বইমেলায় তো বই বিক্রি হয়, গান নয়। তাহলে কী উপায়? ঠিক হল গানের সঙ্গে থাকবে মিনিবুক। এগিয়ে আসল ‘এ মুখার্জী’, গৌতমের প্রিয় বন্ধু দীপক ভট্টাচার্য, রঞ্জন সেনগুপ্ত, রাজীব নিয়োগীদের পাবলিশিং হাউজ। কথা হল ‘এ মুখার্জী’-র বইমেলার স্টলে একটা কোণা থাকবে গৌতমের জন্যে– যেখানে থাকবে বুকলেট, সঙ্গে গানের ক্যাসেট। বই তৈরি শুরু হল। সুন্দর ইলাস্ট্রেশনে, সাহিত্যের ছোঁয়ায়– শুধুই বই নয়, সে এক অমূল্য সম্পদ। তাছাড়া বইটাতে নোটেশন সহ গানের লিরিক্স থাকবে, আর কোনটা কার গান এবং কার গাওয়া– তাদের পরিচিতি। যে ক্যাসেট কিনতে চাইবে, তাকে দুটোই একসঙ্গে দেওয়া হবে। সাটিনের লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে।
’৯৫-এর বইমেলার শেষ ঘণ্টা পড়ে গেছে। গৌতম হাতে গিটার নিয়ে ‘এ মুখার্জী এন্ড কোম্পানী’-র সামনে থেকে ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে…’ গানটা গাইতে গাইতে চলেছে। সঙ্গে রয়েছে অনেকে। পার্ক স্ট্রিটের দিকে যেতে যেতে এই ভিড়টা আকার নিতে থাকে একটা মিছিলের। সবাই হাঁটতে হাঁটতে গলা মেলাচ্ছে। ওই সময়ে পার্ক স্ট্রিটের গাড়িঘোড়া, লোকজন যেন সব থমকে গেছে। অবাক চোখে তাকিয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছে। বইমেলার এটি একটি সুন্দর স্মৃতি আমার কাছে।
’৯৫-এর বইমেলার বিষয়ে আরও বলব, তার আগে অন্য কিছু কথা বলে নিই।
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র পরবর্তী সময়ে গৌতমের গান বাঁধার ও গাওয়ার উৎসাহের অভাব অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় কোনওকালেই দেখিনি। আমরা জানতাম, গৌতম মানেই গান, গৌতম মানেই সুর এবং কথার মেলামেশার রসায়ন।
অনেকেই আসতেন আমাদের বাড়িতে– সেইসব বিকেল গড়িয়ে সন্ধে-নামা রাত-ভোর গানের আড্ডায়। গানপাগল সব মানুষজন– কেউ বা নামকরা শিল্পী, কেউ নতুন, কেউ গান নিয়ে পড়াশোনা করেন, কেউ বা শুধুই গান শুনতে ভালোবাসেন। নিজের সিনেমার গান বাঁধা ছাড়া অন্যদের সিনেমারও মিউজিক ডিরেকশন করেছে গৌতম, আবার অনেক সময়ে নতুন সিনেমার জন্যে গান বাঁধা হত, সিনেমা হত না, গান থেকে যেত। গৌতম ট্যালেন্ট বুঝত, সম্মান দিত, তাই তাকে গান শোনাতে অনেকেই আসতেন– আমি অন্তত কখনও দেখিনি কাউকে ফিরিয়ে দিতে।
গান তো বাঁধা হত, কিন্তু সেই সব নাগরিক লোকগানের বাজার ছিল না তখন। মানুষের কাছে সেই সব গান পৌঁছে দেওয়ার কোনও মাধ্যম ছিল না। সেই সুযোগ করে দেয় ’৯৫-এর বইমেলা।
’৯৪ সালে কলকাতা দূরদর্শনের জন্যে গৌতম কিছু মিউজিক ভিডিও করার অফার পায়। গৌতমের শর্ত ছিল একটাই– এখানে আমরা নতুন কিন্তু ট্যালেন্টেড শিল্পীদের সুযোগ দেব। সেই হিসেবে বেশ কিছু নতুন গান নিয়ে রেকর্ডিং করা হয়, শুটিং শুরু হয়।
প্রায় সবাই নতুন মুখ, তখন নিতান্তই অপরিচিত। সিক্সটিন মাল্টিট্র্যাক রেকর্ডিং তখন সবে এসেছে। সময় কিংবা বাজেটের চোখ-রাঙানি না মেনে তৈরি হয় বেশ কিছু গান। রেকর্ডিং হয়েছিল ‘Presto Studio’-তে। এই প্রোজেক্ট যখন ভিডিও এডিটিং হতে শুরু করে, তখনই এসে যায় বইমেলা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, গানগুলোকে রিলিজ করতে হবে এবং তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এই বইমেলা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন সুশোভন অধিকারীর বইমেলাধুলো-র লেখা: চটের ওপর বসে মন দিয়ে কার্ড এঁকে চলেছেন একমাথা ঝাঁকড়া চুলের পূর্ণেন্দু পত্রী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু বইমেলায় তো বই বিক্রি হয়, গান নয়। তাহলে কী উপায়? ঠিক হল গানের সঙ্গে থাকবে মিনিবুক। এগিয়ে আসল ‘এ মুখার্জী’, গৌতমের প্রিয়-বন্ধু দীপক ভট্টাচার্য, রঞ্জন সেনগুপ্ত, রাজীব নিয়োগীদের পাবলিশিং হাউজ। আরেক বন্ধুও ছিল এঁদের সঙ্গে, সৌরীশ বসু। কথা হল ‘এ মুখার্জী’-র বইমেলার স্টলে একটা কোণা থাকবে গৌতমের জন্যে– যেখানে থাকবে বুকলেট, সঙ্গে গানের ক্যাসেট। বই তৈরি শুরু হল। সুন্দর ইলাস্ট্রেশনে, সাহিত্যের ছোঁয়ায়– শুধুই বই নয়, সে এক অমূল্য সম্পদ। তাছাড়া বইটাতে নোটেশন সহ গানের লিরিক্স থাকবে, আর কোনটা কার গান এবং কার গাওয়া– তাদের পরিচিতি। যে ক্যাসেট কিনতে চাইবে, তাকে দু’টোই একসঙ্গে দেওয়া হবে। সাটিনের লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে।
খুব একটা বেশি সময় হাতে ছিল না– যতদূর মনে পড়ে, দিন দশেক সময় ছিল বইমেলা শুরু হওয়ার আগে। তার মধ্যেই এই বিশাল কর্মকাণ্ড।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বই তৈরি শুরু হল। সুন্দর ইলাস্ট্রেশনে, সাহিত্যের ছোঁয়ায়– শুধুই বই নয়, সে এক অমূল্য সম্পদ। তাছাড়া বইটাতে নোটেশন সহ গানের লিরিক্স থাকবে, আর কোনটা কার গান এবং কার গাওয়া– তাদের পরিচিতি। যে ক্যাসেট কিনতে চাইবে, তাকে দু’টোই একসঙ্গে দেওয়া হবে। সাটিনের লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গৌতম চেয়েছিল নিজেরাই সবকিছু করতে। প্রতিষ্ঠানের পথে চলার না ছিল সময়, না ছিল ইচ্ছে। এখানে ‘নিজেরা’ মানে যারা গান গাইছে, সঙ্গে আরও দু’-তিনজন অনুরাগী। তারাই মাস্টার কপি নিয়ে চাঁদনি থেকে ক্যাসেট কপি বের করছে। তারাই রাধাবাজার থেকে কাগজ কিনে পোস্টার ছাপাচ্ছে। বই বের হবে। বইয়ের প্রুফ দেখা, ক্যাসেট কভার তৈরি করা, সেগুলো আবার নিজেরাই ঘরে বসে সমান মাপে কাটা আর সেসবের তদারকি– সে একটা সময় গেছে সেই সময়। কত গ্যালন যে চা লেগেছিল– সঙ্গে কত চারমিনার। ক্যাসেটের কভার ও পোস্টার এঁকেছিলেন শিল্পী হিরণ মিত্র– গৌতমের প্রিয় বন্ধু। এই মিনি-বইয়ের সম্পাদনা করেছিলেন সাংবাদিক ও লেখক, গৌতমের ভ্রাতৃসম প্রয়াত দীপঙ্কর চক্রবর্তী।
