Robbar

পাখির ডাকে নয়, ঘুম ভাঙত ভোরের প্রথম টুং-টাং শব্দে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 5, 2024 8:41 pm
  • Updated:October 6, 2024 12:41 pm  

১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমরা ছিলাম এই বেলগাছিয়া ট্রামডিপোর কাছে। বাবা ট্রামকে ভালোবাসত বলেই কি না, জানি না ঠিক,  ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যেখানে থাকলাম আমরা, সেও কিন্তু আর এক ট্রাম-প্রধান অঞ্চল, শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ঠিক উল্টোদিকের গলি, কালাচাঁদ সান্যাল লেনে। বাড়ির ঠিকানা অবশ্য ছিল– ‘১০৩ ই, বিধান সরণী’। এতটাই কাছে এবার ট্রাম, যে ঘুমোনোর আগেও শেষ শব্দ শুনি ট্রাম তার বাড়িতে ঢুকছে: ‘টুংটুং টুংটুং, সরে যাও সবাই, পথ করে দাও’। আবার, পাখির ডাকে নয়, ঘুম ভাঙেও ভোরের প্রথম ট্রামের টুংটাং আওয়াজে।

শ্রাবন্তী ভৌমিক

জানা ছিল না? নাকি জেনেও ভুলে ছিলাম? ‘জীবন  যখন শুকায়ে যায়’: এইরকম একটা সময় সকলের জীবনেই তো আসে! আর, আমরা এখন সেই সময়ের মুখোমুখি হয়েছি, চারদিকে একটা হারিয়ে যাওয়া সুর আমরা খুঁজে চলেছি। নেই, নেই,  যা দেখেছি, শুনেছি, পেয়েছি, বড় হয়ে উঠেছি যা কিছু সঙ্গে নিয়ে, ক্রমশ ‘নেই’ হয়ে যাচ্ছে সব। প্রিয় মানুষজন তো বটেই, ‘যারা বিহানবেলায় গান এনেছিলো আমার মনে’, তাারা  মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে, এখন আমি যেন ‘বসে বসে কেবল গণি নীরব জপের মালার ধ্বনি অন্ধকারের শিরে শিরে’! চেনা সুর খুঁজে বেড়ানোই এখন আমাদের কাজ।

সিটি স্ট্রিট। শিল্পী: বিকাশ ভট্টাচার্য

প্রিয় মানুষরাই কি কেবল সুর বেঁধে দেন আমাদের  মনে? তা তো নয়, শহরের ধুলোয় বড় হওয়া মন আমাদের, কঠিন বাস্তব থেকেও সুর খুঁজে ফিরত। ছোট্ট আমি যখন বাবার হাত ধরে বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর দিকে হাঁটতাম ইন্দ্র বিশ্বাস রোডে, পাতাবিহীন গাছের মেলে রাখা ডাল দেখে বলেছিলাম, ‘ওটা কী? ভয় করছে আমার।’ বাবা বলল, ‘ভয় করছে কেন? ওটা তো একটা গাছ!’ একটু আশ্বস্ত তখন  আমি, বললাম, ‘‘না, ওটা মনে হচ্ছে একটা মেয়ে, দু’হাত তুলে নাচছে!” ইট-পাথরের বাঁধানো পথে পথে শুকিয়ে যাওয়া গাছটিকেও শহুরে  শিশু নৃত্যরত দেখে। হেঁটে হেঁটে বেলগাছিয়া ট্রামডিপোয় গিয়ে একটা  ট্রামে বসলেই মন খুশি, যাব তো শেয়ালদায় রেল কোয়ার্টারে, যেখানে পাব দিদা, দাদু, জ্যেঠু, পিসি, কাকু, বড়মা,আর দিদিকে! মনের মধ্যে টংকার, আর সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে ট্রামের টুংটাং ঘন্টি আর খচখচ লাইনে চলার আওয়াজ! সুর পাই না কি চারপাশের যানবাহন থেকেও? ঘুমের ঘোরেও শুনেছি কত, টুংটাং ঘন্টির আওয়াজে ট্রাম আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ‘সব পেয়েছির দেশে’, মানে দাদু-দিদার কাছে। আমার মনে পড়ে না, বাবা-মা কখনওই বাসে চড়িয়ে শেয়ালদায় বা আর কোথাও নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। যেখানে যাই ট্রামে চড়েই যাই। প্রথমে পরেশনাথ মন্দির, তারপর নীচে রেললাইন আর ধারে তার ঝুপড়ি ঘর, তারপর আর জি কর হাসপাতাল পেরিয়ে দুলকি চালে আমরা চলেছি। আমার বাবার স্বভাব যেরকম জানি, ওই অল্প বয়সে বাসে চড়ত না বা লাফিয়ে চলন্ত বাসেও উঠত না, এটা তো হতেই পারে না, কিন্তু আমাকে নিয়ে ট্রামে চড়েই বেড়াতে ভালোবাসত বাবা। রাতে যখন ফিরতাম শেয়ালদা থেকে, তখনও মির্জাপুর স্টপ থেকে টুক করে উঠে পড়তাম ট্রামে, আর সামনের দিকে একটা কোনও সিটে বসে ট্রামের গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও পড়তাম অনেক সময়ে। কিংবা, টুং-টুং আওয়াজ শুনেই মনে ভাব জাগত মাঝেমধ্যেই: এসব ‘মিঠির বচন’ বলে একটা ছোট্ট নোটবইতে লিখে রেখেছিলো বাবা, ট্রাম চলছে ঘটাং ঘটাং আর টুং টুং বাজনা বাজিয়ে, আর আমি বলে চলেছি, ‘চাঁদ উঠেছে আকাশে/ চাঁদের কপাল ভেসে গেছে গাছের কুটীরে/ গাছের মধ্যে আছে দেশ এক!’ এর পাশে বাবা ব্র্যাকেটে লিখে রেখেছিল ‘পর্বে পর্বে তালি দিয়ে’। অথবা ‘রবিননাথের কোনটা দিন/ জন্মদিন/ আমি তো তা জানতে পারছি না/ বুঝতে পারছি না!’ তাই মনে হয়, ট্রামের সুর-ঝংকারের সঙ্গেই তো আমার শিশুকাল থেকে বেড়ে ওঠা!

 

১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আমরা ছিলাম এই বেলগাছিয়া ট্রামডিপোর কাছে। বাবা ট্রামকে ভালোবাসত বলেই কি না, জানি না ঠিক,  ১৯৬৬-র ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭৩-এর জানুয়ারি পর্যন্ত যেখানে থাকলাম আমরা, সেও কিন্তু আর এক ট্রাম-প্রধান অঞ্চল, শ্যামবাজার ট্রামডিপোর ঠিক উল্টোদিকের গলি, কালাচাঁদ সান্যাল লেনে। বাড়ির ঠিকানা অবশ্য ছিল– ‘১০৩ ই, বিধান সরণী’। এতটাই কাছে এবার ট্রাম, যে ঘুমোনোর আগেও শেষ শব্দ শুনি ট্রাম তার বাড়িতে ঢুকছে: ‘টুংটুং টুংটুং, সরে যাও সবাই, পথ করে দাও’। আবার, পাখির ডাকে নয়, ঘুম ভাঙেও ভোরের প্রথম ট্রামের টুংটাং আওয়াজে। শুধু বিধান সরণির ট্রামডিপো তো নয়, গলির অন্য মুখেও সার্কুলার রোডের ট্রাম লাইন। আসত গ্যালিফ স্ট্রিট ডিপো থেকে ‘বারো’ নম্বর ট্রাম। সব ভুলে গেলেও এই বারো নম্বর তো ভুলব না কখনওই, কারণ ও-ই আমাকে নিয়ে যেত শেয়ালদায় দাদু-দিদার বাড়ি। এই শ্যামবাজারের বাড়িতে চলে আসার পর মা নিশ্চিন্তমনে ভোরবেলার কলেজে যেতে পারত ডিপো থেকে ফাঁকা ট্রমের লেডিজ সিটে বসে।

Kolkata tram line 3 at Shyambazar (1980) - Tram Travels
১৯৮০। শ্যামবাজার

ট্রাম-ময় জীবন আমাদের তখন। ইশকুলে যেতে অবশ্য কখনও ট্রামে বাসে চড়তে হয়নি আমাকে। বাবার বিশ্বাস ছিল হাঁটা পথে, বড় জোর রিকশার দূরত্বে, ইশকুল যেতে হবে। কিন্তু সপ্তাহে দুই দিন, মঙ্গল আর শুক্রবার, বিকেলে ট্রামডিপোর ট্রামে আমাকে উঠতেই হত মা’র সঙ্গে। শ্যামবাজার ডিপো থেকে ছাড়ত ‘পাঁচ’, ‘ছয়’ আর ‘নয়’, ‘দশ’ নম্বর ট্রাম। জোড়া জোড়া বললাম, কেননা জোড়গুলির গতিপ্রকৃতির ভিন্নতা ছিল। একটু এগিয়েই হাতিবাগানে ডান দিকে বেঁকে গ্রে স্ট্রিট দিয়ে চলে যেত নয়, দশ নম্বরের ট্রাম। আর সোজা কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ধরে ধর্মতলা যেত পাঁচ নম্বর,  ছয় যেত অফিসপাড়া, ডালহৌসি । যেটা আগে পেতাম, তাতেই উঠে বসতাম আমরা। কেননা যেখানে যাব, সেটা এক আশ্চর্য মধ্যপথ। নয় বা দশ নম্বর ট্রাম হাতিবাগানে বেঁকে যাবে, তারপর আমরা নামব  গ্রে স্ট্রিট, সেন্ট্রাল এভিনিউ ক্রসিংএ। এবার দক্ষিণ মুখে সেন্ট্রাল  অ্যাভিনিউ ধরে  হেঁটে যেতে হবে বিডন স্ট্রিট মোড় পর্যন্ত। আর যদি তিন বা চার নম্বর ট্রামে চড়ি, বিডন স্ট্রিট কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে (হেদুয়া) নামলে বিডন স্ট্রিট ধরে পশ্চিম মুখে হেঁটে সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর মোড়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে সেই একই গন্তব্যে। এই মজাটা ’৬৬ সাল থেকেই পেয়েছি অনেক অনেক বছর পর্যন্ত গানের ক্লাস ‘রবিতীর্থে’ যাওয়ার সুবাদে। ট্রামডিপোর কাছে থাকতাম বলে সব সময় যে বসে বসে যেতে পারতাম, তা কিন্তু নয়। সে সময়ে ট্রাম বাস এতটাই কম চলত রাস্তায় যে ট্রামে লোকের ভিড় প্রায় সব সময়। আর, গাড়ি কম থাকত বলেই তো ট্রামের গতি সম্ভব ছিল। রাস্তা দখল করে নেওয়া অটো, স্কুটার ছিল না তেমন, বাসও ছিল সংখ্যায় কম। তাই বিকেলে আমরা অনেক সময়ে উঠতাম সেই ট্রামটায়, যেটা তখন ঢুকছে ডিপোয়, অর্থাৎ টার্মিনেট করছে। সবাই নেমে যাবে, আমরা বসার জায়গা পাব, সে গিয়ে দাঁড়াবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ট্রাম হিসেবে, আমরা নিশ্চিন্ত, বসার জায়গা তো পাওয়া গেল! এত সময় ছিল তখন আমাদের হাতে? কী করে?  আলস্যে কাটাতাম নাকি দিন? তাও তো মনে হয় না। সপ্তাহের কাজের দিন, স্কুল থেকে ফিরে তৈরি হয়ে, গানের ক্লাস যাওয়া, ওই পরিমাণ হাঁটা পথও পেরতে হত, আবার বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করতে হবে, পরের দিন স্কুল আছে! ট্রামের মতোই আমাদেরও একটা আশ্চর্য ‘তাড়াহুড়ো বর্জিত নিয়মবিধি পালনে’র আরাম ছিল মনে হয়। এখন সব অন্যরকম।

ট্রামডিপোর উল্টোদিকের গলিতে বছর সাতেক থাকার পর, ১৯৭৩-এ আবার আমাদের বাসা বদল করতে হয়, কিন্তু ছাড়তে হয়নি এই শ্যামবাজার পাড়াটা। গেলাম এবার সার্কুলার রোডের ওপর বিরাট উঁচু ইলেক্ট্রিসিটি অফিসের বাহুবন্ধে। ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির বাড়ির কোলের মধ্যে লাল রংয়ের মিত্র বাড়িতে থাকা এবার। তাই শ্যামবাজার ট্রামডিপো, গ্যালিফ স্ট্রিট ট্রামডিপো আর একটু দূরের বেলগাছিয়া ট্রামডিপো, কোনওটার সুযোগই আমাদের হাতছাড়া হল না।

trams
সে ছিল একদিন ট্রামেদের যৌবনে কলকাতা

ইশকুল শেষ হওয়ার পর কলেজ যাওয়ার জন্য আবার নতুন করে ট্রামের সঙ্গে সখ্য। রাস্তা পেরিয়ে ঘোষ কাজিনের গলি দিয়ে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে বেরিয়ে ট্রাম ধরা। এখন সঙ্গী শুধুই পাঁচ আর ছয় নম্বর ট্রাম, কেননা যেতে হবে সোজা কলেজ স্ট্রিট। এই সময়ে আরও একটু ভিড় বাড়তে শুরু হল বলে মনে হয়। সকাল ন’টা, সাড়ে ন’টায় ট্রামে একেবারে ঠেলাঠেলি ভিড়। আর যে-ট্রাম ডিপোয় ঢুকছে, সেও আগের স্টপ থেকে বসার সিট পূর্ণ করেও ঢুকছে, দেখা যেত। আমাদের হাতেও তখন সময় থাকত না যে, একটা-দুটো ট্রাম ছেড়ে দেব। তাই শিখলাম এবার জীবনযুদ্ধ-ধাক্কাধাক্কি করে ট্রামে যাতায়াত। সব সংগীত-মূর্ছনা গেল মুছে। ট্রাম এখন বাসের সমতুল, যুদ্ধ করে উঠতে হয়, চোখ কপালে তুলে ঠেলে নামতে হয় যথাস্থানে। কিন্তু এই রকম সময়েও, শুধু গতির আরাম পাওয়া যেত বলেই বাসের চেয়ে ট্রাম যাত্রায় সুখ ছিল অনেক। একটু অবসর সময়ে, যখন অফিসের ভিড় কম, আমরা ট্রামে চড়ে বেড়াতে কত যে ভালোবাসতাম। আমাদের এক বন্ধুর বাবা ধর্মতলা যাওয়ার জন্যেও ডালহৌসি হয়ে ধর্মতলা যায় যে ট্রাম, তাতে উঠে পড়তেন। অনেক সময় নিয়ে ট্রামে বেড়ানো যাবে যে! কাজ থাকলেই বা কী? পৌঁছে তো দেবে সেই ট্রামও, হাতে একটু বেশি সময় নিয়ে বেরলেই হল।

Calcutta Tram Users Association | Route 12A tram M Class SLT 87 entering the Esplanade Terminus . . C. 1980s Esplanade terminus. . . #instagood #f4f #instafollow #igdaily… | Instagram
ধর্মতলার ট্রাম

কলেজ যাত্রা পর্যন্ত যখন বলাই হয়ে গেল, তখন আরও একটু এগিয়ে  যেতেই বা ক্ষতি কী!  বিশেষ বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানোর উপায় হিসেবেও তো ট্রামযাত্রা ছিল আমাদের অনন্য সহায়। কোনওক্রমে যদি একদম সামনের সিট দুটো পাওয়া যেত, তখন অফুরান কথায় গল্পে, টুংটুং ট্রামের শব্দে কী মনোরম শ্যামবাজার থেকে ধর্মতলা ট্রামডিপোয় চলে যাওয়া এবং সেই একই ট্রামে আবার ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার আসা! বন্ধুরা বলত, কাঁধঝোলা নিয়ে ওরা আর কত হাঁটবে সারা কলকাতা! ওরা জানেই না, ঝোলা কোলের ওপর রেখে ট্রামে চড়েও কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা! মনে হয়, যেন স্বপ্ন, টুংটুং আর ঘড়ঘড় শব্দের ট্রাম আমাদের স্বপ্নের দেশে বেড়াতে নিয়ে যেত। দু’একজন কনডাক্টর যে আমাদের চিনে ফেলেননি, এমনও নয়। স্মিত হাসিতে একদম শেষ পর্বে এসে তাঁরা টিকিটের পয়সা চাইতেন আমাদের কাছে। একটা সুস্থির প্রশ্রয় দিয়ে আমাদের বড় করে তুলেছে কলকাতার ট্রাম।