প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। ফলে বিলেত থেকে আসছে না রেইনকোট আর ওয়াটারপ্রুফ ক্যানভাস। যে ক’টা আসে তারও সিংহভাগ সাহেব সৈন্যদের। এদেশে ও জিনিস তৈরিই হয় না তখন। দেশপ্রাণ বাঙালিটি বিজ্ঞানের ছাত্র। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রি পড়ে এসেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কী লাভ সে পড়ায়, যদি তা দেশের কাজেই না লাগল! অন্তরীণ অবস্থাতেই তাই ছোটখাটো একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তুললেন তিনি। মজে গেলেন কম দামের ওয়াটারপ্রুফ কাপড় আর ক্যানভাস তৈরির গবেষণায়।
সাদা বাঘের জন্য বিখ্যাত ‘রেওয়া’য় শিল্পোন্নয়নের ভার নিয়ে এসেছেন এক বাঙালি। তাঁকে কড়া নজরে রেখেছে ব্রিটিশ সরকার। কারণ আমেরিকায় পড়ার সময় ব্রিটিশ-বিরোধী বক্তৃতায় রীতিমতো নাম করে এসেছেন তিনি। শেষে প্রিন্সলি স্টেট রেওয়াতেই একদিন গ্রেফতার করা গেল তাঁকে– ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনে। নিয়ে আসা হল যুক্তপ্রদেশের (এখন উত্তরপ্রদেশের) হামীরপুরে। রাখা হল অন্তরীণ করে। অন্তরীণ অবস্থায় একদিন খবরের কাগজে বাঙালিটি বর্ষায় ভারতীয় সেনাদের অশেষ দুর্গতির খবর পড়লেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। ফলে বিলেত থেকে আসছে না রেইনকোট আর ওয়াটারপ্রুফ ক্যানভাস। যে ক’টা আসে তারও সিংহভাগ সাহেব সৈন্যদের। এদেশে ও জিনিস তৈরিই হয় না তখন। দেশপ্রাণ বাঙালিটি বিজ্ঞানের ছাত্র। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রি পড়ে এসেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কী লাভ সে পড়ায়, যদি তা দেশের কাজেই না লাগল! অন্তরীণ অবস্থাতেই তাই ছোটখাটো একটা ল্যাবরেটরি গড়ে তুললেন তিনি। মজে গেলেন কম দামের ওয়াটারপ্রুফ কাপড় আর ক্যানভাস তৈরির গবেষণায়।
বিদেশি বহুমূল্য ম্যাকিনটশের একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগে সুরেন্দ্রমোহন বসুর ওই গবেষণাই নিয়ে এল প্রথম স্বদেশি বর্ষাতি। বাঙালি শিল্পোদ্যোগের তালিকায় প্রথম সারিতে নাম উঠে গেল ‘বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্কস’-এর, যুদ্ধশেষে মুক্তি পেয়ে কলকাতায় ফিরে নিজেদের বসতবাড়িতেই যে সংস্থার পত্তন করেন সুরেন্দ্রমোহন। সঙ্গী ছিলেন তিন ভাই– যোগীন্দ্রমোহন, অজিতমোহন ও বিষ্ণুপদ।
১০৫ বছর আগে সেই সংস্থার জন্ম। সুরেন্দ্রমোহন প্রয়াত হয়েছেন ৭৭ বছর আগে। তবু আজও বাঙালির বর্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের প্রথম বর্ষাতি-ব্র্যান্ড ‘ডাকব্যাক’। এ বর্ষাতি রাবারের নয়। সংস্থার শুরুর কাজ ছিল কেমিক্যাল-প্রুফিং পদ্ধতিতে বর্ষাতি ইত্যাদি তৈরি করা। সে পদ্ধতিতেই উচ্চ মানের বর্ষাতি তৈরি হয়, তার দামও পড়ে রাবারের জিনিসের থেকে বেশি। কিন্তু শুধু মুনাফা করা তো বাঙালির ওই স্বদেশি শিল্পের লক্ষ্য ছিল না। তাই বেশি দামের বর্ষাতিই এল বাজারে, পরোক্ষে পরিবেশও বাঁচল।