এভাবেই বইমেলায় এসেছিল ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। কোনও মিউজিক লেবেল নয়, নিজেদের হাতে গড়া ক্যাসেট এবং বই সঙ্গে অপরিসীম উন্মাদনা, নতুন কিছু করার লাগামছাড়া ইচ্ছে। নিজেদের গান, মানুষের গানকে অন্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিশ্বাস। স্টলের ভেতরে ক্যাসেট বিক্রি হচ্ছে, লম্বা লাইন। আর স্টলের বাইরে ময়দানের মাটিতে গোল হয়ে বসে অবিরাম গান চলছে– এই সংকলনের গান, মহীনের পুরনো গান। শুরুর দিন থেকেই সব মিউজিশিয়ান, যারা গৌতমের অনুরাগী, মহীনের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ নিবিড়, সবাই ভিড় করে– সে এক স্বতঃস্ফূর্ত উন্মাদনা।
আর শুধুই কি তারা! নতুন-পুরনো কত শিল্পী এসে অনায়াসে যোগ দিচ্ছে সেই সব গানে। কে যে কার গান গাইছে, কিছুই এসে যায় না। এই গান যে তাদের সবার মনের কথা বলে। এই সব গান যে তাদেরও গান। জ্যোৎস্নার কাশবন মিশে যাচ্ছে ধোঁয়া মেঘের সাথে, বোকাবাক্সর ফন্দি বুঝতে পারছে ডানদিকে-বামদিকে দুই দিকেই থাকা মানুষজন, রাবেয়া বা রুকসানারা ফুল হয়ে ভেসে যাচ্ছে গঙ্গার দু’তীরে বাঁধা স্রোতে। এসব যে সকলের কথা।
’৯৬-তে প্রকাশ হল ‘ঝরা সময়ের গান’। ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ ক্যাসেটের রেশ তখনও সজীব, তার পথ ধরেই অনেক নতুন গান নিয়ে এই ক্যাসেট। ক্যাসেটে যাদের গান ছিল, তারা তো এলই, যাদের ছিল না তারাও এসে যথারীতি ভিড় জমাল স্টলের সামনে। আবার সেই এক উল্লাস। লাগামছাড়া ভালোবাসা। আরও গানের আবদার। কিন্তু তার পরের বছর, ’৯৭-এ, ‘মহীনের ঘোড়া’ সম্পাদিত কোনও নতুন ক্যাসেট মেলাতে এল না। ফলে যে সমস্ত শ্রোতা অপেক্ষায় ছিল নতুন গান শুনবে বলে, হতাশ হয়ে পড়ল। যতদূর মনে পড়ে, এই সময় অবধি বইমেলা এবং ‘এ মুখার্জী’-র কলেজ স্ট্রিটের দোকান ছাড়া অন্য কোথাও এই ক্যাসেট পাওয়া যেত না।
’৯৭-এর বইমেলার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭– তারিখটা মনে আছে এখনও। আমি ও গাবু ট্যাক্সি ধরে পৌঁছে গেছি মেলার সামনে। তখন শুনতে পাচ্ছি বিশাল হইচই, লোক ছুটোছুটি করছে, পুরো এলাকা ধোঁয়াতে ঢাকা। গৌতম বলল, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, আমি থাকছি। পরে জেনেছি প্রায় লক্ষাধিক বই আগুনের গ্রাসে পুড়ে শেষ। তার সঙ্গে শেষ ‘এ মুখার্জী’-র স্টলে রাখা ‘ঝরা সময়ের গান’-এর বুকলেট এবং ক্যাসেট।
পরে অবশ্য সরকার এবং গিল্ডের সহযোগিতায় আবার প্রাণ চঞ্চলতা ফিরে আসে ময়দানের মেলায়। আমরাও যৌথভাবে, সবাই মিলে, গৌতমের সঙ্গে মেলার মাঠে পুরনো মিউজিক্যাল আড্ডায় ফিরে আসি।
এখানে দু’-তিনটে কথা বলা দরকার– তারপর আবার ফিরব বইমেলার গল্পে।
প্রথমত, ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ সবদিক থেকেই ছিল একটি ইন্ডিপেনডেন্ট রিলিজ। গৌতম চাইত প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে কাজ করতে– লাল ফিতের বাঁধন ওর সহ্য হত না। প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করলেও করত নিজের নিয়মে, নিজের শর্তে।
দ্বিতীয়ত, এখানে একটি কথা বলা জরুরি যে, এই ক্যাসেটগুলো কিন্তু ‘মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত’ গান, মানে এই অ্যালবামগুলো নয়ের দশকে গৌতমের নেতৃত্বে একটা কালেক্টিভ। এখানে আছে গৌতমের পোস্ট ‘মহীনের ঘোড়াগুলির গান’, কিছু পুরনো মহীনের ঘোড়াগুলির গান, অরুণেন্দু দাস, সুব্রত ঘোষ, জয়জিৎ লাহিড়ি, দিব্য মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ চ্যাটার্জী, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, কমল চক্রবর্তী, তাপস দাস ও দেবজ্যোতি মিশ্র– এদের সকলের গান। নীল মুখার্জী গিটার বাজিয়েছে আর অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ করেছে প্রথম তিনটে অ্যালবামে।
আবার ফিরে আসি মেলার কথায়।
১৯৯৭-এর মাঝামাঝি সম্পূর্ণ নতুন গান নিয়ে বেরয় ‘মায়া’। ১৯৯৮-এ ‘মায়া’র আবেশে আবার বইমেলা সরগরম। এই সময়ে অবশ্য আগের দুটো ক্যাসেট এবং ‘মায়া’ বাইরেও পাওয়া যেত, কিন্তু তা-ও বইমেলার স্টল থেকে কেনার, আর স্টলের বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে লাইভ গান শোনার মজা একেবারেই অন্য মাপের একটা অভিজ্ঞতা।
১৯৯৯ সালে রিলিজ হয় ‘ক্ষ্যাপার গান’। ওই একই বছরে, ২০ জুন, আমাদের ছেড়ে চলে গেল গৌতম।
আমার মনে হয়, গৌতম ‘মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত’ ক্যাসেটগুলো বের করার কারণেই এই ধরনের গানের ধারা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন শিল্পীরা সাহস পায় বাংলা আধুনিক গান নিয়ে আরও এক্সপেরিমেন্ট করতে– যার রেশ এখনও, প্রায় ৩০ বছর বাদেও অনুভব করা যায়। সেদিক থেকে দেখলে মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গানের ইতিহাসে এটা একটা মাইলস্টোন।
বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্র যে বাঁকে দাঁড়িয়ে, তাতে ভবিষ্যতের সাক্ষী মালিক, মনিকা বাত্রা, লক্ষ্য সেনদের বিকল্প পথের কথা ভাবতে শুরু করতে হবে। কমনওয়েলথ গেমসকে ভুলে অলিম্পিক, এশিয়াডের প্রস্তুতি হিসেবে পাখির চোখ করতে হবে নিজ খেলার আঞ্চলিক, মহাদেশীয় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপগুলোকে।