‘হৃদয়ক্ষেত্রে খেলেনি ক্রিকেট; / চণ্ডবেগের ডাণ্ডাগোলায়’– কার কবিতার লাইন? এ প্রশ্নের জবাব শতকরা ৯০ জন বাঙালি দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। এ রবীন্দ্রনাথের ‘প্রহাসিনী’ কাব্যগ্রন্থের ‘নারীপ্রগতি’ কবিতার লাইন। উত্তর শুনে তাঁরা একটু অবাকই হবেন। খেলায়-টেলায় রবীন্দ্রনাথের কোনও আগ্রহ থাকতে পারে, এমন কথা সচরাচর বাঙালিরা ভাবতেই পারেন না, তার ওপরে আবার ক্রিকেট! রসিকতার ধরনটিও কেমন যেন অরাবীন্দ্রিক! একে তো ক্রিকেটের কথা, তায় পরের লাইনটি আরও মোক্ষম। এই তো সেদিন অবধি উত্তর কলকাতার রকে বসা বাঙালি ছেলে-ছোকরার দল প্রেমে পড়াকে ‘বোল্ড-আউট’ হওয়া বলত। রমণীয় যুবতীর দিক থেকে ধেয়ে আসা বলে যুবকের হৃদয়ে উইকেটের পতন। তা বলে রবীন্দ্রনাথও!
কবিতাটিতে একালের সঙ্গে সেকালের তুলনা রয়েছে। আধুনিক রমণীরা মোটর গাড়ি থেমে গেলে দ্রুত পদচারণায় ট্রেন ধরতে ওস্তাদ– সেকালের হরিণনয়না, গজগামিনীদের সঙ্গে কি একালের তুলনা চলে! এই গতিময় রমণীরূপ দর্শনে আধুনিক পুরুষ কবির হৃদয়ক্ষেত্রে ডাণ্ডাগোলায় খেলা চলতে পারে তার ইশারা রয়েছে এখানে! সেকালের কবি কালিদাস যেহেতু এই গতিময় খেলাধুলায় অভ্যস্ত ছিলেন না, তাই তাঁর পক্ষে আধুনিকা নারীদের গতিময় জীবনধারা কেমন লাগত বলা কঠিন। তিনি কি একালে জন্মালে আধুনিক কবিদের মতো বিরহকাব্যে মেঘকে দূত না করে তড়িৎগতি বিদ্যুৎকে দূত করতেন? ‘প্রহাসিনী’ এই নামের মধ্যেই তো কৌতুক আছে। এ যে কৌতুক করে লেখা, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। রবীন্দ্রনাথ হাসি-খুশি কৌতুকপ্রিয় মানুষ। সেই হাস্য-পরিহাস জীবনের শেষ পর্বেও অমলিন। জীবনের প্রান্তবেলায় ২১ এপ্রিল ১৯৪১-এ একটি কবিতায় লিখলেন, ‘ও আমার বেঁটেছাতাওয়ালি, / বৃথাই সময় তুই খোয়ালি।’ রবীন্দ্রকবিতার এই নারী সম্বোধন শুনে হিন্দি সিনেমাখোর যুবা বলতেই পারেন, ‘ও লাল দোপাট্টেওয়ালি’ ‘ও কালে কুর্তাওয়ালি’ ডেভিড ধাওয়ানের ‘আঁখে’ (১৯৯৩) সিনেমার হিট গানের এসব সম্বোধন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের দ্বারা অনুপ্রাণিত। কৌতুকহাস্যের মাত্রা নামতেও পারে, উঠতেও পারে।
রবীন্দ্রনাথের এই রসিকতার লক্ষ্য যাঁরা, সেই প্রগতিশীলাদের কেমন লেগেছিল কবিতাটি? নবনীতা দেবসেন তাঁর মা রাধারানী দেবীর ‘অপরাজিতা দেবী’ নামে রচিত কবিতাগুলির কথা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটির কথা উল্লেখ করেছিলেন সংগত কারণেই। অপরাজিতা দেবী রবীন্দ্রনাথের এই রসিকতার জবাব দিয়েছিলেন পাল্টা কৌতুক-কবিতায়। প্রাচীন ভারতে মোটেই নারীরা সবসময় গজেন্দ্র-গমনে চলতেন না। অপরাজিতা লিখলেন, ‘শুনেছিনু, নারী প্রাচীন ভারতে/ অশ্ববল্গা ধরেছিল রথে– / দ্রুত পলাইতে প্রিয়তমসহ।… / মণিপুর-সুতা– দুহিতা রাজার,– / করে লয়ে ধনু পিঠে তূণভার,/ পুরুষের বেশে ছুটেছে যখন,– / গজগামিনী কি ছিল সে তখন?’ অপরাজিতা-রাধারানীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতার চাপান-উতোর জমে উঠেছিল।
চাপান-উতোরের জগৎটি তিক্ত হয়ে ওঠেনি– ওঠার কথাও হয়তো নয়। তবে একটা প্রশ্ন উঠেই পড়ে। মেয়েদের যে-রূপে পুরুষরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্ত, সে-রূপের ও ভঙ্গির বদল হলেই কিন্তু পুরুষেরা বেশি-কম বিচলিত হয়ে পড়েন। রক্ষণশীল, উদার সব পুরুষেরই মুখেই তখন রসিকতার বুলি– সব রসিকতাই কি নির্ভেজাল? ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ছুঁড়িগুলো ‘আপন হাতে হাঁকিয়ে বগী, / গড়ের মাঠে হাওয়া খাবে।।’ লিখেছিলেন, ‘হুট বলে বুট পায়ে দিয়ে/ চুরুট ফুঁকে স্বর্গে যাবে।।’ ঈশ্বর গুপ্তের সঙ্গে কোনও অপরাজিতা অবশ্য কাব্যযুদ্ধে অবতীর্ণ হননি। কারণ দু’টি। প্রথমত, ঈশ্বর গুপ্ত যে সময় এ পদ্য লিখেছিলেন, তখনও বাঙালি মেয়েদের নিজস্ব স্বর খুব বেশি প্রবল হয়ে ওঠেনি– নারীমুক্তি আন্দোলনের সে প্রথম পর্ব। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর গুপ্ত তো রবীন্দ্রনাথের মতো লিবারেল বুর্জোয়া ভদ্রলোক শ্রেণির ইংরেজি-শিক্ষিত প্রতিনিধি নন। তাই তাঁর কাছে প্রত্যাশা কম। রবীন্দ্রনাথের কাজকর্ম তো নানা প্রত্যাশা তৈরি করে। তাই রবীন্দ্রনাথের বিপরীত আচরণ চিন্তার বিষয়।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় একদিকে যেমন মেয়েদের মুক্তির কথা নানাভাবে এসেছে তেমনই চোখে পড়ে নানা সময়ে নানা পিছুটান। তাঁর কন্যাদের যে বয়সে পাত্রস্থ করেছিলেন, তা প্রগতিশীল পিতা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে একেবারেই বেমানান। বলেন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াণের পর বলেন্দ্রনাথের বিধবাপত্নীর বিবাহের উদ্যোগ বন্ধ করার জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথের দূত বাধ্য সন্তান রবীন্দ্রনাথ। অনেক সময়েই মেয়েদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নয়– সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণে লিঙ্গ নিরপেক্ষতার যথেষ্ট অভাব চোখে পড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রর কমলাকান্ত স্ত্রীলোকের বিদ্যাকে নারকোল মালার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন– আধখানা বই পুরা দেখতে পাননি। রবীন্দ্রনাথও রমাবাইয়ের বক্তৃতা শুনে বিচলিত। জানান, ‘মেয়েদের একরকম গ্রহণশক্তি ধারণাশক্তি আছে, কিন্তু সৃজনশক্তির বল নেই।’ একথা যখন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তখন তিনি ‘গুরুদেব’ হয়ে ওঠেননি। তাই ঠাকুরবাড়ির ভেতর থেকেই তীব্র প্রতিবাদ এসেছিল। সহোদরা, লেখিকা স্বর্ণকুমারী দেবী প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপর তো নিজেকে ভাঙতে-ভাঙতে গড়তে-গড়তে রবীন্দ্রনাথ এগিয়েছেন। সেই নানা রবীন্দ্রনাথের ভাঙা-গড়ার মধ্যেও কি থেকে গিয়েছিল পিছুটান? তাই কি নারী-পুরুষের তুলনা উঠে এল আপাত নির্ভেজাল কৌতুকের আবরণে? না কি ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ হতে গেলে আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে বলে মাঝে মাঝে এইসব আপাত নির্ভেজাল কৌতুকের উদ্গার তুলে আমরা নিজেদের প্রশমিত করি! রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষও তাই করেন!