দেখে উৎসাহিত হয়ে গগনেন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির জন্য অসামান্য ছবিগুলি এঁকেছিলেন। জীবনস্মৃতি-র ব্লকগুলি উপেন্দ্রকিশোরের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়। বিলেতে থেকেও সুকুমার সে সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছেন পিতার কাছে। কবির সরস লেখার সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্কিত চিত্র যুক্ত হয়ে মণির সঙ্গে কাঞ্চনের যোগের মতো অপূর্ব শোভায় এই গ্রন্থ চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
আবার ‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় পাতায় যাঁর ছবি, সেই গগনেন্দ্রনাথ একটি আশ্চর্য পেলব ছবি আঁকলেন ‘ছিন্নপত্রাবলী’কে স্মরণ করে। ছিন্নপত্র-র বেশিরভাগ চিঠিতে মূল সুরটা বাজায় পদ্মা নদী। গগনেন্দ্রনাথ আঁকলেন সেই লাবণ্যময়ী পদ্মা, তার স্তব্ধ চর, মাথার ওপর বিছিয়ে থাকা আকাশে সারিবদ্ধ পক্ষীকুলের রেখা। অলৌকিক দিগন্তে নিবিড় রঙের ছোঁওয়া। আর একলা উদাস বোটখানি। এই একটি ছবিই যেন সমগ্র ছিন্নপত্রাবলীর অনুবাদ। এই চিত্রের এমনই অভিঘাত।
বাঙালির শাশ্বত এক চৈতন্যের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছিন্নপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভাবে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মত বিদায় দিই।’ লিখেছেন, ‘সেই বিলেত যাবার পথে লোহিত সমুদ্রের স্থির জলের উপরে যে-একটি অলৌকিক সূর্যাস্ত দেখেছিলুম সে কোথায় গেছে।… অনন্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি অত্যাশ্চর্য সূর্যাস্ত আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো কবি দেখে নি।’ এ চিঠি কবি লেখেন শিলাইদহ থেকে। আষাঢ়ের দ্বিতীয় দিনে। তখন তাঁর দৃষ্টিজোড়া বিষণ্ণতা আর সৃষ্টিছাড়া সুখ।
আবার জীবনস্মৃতি-র প্রথম পাণ্ডুলিপিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘কাব্যরচনা ও জীবনরচনা ও-দুটা একই বৃহৎ রচনার অঙ্গ। জীবনটা যে কাব্যেই আপনার ফুল ফুটাইয়াছে আর কিছুতে নহে, তাহার তত্ত্ব সমগ্র জীবনের অন্তর্গত।… এই রকমে পদ্মের বীজকোষ এবং তাহার দলগুলির মতো একত্রে রচিত আমার জীবন ও কাব্যগুলিকে একসঙ্গে দেখাইতে পারিলে সে চিত্র ব্যর্থ হইবে না।’ জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের হৃদয়পদ্ম বিকশিত। তখনই বোধহয় পদ্মশোভিত প্রচ্ছদপটটি অমোঘ বলে মনে হয়।
‘জীবনস্মৃতি’ ও ‘ছিন্নপত্র’– এই দুই অবিস্মরণীয় রবীন্দ্ররচনা একইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল, মধ্যে মাত্র দু’টি দিনের ব্যবধানে– ২৫ জুলাই ও ২৮ জুলাই, ১৯১২ সাল। এ বেশ আশ্চর্যের বিষয় এবং আরও চমকিত হই যখন দেখি দু’টি গ্রন্থেরই একই প্রচ্ছদপট– আচার্য নন্দলাল বসু অঙ্কিত সূ্র্যের দিকে চেয়ে থাকা সেই আশ্চর্য কমললতাটি।
………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………….