এক-দু’হাজার বছর আগে গঙ্গা সত্যিই ‘প্রাণদায়ী’, ‘কলুষনাশিনী’ ছিল। কিন্তু এতদিনের অজস্র পাপের ভারে গঙ্গা আজ নিজেই মৃতপ্রায়। তার নিজেরই চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ, আজ থেকে অনেকদিন আগেই গঙ্গা বাঁচাতে তৈরি হয়েছিল ‘গঙ্গা মহাসভা’। ১৯০৫ সালে মদনমোহন মালব্য যা তৈরি করেছিলেন। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি চুক্তিও করে। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে না কেন্দ্র, না কোনও রাজ্য ওই চুক্তি মেনে চলেনি। ২০১১-য় গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী। তার পরেও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন স্বামী শিবানন্দ। সমর্থন করেছেন আন্না হাজারে, জি ডি আগরওয়ালের মতো পরিবেশকর্মী। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি।
‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি, পাপিয়োকে পাপ ধোতে ধোতে’।
আটের দশকের জনপ্রিয় সিনেমার এই গান শোনেনি, এমন কেউ বোধহয় ভূ-ভারতে নেই। সিনেমায় গঙ্গার (মন্দাকিনী) রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘দূষিত’ করেছিল একের পর এক ব্যক্তি। আর বাস্তবের গঙ্গাকে (নদী) দূষিত করে চলেছি আমরা। এককথায় বলতে গেলে, সেখানে কোনও বাছবিচার নেই। এ তোমার পাপ, এ আমার পাপ– এ সকলের পাপ।
সদ্য ভারতের সবচেয়ে নোংরা শহরগুলির তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এক লাখের বেশি বাসিন্দা, এমন শহরের মধ্যে সবচেয়ে নোংরা হিসাবে ‘সেরা’র স্বীকৃতি পেয়েছে হাওড়া। প্রথম দশে রয়েছে কলকাতা, কল্যাণী, ভাটপাড়া, রিষড়া, কাঁচড়াপাড়া। আর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের প্রথম কুড়ির মধ্যে নেই গঙ্গা-তীরবর্তী কোনও শহর। এক লক্ষের বেশি বাসিন্দা, গঙ্গার তীরে এমন শহর রয়েছে অন্তত ১০০টি। এক লক্ষের নীচে আরও ৯৭। ২০২৩ সালের তালিকা অনুযায়ী, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বারাণসী। তারপরে রয়েছে প্রয়াগরাজ, বিজনৌর, হরিদ্বার, কনৌজ, পাটনা, হৃষিকেশ, কানপুর, রাজমহল এবং সাহিগঞ্জ। ‘গঙ্গা শহরে’র মধ্যে ছাপড়া সর্বশেষ স্থান পেয়েছে। সমস্ত শহরের মানব-বর্জ্য, শিল্প-বর্জ্য, রাসায়নিক গঙ্গায় এসে মিশছে। নানা উৎসব-পার্বণে গঙ্গাস্নান করে পাপস্খালন করেন অন্তত সাত কোটি মানুষ। তার সঙ্গেই আছে গঙ্গাতীরে দেহ দাহ করে অস্থি বিসর্জন। শুধু বারাণসীতেই বছরে ৪৫ হাজার দেহের অন্তিম সংস্কার হয়। কিছু দেহ অর্ধদগ্ধ অবস্থায় বিসর্জন দেওয়া হয় গঙ্গায়।
গত বছর উত্তরপ্রদেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের রিপোর্ট বলছে, কানপুরের কাছে জানা গ্রামে গঙ্গায় কলিফর্মের পরিমাণ অত্যধিক। প্রয়াগরাজের কাছে সঙ্গমে, বা যেখানে বরুণা নদী বারাণসীতে গঙ্গায় মিশেছে, সেখানে বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) বিপজ্জনক মাত্রায় (লিটারে ১২.৪০ মিলিগ্রাম)। আবার আগ্রা থেকে হামিরপুর পর্যন্ত মারাত্মক দূষিত যমুনাও। অর্থাৎ, গঙ্গোত্রী থেকে প্রবাহিত হয়ে আমাদের সমস্ত ‘পাপ’ গ্রহণ করে পতিত পাবণী গঙ্গা গিয়ে সমুদ্রে মিশছে। মানব-স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য যা অত্যন্ত বিপজ্জনক!
…………………………………………………………………………………………………………..
গঙ্গার জল পান বা স্নান করা তো দূর, এমনকী, চাষের কাজেও গঙ্গার জল ব্যবহার করা বিপজ্জনক। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের অধীনে ন্যাশনাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রাম (এনসিআরপি) পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, ‘যারা উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং বাংলায় গঙ্গার তীরে বাস করে, দেশের অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় তাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।’
…………………………………………………………………………………………………………….
পরিসংখ্যান ও অতীতের দিকে নজর ফেরানো যাক। দেশের ১১টি রাজ্যের প্রায় ৫০ কোটি মানুষ (দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ) গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল। পক্ষান্তরে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলির মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে গঙ্গা! গঙ্গার জল পান বা স্নান করা তো দূর, এমনকী, চাষের কাজেও গঙ্গার জল ব্যবহার করা বিপজ্জনক। ২০১২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের অধীনে ন্যাশনাল ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রোগ্রাম (এনসিআরপি) পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, ‘যারা উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং বাংলায় গঙ্গার তীরে বাস করে, দেশের অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় তাদের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।’ অথচ বিভিন্ন পুজো-পার্বণে গঙ্গাজল ছাড়া কোনও কাজ হয় না, পাদোদক-চরণামৃতে গঙ্গাজল আবশ্যক, তর্পণ থেকে ধর্মীয় অনেক আচারে গঙ্গাস্নান কার্যত বাধ্যতামূলক। সেসব কি লাটে উঠবে?
এক-দু’হাজার বছর আগে গঙ্গা সত্যিই ‘প্রাণদায়ী’, ‘কলুষনাশিনী’ ছিল। কিন্তু এতদিনের অজস্র পাপের ভারে গঙ্গা আজ নিজেই মৃতপ্রায়। তার নিজেরই চিকিৎসা প্রয়োজন। অথচ, আজ থেকে অনেকদিন আগেই গঙ্গা বাঁচাতে তৈরি হয়েছিল ‘গঙ্গা মহাসভা’। ১৯০৫ সালে মদনমোহন মালব্য যা তৈরি করেছিলেন। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি চুক্তিও করে। কিন্তু স্বাধীনোত্তর ভারতে না কেন্দ্র, না কোনও রাজ্য ওই চুক্তি মেনে চলেনি। ২০১১-য় গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে অনশনে প্রাণত্যাগ করেন স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী। তার পরেও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন স্বামী শিবানন্দ। সমর্থন করেছেন আন্না হাজারে, জি ডি আগরওয়ালের মতো পরিবেশকর্মী। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি।
…………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: রামের চিত্রকথা যেভাবে ‘অমর’ হয়ে উঠল
……………………………………………………………………………………………………………
রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হয়ে চালু করেছিলেন ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান’। ১৯৮৬-তে বারাণসীর ঘাট থেকে কলকাতা পর্যন্ত গঙ্গার পার বাঁধানো ও গঙ্গাপারের সৌন্দর্য্যায়নের অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচের পর তা আজ হাস্যকর পর্যায়ে। তারপর ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে তৈরি হয়েছে ‘ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথরিটি’। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে শুরু করেছেন ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প। তৈরি হয়েছে জলশক্তি মন্ত্রক। হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে বিভিন্ন অসরকারি সংস্থার অভিজ্ঞতা বলছে, এত সবের নিট ফল ‘শূন্য’। এতকাল যা চলেছে, তা মুমূর্ষু দেহে অলংকার পরিয়ে সেবা করার মতোই নিষ্ঠুর অপব্যয়।
পাপ যখন সকলের, তখন তা স্খালনের দায় থেকে কেউ নিষ্কৃতি পেতে পারে না। তর্পণের বিভিন্ন সময় বলতে হয়, ‘সতিলোকং গঙ্গোদকং তেভ্যং স্বধা’। অর্থাৎ তিল এবং গঙ্গাজল দিয়ে পূর্বপুরুষের তর্পণ। এখনও সচেতন না হলে হয়তো ‘গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো’র মতো গঙ্গাজল দিয়েই গঙ্গা-তর্পণ করতে হবে।