প্রায় অর্ধেক জীবন তারাশঙ্কর কাটিয়েছিলেন বীরভূমের গ্রামে গ্রামে। সেই অভিজ্ঞতা আর রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ পর্বের গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতার প্রকৃতি এক নয়। কিন্তু এক জায়গায় তারা এক। তা হল কাছে থেকে দেখার সততা। রবীন্দ্রনাথের গ্রামভাবনার প্রভাব তারাশঙ্করের গ্রামভাবনায় প্রায় কোথাও না পড়লেও তারাশঙ্কর তাই নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লি বিষয়ে ভেবেছিলেন।
মাঝখানের খাতটা খুঁজে পাননি রবীন্দ্রনাথ। বীরভূম আর শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের মাঝখানের খাতটা। আর সেই দূরত্বের বেদনাটা জানিয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে, মৃত্যুর কয়েক বছর আগে।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর শান্তিনিকেতনের একটা কোণ আগলে বসবেন। সেটা হয়নি। শ্রীনিকেতনের সঙ্গে গ্রামোন্নয়নের কাজে কিছুটা যোগাযোগ ছিল তারাশঙ্করের। তবু সে পাকাপাকি বসতির মতো নয়। কারণ তারাশঙ্কর বিশ্বাস করতেন গ্রামে না-থাকলে গ্রামের কাজ হয় না। আর সে গল্প শোনাতে গিয়ে আত্মকথা ‘আমার সাহিত্য-জীবন’-এ তারাশঙ্কর লিখছেন, ‘কবি নীরব হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, তাহলে তোমায় টানা অন্যায় হবে। তোমার ইচ্ছে নেই। একটু মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এ-জেলার লোকের কাছে এ-জায়গাটা বিদেশ হয়েই রইল। কোথায় যে রয়েছে মাঝখানের খাতটা! কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে উঠেছিল তাঁর। সে আমার আজও কানে বাজছে!’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………আরও পড়ুন: ড্রইং শুরু করার আগে পেনসিলকে প্রণাম করতে বলেছিলেন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বীরভূমেরই সন্তান তারাশঙ্কর। সে কেবল লাভপুরে তাঁর জন্ম বলেই নয়। বীরভূমের মাটি তাঁর রক্তে মিশেছিল বলে। প্রায় অর্ধেক জীবন তিনি কাটিয়েছিলেন বীরভূমের গ্রামে গ্রামে। সেই অভিজ্ঞতা আর রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ পর্বের গ্রামজীবনের অভিজ্ঞতার প্রকৃতি এক নয়। কিন্তু এক জায়গায় তারা এক। তা হল কাছে থেকে দেখার সততা। রবীন্দ্রনাথের গ্রামভাবনার প্রভাব তারাশঙ্করের গ্রামভাবনায় প্রায় কোথাও না পড়লেও তারাশঙ্কর তাই নিজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লি বিষয়ে ভেবেছিলেন। ১৯৭১ সালে এ বিষয়ে বিশ্বভারতীতে নৃপেন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি বক্তৃতামালায় ভাষণও দিয়েছেন। সে ভাষণ নিছক বই-পড়া জ্ঞানের ভাষণ নয়, এক স্রষ্টার চোখে আর এক স্রষ্টাকে দেখা। ওই ভাষণমালার কথামুখেই তাই তারাশঙ্কর বলে রাখেন, ‘আমি একজন কথাকার মাত্র। আমাদের চারিপাশে যে প্রভূত জ্ঞানের সম্ভার থরে থরে নানা গ্রন্থরাজির মধ্যে গ্রন্থিত ও সজ্জিত তা থেকে আমি জীবনে সামান্যই সঞ্চয় করতে পেরেছি। আমার যেটুকু জ্ঞান বা উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা তার অধিকাংশই আমি অর্জন করেছি আমার সম্মুখে প্রবাহিত প্রত্যক্ষ জীবনের শোভাযাত্রা থেকে। সে শোভাযাত্রায় রাজা ছিল না, ধনী ছিল না, ছিল সাধারণ মানুষ, এদেশের এখানকার এই অঞ্চলের মানুষ।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ‘নারীদের সম্মান না দিয়ে আমার জীবন কখনওই সম্পূর্ণ নয়’ বলেছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছও তো এই প্রত্যক্ষ জীবনেরই শোভাযাত্রা। কাছে থেকে দেখা জীবনের সত্য যে অনেক সময় গড়ে তোলা কাহিনির চেয়েও বিস্ময়কর, সে কথা জানতেন তিনি। তারাশঙ্করের ডাইনির বাঁশি গল্প তাই ভাল লেগেছিল তাঁর। শান্তিনিকেতনে যখন দেখা হল রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছেন, ‘দেখবে– দুচোখ ভরে দেখবে। দূরে দাঁড়িয়ে নয়। কাছে গিয়ে পাশে বসে তাঁদের একজন হয়ে যাবে। সে শক্তি, সে শিক্ষা তোমার আছে।’ এই সূত্রে তারাশঙ্কর তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের নানা আশ্চর্য চরিত্র পোস্টমাস্টার, রতন, ফটিক, ছিদাম রুই, দুখীরাম রুইদের কথা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওদের দেখেছি। পোস্টমাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারীতে। ওই যারা কাছে এসেছে, তাদের কতকটা দেখেছি কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।’
কিন্তু ডাইনির বাঁশি পড়ে কলকাতার একজন বড় পণ্ডিত সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘উইচক্র্যাফট নিয়ে বাংলা গল্প! এ নিশ্চয় ইউরোপের গল্প। ওদের দেশের গল্প পড়ে লিখেছে।’ তারাশঙ্কর তখন একেবারেই গ্রাম্যলোকের মতোই বলে উঠেছিলেন, ‘না না। স্বর্ণডাইনি যে আমাদের পাড়ায় থাকে। এখনও আছে। আমাদেরই কাছারি বাড়ির সামনের পুকুরের ঈশানকোণে তার বাড়ি।… আর– আমি তো ইংরিজিও ভালো জানি না। যেটুকুও জানি তার উপযুক্ত পড়বার বইও পাইনা আমার দেশে। কোথায় পাব? ওদের দেশের গল্প আমি তো বেশি পড়িনি।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: অনুপ ঘোষালের কথা সত্যজিৎ রায়কে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বিজয়া রায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ স্নেহের হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘আমি জানি, আমি বুঝতে পারি। তোমাকে আমি বুঝেছি। ও কথাটা তোমাকে বললাম কেন জান? বললাম আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের দেশের সঙ্গে পরিচয় কত সংকীর্ণ তাই বোঝাবার জন্য। ডাইনি মানে ওঁদের কাছে উইচক্র্যাফ্ট হলেই সে ইয়োরোপ ছাড়া এ-দেশে কী করে হবে। আমাদের দেশের ডাইনি এঁরা দেখেননি, জানেন না, বিশ্বাস করেন না। আমি তাই তাঁদের বললুম; উঁহু উঁহু! এ তারাশঙ্করের চোখে দেখা। আমি যে নিজে দেখতে পাচ্ছি গ্রীষ্মকালের দুপুরে তালগাছের মাথায় বসে চিলটা লম্বা ডাক ডাকচে, গলাটা তার ধুক ধুক করছে; আর নিজের ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে স্বর্ণডাইনি বসে আছে আচ্ছন্নের মত।’
শান্তিনিকেতনের এক কোণে বাসা বাঁধা হয়নি তারাশঙ্করের, কিন্তু দেখার দৃষ্টির সততায় দুই আলাদা গল্পগুচ্ছের দুই স্রষ্টা দু’জনের মনেই পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিলেন।