আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘‘Tagore’s Quest’’ বইয়ের মধ্যে লিখেছেন, ‘Leaving woman and nature we arrive at the Third caravanserai on the road to God. This is poetry it self’। এই জন্যই কি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাগুলিকে বারবার স্পর্শ করে দেখতেন? কবিতা এবং গানে, এমনকী নাটকেও, সেজন্য বারবার শব্দ বা ছত্র পাল্টাতে পাল্টাতে এগাতেন তিনি। কেননা সংশয়, কেননা অতৃপ্তি। কবি আর সাধকের এই অত্যাশ্চর্য সমন্বয় বিশ্বসাহিত্যে খুব বেশি লক্ষ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের রচনার, বিশেষত তাঁর গান এবং কবিতার সংকলন-সম্পাদনার ক্ষেত্রে সেজন্য খুবই সতর্কতা প্রয়োজন। তার সঙ্গে বারংবার মিলিয়ে দেখতে হবে রবীন্দ্রনাথের রচনাধারাকেও। শঙ্খ ঘোষ তাঁর সম্পাদনায় এ বিষয়ে বিভিন্ন টীকাভাষ্যে সমস্যাটিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
৫.
উত্তরমেঘ
১.
তিতাস সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছে, শঙ্খ ঘোষের সম্পাদনা বিষয়ে যদি আবার কথা বলতে হয়, তাহলে সেটা শুরু করার সেরা সময় রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ। কথাটায় একটা যুক্তি আছে। মেনে নিতে হল এ প্রস্তাব। ফলে, ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’ বলে সত্যিই মুখোমুখি হতে হল পাঠকের। এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে’ গানটি আবহে বেজে উঠুক। তবেই তো ‘…আবার যাত্রা করি’ পঙ্ক্তিটি মূল্যবান হয়ে উঠবে। আর চাই একটি কবিতা। এবার জীবনানন্দ দাশ। ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়’। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের ১৬ সংখ্যক সনেট। এই যে রবি ঠাকুর আর জীবনানন্দের যুগলবন্দি দিয়ে শুরু করার স্পর্ধা দেখালাম, তার অন্তর্লীন একটা কারণও আছে। এবারে যে চারটি পর্ব নিয়ে লিখব সম্পাদনা এবং শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে, তার সিংহভাগ জুড়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দ। রবীন্দ্ররচনাবলি ষোড়শ খণ্ড গ্রন্থ পরিচয় এবং তার আগেই প্রকাশিত রবীন্দ্র কবিতার সংকলন ‘সূর্যাবর্ত’ থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় উঠে আসবে। অন্যান্য কয়েকটি বইয়ের প্রসঙ্গ ছুঁয়ে আমরা ঢুকে পড়ব শঙ্খ ঘোষের সম্পাদনার আর এক অভিমুখের দিকে। সেটি হল ‘এই সময় ও জীবনানন্দ’ গ্রন্থটি। সম্পাদনা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য অকাডেমি থেকে।
‘গ্রন্থনা’ শব্দটির দিকে আমরা ইদানীং, মনে হচ্ছে, খুব বেশি তাকাই না। গ্রন্থনা শব্দের একটি অর্থ হল, সংকলন, সম্পাদনা এবং বিন্যস্ত করার একত্রিত প্রয়াস। যে কোনও গ্রন্থের একটি বাহ্যিক এবং একটি অভ্যন্তরীণ রূপ আছে। গ্রন্থনার তত্ত্বাবধানে যিনি থাকেন, তাঁকে এই দু’টি দিককেই সমান যত্নে এবং মনোযোগে নির্মাণ করে চলতে হয়। বইয়ের সাইজ, প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বইয়ের শিরোনামের হরফ, মূল লেখার হরফ– এই সাইজ এবং রীতি (স্টাইল) যেমন তাঁকে ঠিক করতে করতে এগোতে হয়, আবার অন্যদিকে বইয়ে কোন লেখার পরে কোন লেখা আসবে– সেটিও ঠিক করতে হয়। সেই বিন্যাসের প্রধান অভিমুখ কী থাকবে, কোনও ভাবমূল বা থিম, নাকি কালানুক্রমে নানা মেজাজের লেখা সাজিয়ে দেওয়া হবে, এসবই হল সম্পাদক বা গ্রন্থনা প্রধানের সিদ্ধান্ত। দায়সারা, অমনোযোগী, বিভ্রান্ত সম্পাদকের হাতে পড়লে বহু মূল্যবান, জ্ঞানগর্ভ, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কী দশা হয়, সে আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতায় আছে। কলেজ স্ট্রিটে, একসময় দেখেছি, খুব উঁচুদরের গ্রন্থচর্চাকারীদের। সে প্রায় বিশ-পঁচিশ বছর কি তারও আগের কথা। হয়তো এখনও তাঁদের উত্তরসূরিরা আছেন, আমার এখন অহরহ কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হয় না বলে দেখা হয় না। কী ছিল তাদের বিশেষত্ব? তাঁরা বিশেষ সম্পাদক বা বিশেষ সংস্করণ তন্নতন্ন করে খুঁজতেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রসন্ন হলে বুঝিয়ে দিতেন কোন কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য ওই বিশেষ সম্পাদিত সংস্করণটিই তিনি খুঁজছেন। কখনও কখনও তাঁদের সঙ্গে বইপাড়া তোলপাড় করতে করতে বুঝেছি সম্পাদনার মর্ম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শুধু কবিতাই বা কেন, গদ্যগ্রন্থ এবং নাট্যগ্রন্থের সম্পর্কে নানা মাত্রায় নতুন নতুন গবেষণার পথ খুলে দিয়েছেন সম্পাদক। কখনও কখনও তথ্য সারণীর মাধ্যমে তিনি প্রথম স্তরের অনুপুঙ্খ জোগানও দিয়ে দিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ বিষয়ক টীকায় তিনি সযত্নে একত্রিত করে দিয়েছন, এই উপন্যাসে নিবারণ চক্রবর্তী কর্তৃক উদ্ধৃতি ইংরেজি কবিতাংশগুলির উৎস। এই উৎস কাব্যগুলির দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের পাঠবিস্তার সম্পর্কে যেমন ধারণা হবে, তেমন তাঁর কবিনির্বাচনের নিজস্বতাও পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
২.
রবীন্দ্ররচনার রসজ্ঞ মননঋদ্ধ পাঠক আবু সয়ীদ আইয়ুব তাঁর ‘‘Tagore’s Quest’’ বইয়ের মধ্যে লিখেছেন, ‘Leaving woman and nature we arrive at the Third caravanserai on the road to God. This is poetry itself’ কথাটি নিয়ে ভাবতে বসি। এই জন্যই কি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাগুলিকে বারবার স্পর্শ করে দেখতেন? তাঁর কবিতা এবং গানের এত যে পাঠান্তর, তার একটা কারণ কি ছিল অমর্ত্যবিভার সন্ধানে ব্যবহৃত শব্দ বিষয়ে অনিশ্চয়তা? কবিতা এবং গানে, এমনকী, নাটকেও, সেজন্য বারবার শব্দ বা ছত্র পাল্টাতে পাল্টাতে এগোতেন তিনি। কেননা সংশয়, কেননা অতৃপ্তি। কবি আর সাধকের এই অত্যাশ্চর্য সমন্বয় বিশ্বসাহিত্যে খুব বেশি লক্ষ করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের রচনার, বিশেষত তাঁর গান এবং কবিতার সংকলন-সম্পাদনার ক্ষেত্রে সেজন্য খুবই সতর্কতা প্রয়োজন। তার সঙ্গে বারবার মিলিয়ে দেখতে হবে রবীন্দ্রনাথের রচনাধারাকেও। শঙ্খ ঘোষ তাঁর সম্পাদনায় এ বিষয়ে বিভিন্ন টীকাভাষ্যে সমস্যাটিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এইসব ছোট ছোট তথ্য পাঠকমহলে আদৌ পরিচিত নয়। সাধারণ পাঠকের হয়তো এইসব তথ্য বা পাঠান্তর খুব প্রয়োজনীয়ও নয়। তবে রবীন্দ্রসম্পাদনার কাজে যেসব তরুণ উৎসাহী হবেন, তাঁদের বিষয়গুলি নজরে রাখা প্রয়োজন।
‘সূর্যাবর্ত’ প্রকাশিত হয়েছিল, আগেই বলেছি, ১৯৮৯ সালে। এই বইয়ের ভূমিকা বা সূচনা থেকে পাঠপ্রসঙ্গ– প্রতিটি পর্বই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে প্রথমে ‘পাঠপ্রসঙ্গ’ অংশটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব। সংকলিত কবিতা বিষয়ে সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ এই পর্বে মূল্যবান ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন। যেমন ধরা যাক, বিখ্যাত কবিতা ‘ভারততীর্থ’ প্রসঙ্গে–
‘‘এই কবিতার দুটি শব্দ নিয়ে মুদ্রণ সমস্যা আছে।
১. পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার (পাণ্ডুলিপি, বিশ্বভারতী রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রচনাবলী)
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার। (চয়নিকা, ইন্ডিয়ান প্রেসের কাব্যগ্রন্থ, সঞ্চয়িতা)
২. যজ্ঞশালায় খোলা আজি দ্বার (পাণ্ডুলিপি, চয়নিকা, ইন্ডিয়ান প্রেসের কাব্যগ্রন্থ, বিশ্বভারতী রচনাবলী, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রচনাবলী)
যজ্ঞশালার খোলা আজি দ্বার (সঞ্চয়িতা)
এই সংগ্রহে গৃহীত হল ‘পশ্চিম’ এবং ‘যজ্ঞশালায়’।’’
এই ভাষ্যটি থেকে বোঝা যায়, একটি মুদ্রিত কবিতার কত ধরনের পাঠান্তর রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। অন্যদিকে, সম্পাদককে কোনও একটি বিকল্প বেছে নেওয়ার যুক্তি তৈরি করতে হয়। শঙ্খ ঘোষ এক্ষেত্রে শেষ বাক্যে তাঁর সিদ্ধান্তটুকু জানিয়েছেন। অনুমান করি, তিনি বেছে নিয়েছেন সেই শব্দগুলি, যার স্পষ্ট পাণ্ডুলিপি আছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিও শিক্ষণীয়। কখনও কখনও, এই টীকাভাষ্য আমাদের কৌতুককর কয়েকটি পরিস্থিতির দিকেও নজর আকর্ষণ করে। যেমন ধরা যাক, ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটির কথা। ১৯৩১ সালে লেখা কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথেরই ‘The Child’ নামের ইংরেজি কবিতারই বাংলা তরজমা। এসব তথ্য সকলেরই জানা। শঙ্খ ঘোষের সূত্রে আমি, এবং অনুমান করি, আরও বেশ কিছু পাঠক নতুন তথ্য জানতে পারলাম। আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনটি হাতে পাওয়ার পর, ১৯৪০ সালে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুকে একটু হতাশ স্বরে বলেছিলেন– ‘‘সংকলনকর্তার কাছে আমার একটি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করবার আছে। দীর্ঘকাল হল (যদ্দৃষ্টং) শিশুতীর্থ ব’লে একটি গদ্যছন্দের রচনা বানিয়েছিলেম। আজ পর্যন্ত সেটা কারো যে চোখে পড়েছে তার কোনো প্রমাণ পাই নি। তোমরা যে সেই কক্ষচ্যুত পথহারাকে অখ্যাতি থেকে উদ্ধার করেছো এতে খুশি হয়েছি।’’ চিঠির উদ্ধৃতি এখানেই শেষ। বস্তুত, টীকা হিসেবে এই তথ্য খুবই চমকপ্রদ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটি কোনও মান্য সংকলনে সাধারণত দেখা যায় না। সম্পাদক অবশ্য নতুন একটি অনুচ্ছেদ শেষে যোগ করেছেন। সেটিও যথেষ্ট নাড়া দেওয়ার মতো এবং কৌতুকপূর্ণ। ‘‘এই সঙ্গে মনে রাখা ভালো যে, এই চিঠিটি লিখবার আগে সঞ্চয়িতার তিনটি সংস্করণ মুদ্রিত হয়ে গেছে, তার অনেক গ্রহণ বর্জনের ইতিহাসে ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটিকে কবি নিজেও কিন্তু কখনো গণ্য করেন নি।’’ শান্ত একটি বাক্য। কিন্তু কী অব্যর্থ! শঙ্খ ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন যে ‘শিশুতীর্থ’ কবিতাটি প্রসঙ্গে উদাসীনতা রবীন্দ্রনাথের নিজেরও ছিল। যে অভিযোগ তিনি অন্যান্য সংকলকের বিরুদ্ধে তুলেছেন, সেই অভিযোগে তিনি নিজেও সমান দোষী। বুদ্ধদেব বসুকে চিঠি লেখার সময় হয়তো এই তথ্যটি রবীন্দ্রনাথ বিস্মৃত হয়েছিলেন। সম্পাদক শঙ্খ ঘোষ এখানে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের চিঠির প্রসঙ্গ উল্লেখ করলেন। তারপর রবীন্দ্রনাথের আত্মবিস্মরণ প্রসঙ্গটি এনে দিলেন পাঠকের দরবারে। রবীন্দ্রনাথের সংকলিত, সম্পাদিত গ্রন্থে শিশুতীর্থের অনুপস্থিতির অনুষঙ্গ টেনে আনাটাই তুলনামূলক বিচারের চমৎকার প্রয়োগ।
৩.
শুধু কবিতাই বা কেন, গদ্যগ্রন্থ এবং নাট্যগ্রন্থের সম্পর্কে নানা মাত্রায় নতুন নতুন গবেষণার পথ খুলে দিয়েছেন সম্পাদক। কখনও কখনও তথ্য সারণীর মাধ্যমে তিনি প্রথম স্তরের অনুপুঙ্খ জোগানও দিয়ে দিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ বিষয়ক টীকায় তিনি সযত্নে একত্রিত করে দিয়েছেন, এই উপন্যাসে নিবারণ চক্রবর্তী কর্তৃক উদ্ধৃত ইংরেজি কবিতাংশগুলির উৎস। এই উৎস কাব্যগুলির দিকে তাকালে রবীন্দ্রনাথের পাঠবিস্তার সম্পর্কে যেমন ধারণা হবে, তেমন তাঁর কবিনির্বাচনের নিজস্বতাও পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
এই তালিকায় যেমন আছেন জন ডান (১৫৭২-১৬৩১), আবার ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-’৯২), আবার জন কীটস্ (১৭৯৫-১৮২১) প্রমুখ অগ্রগণ্য কবি মনীষীবৃন্দ। এখন, বলা চলে, প্রায় চারশো-পাঁচশো বছর ব্যেপে নিবারণ চক্রবর্তী ওরফে অমিত রায়ের পাঠ উদ্ধৃতি। এই চরিত্র দু’টির নির্মাতা রবীন্দ্রনাথ, কী সচেতনভাবে, অনুষঙ্গের আড়ালে তাঁর কাব্য পাঠের রুচির রূপরেখা অনুপ্রবিষ্ট রেখেছেন।
এর পাশাপাশি, বিশেষভাবে লক্ষ করতে বলব ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পটির প্রত্যুত্তরে লেখা বিপিনচন্দ্র পালের গল্প ‘মৃণালের কথা’। শঙ্খ ঘোষ সুকৌশলে গল্পটিকে ষোড়শ খণ্ডের সংযোজন অংশে যুক্ত করে দিয়েছেন। এই গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল নারায়ণ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (অগ্রহায়ণ ১৩২১)। নারীকণ্ঠের ব্যক্তিত্বদীপ্তি যে-গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছড়ানো আছে, সেই ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পটি সে যুগের বাঙালি বিদ্বজ্জনদের রক্ষণশীলতায় বেশ বড়সড় ধাক্কা দিয়েছিল। ফলে এই আক্রমণাত্মক গল্পটি সেই পক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে লিখেছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল। গল্পের কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করি– ‘আমার সন্দেহ হয়, এ চিঠিটা সত্যি সত্যি মেজবউ-এর লেখা কিনা। তার যে ভাইটার কথা লিখেছে, তাকে ত তুমি বেশ জান। শুন্ছি সে নাকি একজন ভারি লিখিয়ে হয়ে উঠ্ছে। শুঁড়ওয়ালা নাগ্রা জুতা পায় দেয়, চুড়িদার জামা পরে, আর কবিদের মতন বাব্রী চুল রেখেছে। শুনেছি রবি ঠাকুরের সঙ্গেও নাকি খুবই জানাশুনা আছে।… লেখার খুব বাহাদুরি আছে, উনি পড়ে বল্লেন যে ঠিক যেন রবি ঠাকুরেরই মতন।… আমাদেরো পড়ে তাই মনে হয়েছিল। হিন্দুঘরের মেয়ে, যতই জ্যাঠা হোক না কেন, অমন চিঠি লিখতে পারে না।’ আজ এত দীর্ঘ সময়ের পরেও, এই পঙ্ক্তিসমূহ পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের তৎকালীন সম্মানহানির আন্দাজ করতে পারি। কত বিষ তিনি অস্ত্রক্ষতে ধারণ করেছেন সে-কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
এখানে সম্পাদক শঙ্খ ঘোষের কৃতিত্ব কোথায়? তিনি এই দুষ্প্রাপ্য রচনাটিকে সংরক্ষণ করলেন। বিপিনচন্দ্র পালের এই গল্পটি প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন সাহিত্য সমাজের প্রতিগ্রহণ এবং প্রতিক্রিয়ার একটি সূত্র। অন্যদিকে, এ ধরনের রবীন্দ্রবিরোধিতার নানা চিহ্ন যে সযত্নে সংকলন করা প্রয়োজন, সাহিত্যের ইতিহাস আর সমাজবীক্ষার কারণে, সেই প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি। সে সময় এই গল্পটি পড়ে উত্তেজিত হয়ে আমি ‘স্ত্রীর পত্র’ বিষয়ক নানা প্রতিক্রিয়ার সন্ধান করতে থাকি। এভাবেই হাতে আসে ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘ভর্ত্তার উত্তর’। প্রকাশিত হয়েছিল ‘শাশ্বতী’ পত্রিকার অগ্রহায়ণ ১৩২১ সংখ্যায়। এখানেও রবীন্দ্রনাথের প্রতি ধারালো সব শ্লেষ বর্ষিত হয়েছে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ কৌশলে। গল্পের শিরোনামের ওপর লেখা ছিল– ‘Plato is my Friend, but truth is more my friend.’
(চলবে)
…পড়ুন ভাষ্য শব্দের তর্জনী-র অন্যান্য লেখা…
পর্ব ১. কত কম বলতে হবে, মুখের কথায়, সভায়, কবিতায় কিংবা ক্রোধে– সে এক সম্পাদনারই ভাষ্য
পর্ব ২. তথ্যমূলক তথাকথিত নীরস কাজে শঙ্খ ঘোষের ফুর্তির অন্ত ছিল না
প:ব ৩. কোনও সংকলনই গ্রন্থনার পূর্ণচ্ছেদ হতে পারে না, ভাবতেন শঙ্খ ঘোষ
পর্ব ৪. শঙ্খ ঘোষ বলতেন, অদৃশ্যে কেউ একজন আছেন, যিনি লক্ষ রাখেন এবং মূল্যায়ন করেন প্রতিটি কাজের