‘বইমেলাধুলো’র আজ শেষ পর্ব। শঙ্খ ঘোষের সেই বহু বিখ্যাত লাইন খানিক বদলে, বলা যায়: স্টল কি তোমার কোনও ব্যথা বোঝে? রোববার.ইন-এর পাঠকেরা একথা নিশ্চয়ই বুঝবেন। আজকের লেখা, পুরনো বইমেলার রোগা ও শক্তিশালী দৈনিক বুলেটিনকে কেন্দ্র করে, যার নাম: প্রতিক্ষণিকা। সেই বিস্ময় দৈনিক বুলেটিনের আজকের তারিখেও কোনও সংকলন নেই, গ্রন্থভুক্ত হয়নি এখনও। এ লেখা পড়ে পাঠকেরা যদি প্রতিক্ষণের বর্তমান কর্মাধ্যক্ষকে জ্বালিয়ে মারেন, তা প্রকাশের জন্য– তাহলে এ লেখা সফল। সফল রোববার.ইন-এর এক স্বপ্ন-কৌশল।
প্রতিক্ষণিকা-র লোগো: পূর্ণেন্দু পত্রী
বইমেলায় যাচ্ছি তো আজ থেকে নয়, সেই যখন বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টোদিকে মেলা বসত, সেই তখন থেকেই এই শর্মার সেখানে যাতায়াত। স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র তখন। পকেট স্বভাবতই ঢুঁ ঢুঁ। বইমেলার আগে কয়েক দিন ভালো মানুষের মতো থেকে এর-ওর থেকে চেয়েচিন্তে যদি টাকা ৫০ জোগাড় করা যেত, তবে তা-ই অনেক। কলেজে পড়ার সময় থেকে একটা-দু’টি খুচরো ছাত্র পড়িয়ে এবং সেই বয়সের উপযোগী হাতখরচ মিটিয়ে বৎসরান্তে হয়তো শ’-দুয়েক টাকা জমল। বয়স কম, কাঠবেকার জীবন, মাথাভর্তি উসকোখুসকো চুল, মনে অদম্য ফুর্তি– মানে সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি বছর যেমন হওয়ার কথা, তেমনই আর কী! শিশু-কিশোর সাহিত্যের অভিভাবক-নির্ধারিত গণ্ডি ছাড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তর, তখনও অতি উজ্জ্বল জগৎ, চোখের সামনে ঝলমল করছে। পরে অবশ্য সব সমর্পণ করে আবার সেই কিশোর সাহিত্যেই ফিরে এসেছি, কিন্তু সে অন্য গল্প। মনে আছে, একবার, কেবলমাত্র বাসভাড়াটুকু বাঁচিয়ে রেখে বাকি সব পয়সার বই কিনে পকেটে আর কানাকড়িও নেই, খালি পেটে হাওড়া স্টেশনে নেমে, বাসের ভিড় আর পেট্রোলের গন্ধেই সম্ভবত হুড়হুড় করে বমি, শরীর কাহিল!
তা সে যাক, আমার মতো সে সময়ের অনেক ছেলে-ছোকরারই এমন বা সামান্য ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে, ইতিমধ্যে আটের দশকের মাঝামাঝি এসে গেছে, বইমেলাও তার আদি অবস্থান থেকে সরে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে স্থিত হয়েছে। সেখানেই সে এরপর অনেক দিন থাকবে, পূর্ণেন্দু পত্রীর কাছ থেকে তাঁর আঁকা পোস্টার কেনার সুযোগ হয়েছে, বিষ্ণু দে’র ‘জল দাও’ কবিতার শেষ ক’টি ছত্র দিয়ে তৈরি সেই অসাধারণ সাদা-কালো ছবিটি ইতিমধ্যে কোথায় যেন অবলুপ্ত। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মিনিবুক– কমলকুমার মজুমদারের চিঠি আর সন্দীপনের নিজের ‘এখন আমার কোন চশমা নেই’– পাওয়া গিয়েছে বইমেলাতেই। পরে সন্দীপন সম্পাদিত মিনিবুকগুলি ফের ছাপা হয় একসঙ্গে– কিন্তু ‘এখন আমার কোন চশমা নেই’ আর বোধহয় মুদ্রিত হয়নি!
বইমেলাতেই একবার, সালটা আর মনে নেই, তবে যেবার মেলার মাঠে আগুন লেগে গেল তার আগেই, ‘সুবর্ণরেখা’র বাইরে মস্ত মস্ত তিন বান্ডিল পত্রপত্রিকা ডাঁই করে রাখা ছিল। বইগুলি একদা যাঁর সম্পত্তি ছিল, তিনি ছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত, সেই স্তূপীকৃত বইয়ের মধ্যে ছিল অজস্র ‘কবিতা’ পত্রিকা আর বেশ কিছু পুরনো ‘পরিচয়’। ‘কবিতা’ পত্রিকা সেই আমার প্রথম হাতে নিয়ে দেখা– প্রাথমিক মুগ্ধতা কাটিয়ে বেশ কয়েকটি বেছে নেওয়া গেল যার মধ্যে ছিল সুখ্যাত দ্বিভাষিক সংখ্যাটি। সেই সঙ্গে ছিল ‘কলকাতা’ পত্রিকার দ্বিতীয় বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা। পীতবর্ণের প্রচ্ছদের ওপর বুদ্ধদেব বসুর নিজর হাতের লেখা ব্লক করে ছাপা। বুদ্ধদেব বসুর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত সেই সংখ্যায় কয়েকটি অতিশয় সুখপাঠ্য স্মৃতিচারণ ছিল– বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থ তালিকার শেষার্ধটুকু সমেত। এর প্রথমার্দ্ধ (স্বপন মজুমদারকৃত) প্রকাশিত হয়েছিল ‘কলকাতা’ পত্রিকার প্রথম বুদ্ধদেব বসু সংখ্যায়, যা ঘটনাচক্রে হস্তগত হয় বেশ কয়েক বছর পরে। তবে ওই সংগ্রহের মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল দিলীপকুমার গুপ্ত আর অমরেন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘সারস্বত’ (পরবর্তীকালে ‘সারস্বত প্রকাশ’) পত্রিকার প্রায় সবক’টি সংখ্যা, যার মুদ্রণ সৌকর্য প্রথম দেখাতেই আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল! মাত্র কয়েকটি সংখ্যা বেরনোর পর এই চমৎকার পত্রিকাটি স্বল্প ঘোষণা সমেত অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়।
বইমেলা নিয়ে এরকম টুকরো-টাকরা সুখস্মৃতি প্রত্যেকেরই আছে। ইদানীং, পুরনো বইয়ের সরবরাহ নানা কারণে একটু অন্যরকম হয়ে গেছে, বিশেষ করে পত্র-পত্রিকার ক্ষেত্রে, তা আমার মতো অনেকেই অবগত আছেন। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। বস্তুত, সেটাই এই লেখার মূল প্রসঙ্গ। একদা কলেজ স্ট্রিটেরই এক পুরনো বইয়ের দোকান থেকে পাওয়া গিয়েছিল ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা বিষয়ক অন্তত ২০টি রসসিক্ত বই। সেগুলির মালিক জনৈক তৎকালীন রসিক পাঠক সবক’টি পুস্তিকা একসঙ্গে বাঁধিয়ে নিয়ে রেখেছিলেন নিজের কাছে। তারপরে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, বই স্বাভাবিক নিয়মেই পুরনো বইয়ের বাজার ঘুরে আরেকজনের হস্তগত হয়েছে। আক্ষেপ হয় আজ হাজার মাথা খুঁড়লেও ১৯৮৬-’৮৯, এই চার বছরে সম্ভবত, ‘প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন’ বইমেলার প্রত্যেক দিনে ‘প্রতিক্ষণিকা’ পুস্তিকাটি প্রকাশ করতেন, অতিশয় সুমুদ্রিত এবং সুলিখিত সেই কাগজের একটি কপিও আর দেখার যো নেই। উক্ত ভাওয়াল-বিষয়ক পুস্তিকাগুলির মতো কোনও আগ্রহী ব্যক্তি যদি সেই চার বছরের সম্ভাব্য ৪০টি সংখ্যাকে একত্রে বাঁধিয়ে রাখতেন, তাহলে সাড়ে তিন দশক আগের বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতির একটা অবিকল প্রতিরূপ সেখান থেকে পাওয়া সম্ভব হত। আমার কাছে সেই সর্বাধিক ৪০টি সংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৬টি আছে– মফসসল শহর থেকে প্রতিদিন বইমেলা যাওয়া অসম্ভব ছিল বলে, কিন্তু সেগুলিকেই মাঝেমধ্যে দেখে নির্মল আনন্দ অনুভব করি। ‘সিগনেট প্রেস’ প্রকাশিত ‘টুকরো কথা’কে স্বাভাভিকভাবেই এখনও আমরা স্মৃতিধার্য করে রেখেছি। আমাদের সৌভাগ্য, পরে একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় সেগুলির সব পুনরায় মুদ্রিত হয়েছে। ‘প্রতিক্ষণিকা’ আকারে এবং চরিত্রে টুকরো কথারই সমতুল। পুস্তিকা নয়, আসলে একটি গোটা কাগজকেই চারভাঁজ করে ছাপা হত এগুলি। প্রথম বছর (১৯৮৬) প্রতিদিন থাকত একাধিক বই-বিষয়ক স্বাভাবিকভাবেই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ এবং সাহিত্য বিষয়ে ধাঁধা (আসলে প্রশ্নোত্তরের আসর), প্রথম নির্ভুল উত্তরদাতার নাম ‘প্রতিক্ষণিকা’য় ছাপা হবে এবং তাঁকে ‘প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস’-এর একটি বই উপহার দেওয়া হবে এমন একটি প্রতিশ্রুতি-সহ। বইমেলার একটি ধারাবিবরণী থাকত। ৩০ জানুয়ারি সংখ্যায় জানা যাচ্ছে যে, প্রকাশকরা সে বছর নিজেদের প্রকাশিত বই ছাড়া আর কোনও বই বিক্রি করতে পারবেন না। ইন্দ্রনাথ মজুমদারের ‘সঙ্গত উষ্মা: আপনি ১৯৪২ সালের আগে প্রকাশিত কোন পুরনো বই বিক্রি করতে পারবেন না। কি অদ্ভুত ব্যপার ভাবুন। আমার স্টলে বেশিরভাগ ভিড়ই তো পুরনো দুষ্প্রাপ্য, পত্র-পত্রিকার জন্য…’। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ ‘তুফান মেলের হেডলাইট’ সুব্রত চৌধুরীর ছবি-সমেত প্রকাশিত হচ্ছে ৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৬ সংখ্যায়, সন্দীপন তাঁর অনণুকরণীয় গদ্যে জানাচ্ছেন ম্যাসাঞ্জারের বাংলোয় বসে ‘আউটসাইডার’ পড়ার অভিজ্ঞতা। আর তার পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ ফেব্রুয়ারি তারাপদ রায়ের ‘একটি অপমৃত্যুর স্মৃতি’ তখনই লোকান্তরিত ‘কয়েকজন’ পত্রিকা বিষয়ক একটি স্মৃতিলিখন (‘কয়েকজন’ পরে দ্বিতীয় পর্যায় প্রকাশিত হয়, কিন্তু সে কথা অন্য!) লেখাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে…
‘মাননীয়াসু,
আর লোক পেলেন না? সুচিন্তিত আলোচনা লিখতে বললেন আমাকে? আমি কোনওদিন ঠিকমতো চিন্তাই করিনি, তা আবার সুচিন্তা। আমার এই অভাবনীয় অথবা কবির ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘চিত্ত ভাবনাহীন’ জীবনে কাউকে (এমনকি নিজেকেও) চিন্তান্বিত করতে পারি এমন কাজ কদাচিৎ করেছি।…’
এরপর ‘কয়েকজন সম্বন্ধে নানা কথা’।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, ‘কয়েকজন’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি (বৈশাখ-আষাঢ়, ১৩৭৫, জুলাই, ১৯৬৮) কাকতালীয়ভাবে, খুব অপ্রত্যাশিত একটি জায়গা থেকে, এই লেখা পড়ার পরে পাওয়া গিয়েছিল। আজ থেকে সাড়ে পাঁচ-দশক আগে প্রকাশিত এই ৯২ পৃষ্ঠার কৃশকায় পত্রিকার জীর্ণ সংখ্যাটির মধ্যে ঠাসা আছে, যাকে বলে, উদ্ভট সব আইডিয়া এবং তার বেশিরভাগই লেখা হয়েছে আশ্চর্য মসৃণ এবং সুখপাঠ্য গদ্যে। নবনীতা সেন, বেলাল চৌধুরী, আলোক সরকার, দিব্যেন্দু পালিত, জ্যোতির্ময় দত্ত বা সুব্রত চক্রবর্তীর কয়েকটি কবিতাও আছে, সেইসঙ্গে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর কাব্যনাটক (‘সংলাপিকা’), তৎসহ বেশ কয়েকটি গল্প– কিন্তু স্মৃতিচারণ, রম্যরচনা, গ্রন্থসমালোচনা, ব্যক্তিগত গদ্যগুলিই এই সংখ্যাটিকে, যাকে বলে ‘জমিয়ে দিয়েছে’! এই প্রথম কোনও পত্রিকা দেখা গেল যাতে কোনও ভূমিকা নেই, এমনকী, সূচিপত্রও নেই। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রচ্ছদ জুড়ে লেখকদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকাতেও একদা যেমন দেখা গেছে, এবং চতুর্থ প্রচ্ছদের একেবারে শেষে ঘোষণা–
‘কয়েকজন, ২২/১ সি মহিম হালদার স্ট্রিটে, কলকাতা-২৬ থেকে প্রকাশ করেছেন মিনতি রায়… আপাতত দেখাশোনা করছেন তারাপদ রায়।’ দু’-একটি লেখার ছোট উদ্ধৃতি এখানে না দিলেই নয়! প্রথম লেখাটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। দু’বছর আগে তাঁর ‘আত্মপ্রকাশ’ বেরিয়ে গেছে, সুনীল দ্রুত জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি হয়ে উঠছেন। ‘কৃত্তিবাসের প্রথম দিক’ সম্ভবত, এই পত্রিকা বিষয়ক তাঁর অগণন স্মৃতিচারণার প্রথম লেখা। নানা জায়গাতেই তিনি লিখেছেন একদা ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং কোলরিজের অনুকরণে তিনি এবং দীপক মজুমদার একটি কবিতার বই প্রকাশ করতে চান, কিন্তু নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলি তিনি হয়তো এভাবে আর কোথাওই বলেননি–
‘‘… দু’জনে চলে গেলুম সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। দীপক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব খবর রাখে– সত্যজিৎ রায়ের ডাকনাম যে মানিক তাও তার জানা, প্রথমেই সে মানিকদা বলে সম্বোধন করে ফেললো, আমি একটু বেশি লাজুক– আমি এলেবেলের মতো এক পাশে চুপ মেরে দাঁড়িয়ে রইলুম। আমাদের প্রস্তাব শুনে সত্যজিৎ রায় অপ্রস্তুতভাবে গলা খাঁকারি ছিলেন, চেয়ারে বসে স্বস্তি না পেয়ে খাটে আধ শোয়া হলেন। কিন্তু ছেলেমানুষের প্রগলভ আবদার শুনেও অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন না, দু’একটা কবিতা শুনলেন পর্যন্ত….’ ইত্যাদি।
এরপর সেই ডি. কে প্রসঙ্গ। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব ধরনে একটি গদ্য লিখেছেন; গল্প নয়, শুধুই বিবরণ, কিন্তু উজ্জ্বল এবং মেধাবী। বিমল রায়চৌধুরী কবিতা সিংহের প্রথম কবিতার বই ‘সহজ সুন্দরী’র সমালোচনা লিখেছেন। সম্পাদকের মতে, ‘অসম্ভব আলোচনা’, এবং ‘অসম্ভব’ শব্দটি অতিশয় সুপ্রযুক্ত– বিমল রায়চৌধুরী নির্ভীকভাবে জানাচ্ছেন, ‘শুধু প্রকাশক বলেই না, কবিতা সিংহের প্রথম কাব্যগ্রন্থটির সমালোচক হবার অধিকার আমার আরেক কারণও আছে। ঘটনাচক্রে কবিতা সিংহ আমার স্ত্রী, এবং স্ত্রীকে হাড়ে হাড়ে (এখানে আরও দু’-একটি শরীরি উপমা দেবার ইচ্ছে ছিল) একমাত্র স্বামীরাই চিনতে সক্ষম,…’
আবার পড়ুন, ‘সহজ সুন্দরীর প্রথম কবিতা ‘না’ প্রথম পড়ে মনে আছে আমার চক্ষুস্থির হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। কারণ এই কবিতায় কবি স্পষ্টই জানাচ্ছেন:
‘‘অন্ধকার আছে বলে, হতে পারি চমৎকার দুই/ প্রতিমার মতো এই নীল মুখ তুমি দেখবে না/তোমার বাঁ পাশে তাই নিশ্চিত পুতুল হেন শুই/যন্ত্রণা আমাকে কাটে যেমন পুঁথিকে কাটে উই।’
স্বামীর বাঁ পাশে শুয়ে স্ত্রী নিজেকে কীটদষ্ট ভাবতে থাকেন এবং সেই সর্বনেশে সংবাদ সদম্ভে ঘোষণা করেন তাহলে স্বামীর মনের কী অবস্থা হতে পারে, সহজেই অনুমেয়!’’
এই সংখ্যার উদ্ভটতম লেখাটি হিমানীশ গোস্বামীর গল্প ‘সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত খুন হলেন না’– যা শুরু হচ্ছে খবরের কাগজের শিরোনাম দিয়ে, ‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে পুনরায় হত্যার চেষ্টা।’ এই গল্পের বিবরণ দেওয়া বর্তমান লেখকের পক্ষে অসম্ভব বিধায় পরিত্যক্ত হল।
কথায় কথায় আবার প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম। আপাতত, এই ব্যক্তিগত খেদটুকু দিয়ে ‘কয়েকজন’ প্রসঙ্গ শেষ করা যাক– ‘কয়েকজন’ প্রথম পর্যায়ের কেবলমাত্র দু’টি সংখ্যা বহু বছরের ব্যবধানে পাওয়া গেছে, সুতরাং যাঁরা এই পত্রিকার আরও কিছু সংখ্যা পেয়েছেন/পড়েছেন/দেখেছেন– তাঁরা আমার ঈর্ষার পাত্র। সেই সঙ্গে আরেকটি বিলাপোক্তি– বিমল রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘দৈনিক কবিতা’র বহুকথিত সুকুমার রায় বা বুদ্ধদেব বসু সংখ্যা দু’টি এখনও দেখার সুযোগ পাইনি। এই চমৎকার গদ্যকারের কোনও বই-ই অধুনা প্রাপ্তব্য কি না, তাও জানা নেই!
প্রতিক্ষণিকা’র কথায় ফের ফেরা যাক। ওই একই সংখ্যায় উৎপলকুমার বসুর একটি গদ্যও আছে। সেই সঙ্গে জানানো হচ্ছে বইমেলায় নতুন বই বেরোচ্ছে দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘সত্যজিৎ রায়’, দাম ৩০ টাকা।
পরের বছর, ১৯৮৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় শঙ্খ ঘোষের প্রবন্ধ ‘আমাদের কবিতা পড়া’, সেখানে প্রাবন্ধিকের উপলব্ধি।
‘… কবিতা শুধু ছন্দের কারুকাজ নয়, কবিতা শুধু শব্দের সুবিন্যাস নয়, কবিতা শুধু প্রতিশ্রুতি বা পরিকল্পনার ঘোষণা নয় – যদিও এইসবই কবিতার বহিরাবয়বকে ধরে রাখে কখনও কখনও। কবিতা হল তাই, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকাকে গভীরতম আর ব্যাপকতমভাবে ছুঁয়ে থাকতে পারি আমরা।…’
সিদ্ধার্থ রায় দৈনিক লিখছেন ‘বইমেলা থেকে’– সেখানে বিমর্ষভাবে জানানো হচ্ছে, ‘… বইমেলার বয়স যেমন বাড়ছে, বাড়ছে খরচাও। প্রথম দিকে প্রতি বর্গফুট ছিল তিন টাকা। গত বছর প্রকাশকদের প্রতি বর্গফুট দাম দিতে হয় ৮.৫০ টাকা। এবার আরও এক টাকা বেড়েছে। লিটল ম্যাগাজিনের উদ্যোক্তাদের এ মেলায় টেবিল প্রতি দাম দিতে হবে ১২৫ টাকা।…’
পরের দিন ওই একই কলমে জানানো হচ্ছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসে পাওয়া যাচ্ছে তিন খণ্ডে জেমস জয়েস-এর ‘ইউলিসিস’-এর ফ্যাকসিমিলি এডিশন। পুরো পাণ্ডুলিপি দু’খণ্ডে এবং তৃতীয় খণ্ডে উপন্যাসের মুদ্রিত সংস্করণের সঙ্গে পাণ্ডুলিপির তুলনামূলক আলোচনা, ‘দাম হাজার টাকার কিছু বেশি।’
সে সময়ের আরও দু’-একটি বইয়ের বিজ্ঞাপন থেকে বলি, পূর্ণেন্দু পত্রীর সম্পাদনায় ‘গোলাপ যে নামে ডাকো’ (প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত এই ছিপছিপে চেহারার বইগুলি এখনও অনেকেই সানন্দে স্মরণ করবেন) দশ টাকা, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’– আট টাকা, অথবা সুশীল কুমার দে সম্পাদিত প্রবাদপ্রতিম ‘বাংলাপ্রবাদ’ ৬০ টাকা, জীবনানন্দ সমগ্র ৪৯ খণ্ড, ২৪ টাকা– সে সময়ে বইয়ের দাম হাজার টাকা শুনলেই শিরোঘূর্ণন অবধারিত। শানু লাহিড়ীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা গেল কমলকুমার মজুমদারের কম বয়সে লেখা নাটক– ‘হৃদিস্পৃক’ ও ‘ছন্দপতন’-এর কথা। কমলকুমার উৎসর্গীকৃতপ্রাণ গবেষকরা কি এই দু’টি নাটকের সন্ধান পেয়েছেন এখনও?
সে বছর সেই ১৯৮৭ সনে বইমেলা যাওয়া গিয়েছিল পর পর অনেক দিন এবং রোজই দ্রুত ‘প্রতিক্ষণ’-এর দোকানে গিয়ে হাত বাড়িয়ে চেয়ে নিতাম ‘প্রতিক্ষণিকা’। ফলে দেখছি, ৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লিখছেন চিত্তরঞ্জন ঘোষ এবং বিমল কর। অশোক ভট্টাচার্যর ‘একটি অ্যালবাম: ফিরে পেতে চাই’ লেখায় জানা যাচ্ছে ১৯৪৪ সালে অল ইন্ডিয়া ছাত্র ফেডারেশন প্রকাশিত এবং কামরুল হাসান, আদিনাথ মুখোপাধ্যায়, সৈফুদ্দিন আহমেদ, অরুণ দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘Bengal Painters Testimony’ নামের অ্যালবামটির কথা, যেখানে ভূমিকা লিখেছিলেন সরোজিনী নাইডু এবং শিল্পী পরিচিতি বিষ্ণু দে’র। সে বইয়ের হদিশ– হায়, এখনও পাওয়া যায়নি! আরও জানানো হচ্ছে, যথোচিত প্রহরা না থাকায় বহু লিটল ম্যাগাজিন ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে চুরি হয়ে গেছে! কারণ প্রহরারত হোমগার্ডরা দৈনিক পেত ১২ টাকা টিফিন-ভাত। এবারে আর সে টাকা নেই। ফলে পাহারাদারিও উধাও!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পরের বছর ১৯৮৮-তে, প্রতিক্ষণিকার ধরন কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত। প্রত্যহ ‘বাঙলা ভাষা’ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বা কেশবচন্দ্র সেনের রচনার নির্বাচিত অংশ। ‘বইমেলা থেকে’– এই দৈনিক প্রতিবেদনের ৩০ জানুয়ারি, ১৯৮৮ সংখ্যায় জানানো হচ্ছে, ‘শীত আর মাসের শেষ– দুটোই কলকাতা বইমেলাকে একটু যেন কাবু করেছে। বইমেলায় ভীড় না জমার আরেকটি কারণ,– ‘টিভি যেভাবে আমাদের নাগরিক উৎপাত এবং অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বইমেলাতেও তার ব্যতিক্রম দেখিনি।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সে বছর পরপর সংখ্যায় লিখছেন অমিতাভ গুপ্ত, সৈকত রক্ষিত, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো। দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল দীপক মুজমদারের ‘প্রাণ-গ্রন্থ-সাহেব না প্রাণ গ্রন্থ-বন্দুক’ প্রবন্ধে।
প্রাবন্ধিক বলছেন, ‘মুদ্রিত সত্য আজ মুদ্রা-মুদ্রণী-স্ফীতির ঢালাও অস্ত্র। কতটা অন্তরঙ্গ, আস্থাভাজন বা বিপর্যয়ের?’ (৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭)। ওই দিনই সিদ্ধার্থ রায় তাঁর ‘বইমেলা থেকে’ কলমে রিপোর্ট করছেন বইমেলায় বাঁদরের উৎপাত নিয়ে। ‘…. আর এই ডামাডোল ৩ ফেব্রুয়ারি, বেলা তিনটেয়, বোরোলিন অডিটোরিয়ামে একজন কবির বই প্রকাশ উপলক্ষে “বাংলা সাহিত্যে প্রেম” নিয়ে কয়েকজন হইহল্লা করলেন, বুকের পাটা আছে।…’
৮ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ওই একই বিভাগে জানানো হল নোবেলজয়ী সাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিং-এর উপস্থিতির কথা ‘ফেবার অ্যান্ড ফেবার’-এর দোকানে। যদিও ‘…ওঁকে দেখানোও হল মেলার ছোট্ট অংশ। বাংলা বইয়ের কোনও স্টলেই ওঁকে নিয়ে যাওয়া হয়নি।…’ ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ সংখ্যায় বের্টল্ট ব্রেখট-এর ‘বই পোড়ানো উৎসব’ কবিতা, অনুবাদ উৎপল দত্ত। বইমেলা জুড়েই প্রতিদিন একটি করে প্রতিযোগিতা ছিল। বলা বাহুল্য, সবই বাংলা সাহিত্য বিষয়ক। বাংলা বইয়ের অসম্ভব নাম দেওয়ার প্রতিযোগিতায় প্রথম হচ্ছে ‘ছোটদের কামশাস্ত্র’– এই নাম।
পরের বছর ১৯৮৮-তে, প্রতিক্ষণিকার ধরন কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত। প্রত্যহ ‘বাঙলা ভাষা’ বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বা কেশবচন্দ্র সেনের রচনার নির্বাচিত অংশ। ‘বইমেলা থেকে’– এই দৈনিক প্রতিবেদনের ৩০ জানুয়ারি, ১৯৮৮ সংখ্যায় জানানো হচ্ছে, ‘শীত আর মাসের শেষ– দুটোই কলকাতা বইমেলাকে একটু যেন কাবু করেছে। বইমেলায় ভীড় না জমার আরেকটি কারণ,– ‘টিভি যেভাবে আমাদের নাগরিক উৎপাত এবং অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বইমেলাতেও তার ব্যতিক্রম দেখিনি।’
পরের দিন ‘বইমেলা থেকে’ পর্যায়ে দেখছি, ‘সোভিয়েত পত্র-পত্রিকা এবং বইয়ের চাহিদাও এ মেলায় দেখার মতো। আশ্চর্য সস্তা ভাল সব বইয়ের ভিড় তো এখানেই।’ নিঃসন্দেহে। তখন কে-ই বা জানত আর মাত্র তিনটি বছর পরে কি হবে!
শেষ দিন, ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ সংখ্যায় ‘প্রতিক্ষণিকা’য় ‘জনৈক বই-চোরের সাক্ষাৎকার’ – ‘বইচোরটি’, স্বাভাবিক কারণেই যার নাম উল্লেখ করা হয়নি, বইচুরির নানান পদ্ধতির বর্ণনা দিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে এও জানিয়ে দিচ্ছেন, এগুলি ছাড়াও তাঁর মাথায় আরও হরেকরকম কায়দা আছে। ‘… দেখুন, আমি হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করেছিলাম, আমায় দেখে কেউ বোকা বোকা ভাবছে, এটা হতেই পারে না।’– তাঁর সরল আত্মঘোষণা। অসম্ভব উপাদেয় এই রোমহর্ষক লেখাটি বারবার পড়ার মতো।
১৯৮৯-এর ২৮ জানুয়ারি সংখ্যায় ‘প্রতিক্ষণিকায়’ উৎপলকুমার বসু’র ‘দিশ পাবলিশার ইস ম্যাড’ লেখাটি আদতে সম্পাদকীয় সহযোগীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলে, এবং অলক রায়চৌধুরির ‘মুফতের বইমেলা’ লেখায় আত্মদর্শন ‘…কোন গাড়োল কলেজ স্ট্রীটের তিরিশ পার্সেন্ট ছাড়ে বইমেলার দশ পার্সেন্টে মজে।…’
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘বই ও বিবাহ’ (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯) লেখায় সন্দীপনীয় ঘোষণা, অনেকটা উইল করার ঢঙে:
“আমার মৃত্যুর পর, মাথার বালিশের নীচে, গীতার বদলে, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বইটি রাখতে হবে।…”
চার বছরে সম্ভাব্য ৪০টি সংখ্যা, তার মধ্যে মাত্র ১৬টি (অর্থাৎ শতকরা ৪০ ভাগ) টুকরো কাগজ ঘেঁটে কতটুকুই বা জানানো গেল। আরও যে ২৪টি সংখ্যা এর বাইরেও রয়ে গেল সেখানে নিশ্চিতভাবেই আছে আরও অনেক চমৎকার লেখা, উপাদেয় গদ্যে সুশোভিত, যেমন সুগন্ধি গদ্য আজকাল প্রায় বিলুপ্ত অবহেলা, স্ব-আরোপিত দায়িত্ববোধ, তথ্যভারাক্রান্তি আর পাণ্ডিত্যের চাপে। কোন না কোনও দিন এই সংখ্যাগুলিও হয়তো নাগালে আসবে এই আশা নিয়েই সুতরাং…।
কৃতজ্ঞতা: প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন