খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখি, তিনি ছিলেন বিঘ্নেশ্বর, বাধাবিপত্তির ঈশ্বর। সেখান থেকে ক্রমশ হয়ে উঠেছেন বিঘ্ননাশক দেবতা। অনেক প্রাচীন পাথরের মূর্তিতে তাঁর এই বিঘ্নরাজের ভয়ংকর রূপ ধরা আছে। সত্যজিতের পুরাণের জ্ঞান দেখে বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। ‘পথের পাঁচালী’তে গণেশকে এক অন্যরকমভাবে দেখিয়েছিলেন তিনি। মনে আছে, দুর্গার সেই মৃত্যুদৃশ্যের কথা। খুবই অসুস্থ দুর্গা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলক। বিদ্যুতের আলোছায়ায় কুলুঙ্গিতে রাখা গণেশকে মনে হচ্ছিল যেন তাণ্ডবনৃত্য করছেন। তখন তাঁকে ভয়ংকর মনে হচ্ছিল।
‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া’। গণপতি, পিতা আমার কাছে এসো।
ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী, গণেশ চতুর্থী। গণেশ ছিল আসলে ছত্রপতি শিবাজির আরাধ্য, পেশোয়াড়ের দেবতা। প্রথম সর্বজনীন গণেশ পুজোর খবর পাওয়া যাচ্ছে ১৮৯২ সালে পুণেতে, বুধওয়ার পেটে শালুকের লেনে শ্রীমৎ ভাউসাহেব রঙ্গোরির বাড়িতে। এই পুজোর সঙ্গে ছিলেন নানাসাহেব খাসগিওয়ালে আর গণপতরাও ঘোটাওডেকার। এই সর্বজনীন পুজোর ভূয়সী প্রশংসা করে মহামান্য তিলক তাঁর ‘কেশরী’ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখেন। এর দু’বছর পর ১৮৯৪-তে লোকমান্য তিলক স্বাধীনতা আন্দোলনে অঞ্চলের যুবক সম্প্রদায়কে একত্র করতে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে তিনি নিজেই গণেশ পূজা চালু করেন মহারাষ্ট্রের মুম্বইতে। মুম্বইতে সেই থেকে গণেশ পুজো নিয়ে মাতামাতির শুরু।
ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থীতে পুজোর ব্যাপারটা কিন্তু বাল গঙ্গাধর তিলকই শুরু করেন। মুম্বইতে গণপতি উৎসব হয় মোট ১১ দিনের। বাড়ি এবং বারোয়ারি মিলিয়ে সেখানে পুজোর সংখ্যা প্রায় ২ লক্ষ! এখন তো গোটা দেশে গণেশ পুজোর রমরমা। মুম্বই এবং মহারাষ্ট্রে গণেশ পুজোর একটা সর্বজনীন রূপ দেখা গেলেও এই রাজ্যে গণপতি মন্দিরের সংখ্যা খুব একটা কম নয়! প্রায় প্রত্যেক গ্রাম-শহরে একাধিক গণেশ মন্দিরের দেখা মেলে। এবং প্রত্যেকটি মন্দির প্রতিষ্ঠানের পিছনে রয়েছে এক একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। একই সঙ্গে সেইসব মন্দিরে দেখা যায় গণেশের বিচিত্র রূপ।
তবে শুধু মুম্বই বললে ভুল হবে, পুণেতেও গণেশ পুজোর রমরমা বেশ ভালোই। শ্রীমৎ ভাউসাহেব রঙ্গোরির পুজোতে আজও বেশ ভিড় হয়! তবে পুণে বিখ্যাত তার পাঁচটি ‘মাচে গণপতি’-র জন্য। এই পাঁচটি পুজো সবচেয়ে বেশি মানা হয়। এরা পাঁচজন হলেন– কসবা (গ্রামদৈবত, মানে ইনি প্রথম পূজিত হন গ্রামের দেবতা রূপে), তাম্বড়ি যোগেশ্বরী, গুরুজি তালিম, তুলসীবাগ আর কেশরী ওয়াদায় অবস্থিত। এগুলির কোনওটিই সার্বজনীন পুজোরূপে প্রচলিত ছিল না যদিও এখন সবার জন্য দ্বার উন্মুক্ত। আড়ম্বরে এদের সবাইকে ছাপিয়ে গেছে শ্রীমৎ দাগ্দুশেঠ হালওয়াই-এর গণেশ পুজো– অনেকটা কলকাতার একডালিয়া বা মুদিয়ালির দুর্গা পুজোর মতো বা মুম্বইয়ের লালবাগচা রাজার মতো। পুণের গণেশ পুজো নিয়েও লিখতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে!
আমার কাছে গণেশপ্রিয়তার কারণ তাঁর শৈল্পিক রূপ। ছবিতে-ভাস্কর্যে তাঁকে কত বিচিত্র রূপেই না ধরা হয়েছে। এর অন্যতম কারণ তাঁর অ্যাবস্ট্রাক্ট রূপ। মানুষের ধড়ে হাতির মুণ্ডু, ফলে শিল্পীরা তাঁদের কল্পনার দৌড় অনেকদূর পর্যন্ত খেলাতে পেরেছেন। তার সঙ্গে আছে পুরাণ, মহাভারতে, লোককথায় তাঁকে নিয়ে বিচিত্রতর কাহিনি। সেই সব কাহিনিও ধরা আছে পাথরের ভাস্কর্যে।
গণেশকে নিয়ে এক বিচিত্র কথা শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের কাছে। ‘পথের পাঁচালী’তে গণেশকে এক অন্যরকমভাবে দেখিয়েছিলেন তিনি। মনে আছে, দুর্গার সেই মৃত্যু দৃশ্যের কথা। খুবই অসুস্থ দুর্গা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলক। বিদ্যুতের আলোছায়ায় কুলুঙ্গিতে রাখা গণেশকে মনে হচ্ছিল যেন তাণ্ডবনৃত্য করছেন। তখন তাঁকে ভয়ংকর মনে হচ্ছিল। মনে আছে, ১৯৮৪ সাল, ‘এক্ষণ’-এ ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্য ছাপা হচ্ছিল। সেই সময় একদিন কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, গণেশকে তো সিদ্ধিদাতা বলেই জানি। আপনি ছবিতে অমন ভয়ংকর ভাবে দেখালেন কেন?
উনি একটা ছোট্ট কথায় তাঁর উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘গণেশ সিদ্ধিদাতা পরে হয়েছেন, গণেশ আদতে কর্মবিঘ্নের দেবতা।’ ব্যস এইটুকুই। পরে বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখি, তিনি ছিলেন বিঘ্নেশ্বর, বাধাবিপত্তির ঈশ্বর। সেখান থেকে ক্রমশ হয়ে উঠেছেন বিঘ্ননাশক দেবতা। অনেক প্রাচীন পাথরের মূর্তিতে তাঁর এই বিঘ্নরাজের ভয়ংকর রূপ ধরা আছে। সত্যজিতের পুরাণের জ্ঞান দেখে বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম।
সত্যজিতের আর একটি ফিল্মে গণেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা গিয়েছিল। ছবির নাম ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। বারাণসীর অভিজাত ঘোষাল বাড়ি থেকে সেই দুর্মূল্য গণেশ মূর্তি উধাও এবং সেটা উদ্ধার করার ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ফেলুদার এই কাহিনি। বইতে উল্লেখ আছে, সেই গণেশ ঘোষাল বাড়িতে এসেছিল দক্ষিণ ভারতের মাদুরাতে ডাকাতদের ফেলে যাওয়া থলে থেকে। ফিল্মে ঘটনাটি সম্পূর্ণ বদলে গণেশপ্রাপ্তি হয়েছিল নেপালের আদিত্য শামসের জং বাহাদুর রাণার কাছ থেকে। ছবিতে সত্যজিৎ গণেশের বর্ণনাটি বলিয়েছিলেন মগনলালের মুখ দিয়ে। ‘গোল্ড ফিগার, থ্রি ইঞ্চেস লং। ক্রাউনে ডায়মণ্ড, বেসে পান্না আউর চুনি। নেপালের জিনিস।’
উমানাথ যখন মগনলালকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত সব তুমি জানলে কী করে? আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি।’
মগনলাল তাঁর উত্তরে পকেট থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজের ক্লিপিং বের করে দেখায়। ফিল্মে সেই লেখাটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায়। কিন্তু সত্যজিৎ সেই কাগজের টুকরোটিকে অম্বিকা নাথ ঘোষালের লেখার ক্লিপিং হিসেবে দেখান। ক্লিপিংটিতে ওই গণেশের যাবতীয় বর্ণনা এবং গণেশটির পূর্বাপর ইতিহাস ছাড়াও লিখে দিয়েছিলেন, অষ্টাদশ শতকের ওই মূর্তিটি ১৯০৩ সালে স্যর জর্জ ওয়াটসের সভাপতিত্বে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় শিল্পদ্রব্য নিয়ে গ্রেট এগজিবিশনে প্রদর্শিত হয়েছিল।
সঞ্জিত চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, সত্যজিৎ ওই গণেশটি শুটিংয়ের জন্য চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর বাবা বিশিষ্ট গণেশ সংগ্রাহক বসন্ত চৌধুরীর কাছ থেকে। বসন্তবাবুর গণেশ সংগ্রহ নিয়ে ২০১১-তে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে একটি চমৎকার প্রদর্শনী হয়েছিল। বসন্তবাবুর ছেলেবেলা কাটে মহারাষ্ট্রে। সেই কারণেই তাঁর গণপতি প্রেম। ১৯৬০-এর দশকে তামিলনাড়ুর ত্রিচি শহরের এক মেলা থেকে তিনি প্রথম একটি ব্রোঞ্জের ছোট গণেশ মূর্তি কেনেন। সেই শুরু। মূর্তি সংগ্রহ এবং তার সঙ্গে পড়াশোনা। ফলে গণেশ নিয়ে তাঁর পুস্তক সংগ্রহও ঈর্ষণীয়। অনেক দিন আগে ‘মার্গ’ পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা ছাপা হয়েছিল এই গণেশ সংগ্রহ নিয়ে। সেখান থেকেই জানতে পারি, এই হস্তীমুখ গণেশের রূপভেদে মোট ৩২ রকমের মূর্তি আছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। আর সন্ধান পাওয়া গেছে, দুই থেকে আঠারো হাতের গণেশ মূর্তির। তাঁর হাতে ধরা আয়ুধের সংখ্যা হিসেব করে দেখা গেছে প্রায় চল্লিশ রকমের। শুধু সংগ্রহ করলেই হয় না, ওই লেখাটি পড়লে বোঝা যায় সংগ্রহ সম্পূর্ণতা পায় চর্চায়। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর একশো বাছাই গণেশ মূর্তি দান করে দিয়েছিলেন কলকাতার জাদুঘরে। সেই গ্যালারির উদ্বোধন হিসেবে হয়েছিল প্রদর্শনীটি। সেসব মূর্তি সযত্নে রাখা আছে তাঁর নামে পৃথক একটি গ্যালারিতে।
গণেশের বিচিত্রতর রূপ দর্শন হয়েছিল আর একটি মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে। ১৯৮২-তে, তখনকার বোম্বের প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়ামে ‘ভিসিয়ন্স অফ গণেশ’ নামে এক প্রদর্শনীতে দেখেছিলাম অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বিশ শতকের পট, প্রস্তর ও ধাতুর প্রায় ৫০/৬০টি মূর্তি। তবে যাঁরা গণেশ নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাঁদের পুণায় পর্বতী মন্দিরের কাছে সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির সংলগ্ন গণপতি মিউজিয়ামটি দেখতেই হবে। সেখানে পুরাণে বর্ণিত গণেশের ৩২টি রূপের সবরকম মূর্তি দেখা যায়। সেই মিউজিয়ামে শুধু গণেশ মূর্তি আছে ৩১১টি।
আমিও ভারতের বেশ কিছু মন্দিরে নানা ধরনের গণেশ মূর্তি দেখেছি। এই কয়েক মাস আগে দেখে এলাম এলিফান্টা। সেখানে গণেশ শিব-পার্বতীর পুত্র। মূল গুহার ডানদিকে বিপরীত দুই দেওয়ালের একদিকে কার্তিক আর অন্যদিকে দেওয়াল জুড়ে গণেশ। আর একটি দেওয়ালে সপরিবার শিব-পার্বতী। সেখানে ছোট্ট শিশু গণেশটিকে বেশ পছন্দ হল আমার। গুহার বেশ কয়েকটি থামের ওপরেও ছোট মাপের কয়েকটি গণেশ মূর্তি অনেকেরই দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। সেগুলিও চমৎকার দেখতে।
ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে এত ধরনের গণেশ আছে, পুরাণ ছাড়া কিংবদন্তিগুলি না জানলে সব গুলিয়ে যেতে পারে। গণেশের নরমুণ্ডচ্ছেদ এবং হস্তীমুণ্ড সংস্থাপন নিয়েই কত বিচিত্র কাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। অন্ততপক্ষে এই বিষয়টি নিয়ে পাঁচ রকম কাহিনি রয়েছে আর সেগুলি নিয়ে রয়েছে মন্দির ভাস্কর্য।
তবে আমার দেখা সেরা গণেশ মূর্তিটির অবস্থান ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরের বিশাল নৃত্যরত জটামুকুট ও নাগ– উপবীতধারী গণেশ। গেট দিয়ে ঢুকে মূল মন্দিরের বাঁদিকে এঁর দর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হল, মূর্তির গায়ে পোশাক পরিয়ে মূর্তিটির সৌন্দর্য ঢেকে দেওয়া একদমই মানা যায় না।
এটা লিখতে লিখতেই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বইয়ের জাদুঘর ‘সুবর্ণরেখা’র মালিক ইন্দ্রনাথ মজুমদার ঠাকুর-দেবতা খুব একটা মানতেন না। কিন্তু দোকানের কর্মচারীরা একটি ধাতুর গণেশ মূর্তি কিনে এনে দোকানের এক কোণে তাকে সাজিয়ে রেখেছিলেন। প্রত্যেক দিন মূর্তির সামনে তাঁরাই ফুল মিষ্টি দিয়ে পুজো করতেন। একদিন এক বিদেশি ভারততত্ত্ববিদ পুরনো বইয়ের খোঁজে এসে মূর্তিটিকে পছন্দ করে ফেলেন। ইন্দ্রদা বিনা দ্বিধায় বেশ ভালো দামে সেটি তাঁকে বিক্রি করে দেন। আমার জানা আর কাউকে দেখিনি, যিনি নিজের দোকানের গণেশকে বিক্রি করে দিতে। তবে কর্মচারীদের মন খারাপের আগেই তিনি দোকান থেকে আর একটি গণেশ কিনে এনে তাকে সাজিয়ে রেখে দেন।
ছবি ঋণ: লেখক