সুরেন্দ্রমোহন জন্মেছিলেন ১৮৮২-তে, ঢাকার বামনতিতায়। গয়া জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ভাগলপুর টি. এন. জুবিলি কলেজ থেকে এফ.এ. পাশ করে ঢাকা কলেজে বি.এস-সি. পড়তে শুরু করেন। দেশে তখন স্বদেশির জোয়ার। সে জোয়ারে কেবল বিদেশি জিনিস বর্জনই ছিল না, ছিল দেশি শিল্প তৈরির চেষ্টাও। কিন্তু বিজ্ঞান, বিশেষ করে প্রায়োগিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভালো করে শেখার ব্যবস্থা ছিল না দেশে। তাই ১৯০৫-এ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বছরেই, বাংলা ছেড়ে জাপান পাড়ি দিলেন সুরেন্দ্রমোহন, যোগীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ স্কলারশিপ পেয়ে। দেড় বছর হাতে-কলমে রঞ্জনশিল্প ও কাপড় ছাপাইয়ের কাজ শিখলেন। তার পরে আমেরিকার। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিস্ট্রি’তে বি.এ. ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এস-সি. পাশ করলেন। কেবল পড়াশোনা নয়, আমেরিকায় জড়িয়ে পড়লেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও। ‘হিন্দুস্থান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে ভাষণ দিয়ে বেড়াতেন। ১৯১৩ সালে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া ভারতীয় ছাত্রদের ওই সংগঠন গঠিত হয়। পরের বছর সেপ্টেম্বরে সুরেন্দ্রমোহন গদর-পার্টির সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে গ্রেফতারও হন। তখন থেকেই ভারতে ইংরেজ সরকারের কড়া নজর ছিল তাঁর উপর।
জন্মের ১১ বছর পরে ১৯৩১-এ বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ ওয়ার্কস হল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। পানিহাটির বেঙ্গল কেমিক্যালের কাছে তৈরি হল বিরাট কারখানা। ১৯৪০-এ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হয়ে আরও সম্প্রসারিত হল বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফ। ততদিনে ‘ডাকব্যাক’ আর শুধু বর্ষাতিতে আটকে নেই, তৈরি করছে চিকিৎসা-সহায়ক জিনিসপত্র, বাতাস-বিছানা, বাতাস-বালিশ, ছাপাখানার রোলার। এমনকী অ্যান্টি-করোসিভ রাবার-যৌগ তৈরি করে তাই দিয়ে চলছে জলের ট্যাঙ্ক লাইনিংয়ের কাজও।
এই বিপুল সাফল্যেও সুরেন্দ্রমোহন ভোলেননি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। ১৯৪৬-এ, তাঁর মৃত্যুর বছর দুয়েক আগেও বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফে চাকরি দিয়েছেন সুভাষচন্দ্রের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির প্রাক্তন সৈন্যদের। বাঙালির বাণিজ্য-শিল্প ঐতিহাসিক বিশ্বকর্মা আলাপ করেছিলেন তেমনই একজনের সঙ্গে, কোম্পানির একজন গাড়িচালক শ্রীবুটা সিং। আই এন এ-তে তিনি সেনার গাড়ির চালক ছিলেন। তার পরে ২২ বছর কাজ করেছেন বেঙ্গল ওয়াটারপ্রুফে।
বাঙালির একেবারে শিকড়-ছোঁয়া এই শিল্পোদ্যোগের মালিকানা শতবর্ষ পেরিয়ে বদলেছে। তাতে কী! শত বর্ষার জলেও ধুয়ে যায়নি স্বদেশির উজ্জ্বল ইতিহাস।
…রেনকোট নিয়ে আরও লেখা…
প্রেমের রূপকথা যেন না ভেজে, তাই ‘রেনকোট’
ছেলেবেলার রেনকোট পাল্লা দিয়ে বড় হয় না কেন?
বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে যাওয়ার সময় তুমি আসলে হাসো
বাঙালির ছাতাবৃত্তান্ত জানতে চান? পড়ুন তবে নিচের লিংক থেকে!