এই লেখার শিরোনাম, সুপ্রভাত রায়ের। কবি সুপ্রভাত রায়, এমনই এক ব্যর্থ জানুয়ারি মাসে, চলে গিয়েছিল। আজ গাছদাদুর পদ্মশ্রী প্রাপ্তিতে একথা ঘুরেফিরে মনে এল। মনে এল যশোর রোডের গাছ বাঁচাও আন্দোলন, মনে এল ভালোপাহাড়। আইন গাছের বিপক্ষে গিয়েছে বারেবারেই, কিন্তু আমরা কি গাছের পক্ষে? আজ দুখু মাঝির পদ্মশ্রী সম্মানের পর, আমরা কি শুধুই তাঁকে ভালোবাসব? গাছকে না? যদি তা-ই হয়, তবে সে ভালোবাসা অসফল।
পাঠের শুরুতেই আপনাকে বলব, যতিচিহ্ন সহযোগে সম্পূর্ণ বাক্যটিকে চোখ বন্ধ করে ইমাজিন করুন পাশাপাশি ঘনিষ্ঠ দাঁড়িয়ে থাকা সাড়ে চার হাজার গাছকে, যাদের অধিকাংশই শতাব্দী প্রাচীন, এক-একটা গাছকে বেড় দিয়ে ধরতে লাগছে আট-ন’জন, কাটতে লাগছে সপ্তাহ দুয়েক। চোখ বন্ধ করে দেখতে কি পেলেন একটি সুবিশাল অরণ্যকে? এই গাছগুলো আসলে অবস্থিত ৩৫ নং জাতীয় সড়ক অর্থাৎ বারাসাত-বনগাঁর যশোর রোডে! রাস্তা সম্প্রসারণের নামে এই অরণ্য নিধন যজ্ঞ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে, পথে নেমেছিল এ.পি.ডি.আর-সহ আরও নানা সংগঠন। এই গাছগুলোর গায়ে প্রথম সর্বাধিক কুড়ুল পড়েছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাসে, বনগা ১ নং রেলগেটের কাছাকাছি। এপ্রিলের শুরুতেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সার বেঁধে দাঁড়ানো হাত-পা কাটা সেইসব বিশাল বিশাল গাছ দেখে প্রবল কাতর ও ব্যথিত হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় জমায়েতের ডাক দিই ২ এপ্রিল। মুহূর্তে শয়ে শয়ে সে পোস্ট শেয়ার হয়। কিন্তু সেদিন বনগাঁ ১ নং রেলগেটে উপস্থিত হই জনা দশেক, চিপকো আন্দোলনের মতাদর্শে কুড়ুলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ি সে দশজনা, গাছ কাটাকে সাময়িকভাবে আটকে দিই সেদিন, সেসব তথ্য জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফের ডাক দিই, রাহুল নামের একটি ছেলে বনগাঁ থেকে সেই ডাক বিলোতে বিলোতে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায় হাবড়া, আমার বাড়ি! ৯ মার্চ, ২০১৭ তারিখে সংগঠিত হয় একটি ঐতিহাসিক সমাবেশ, পাঁচ শতাধিক মানুষ গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বনগাঁর যশোর রোডে জড়ো হই, পথে নেমে আসেন কবি ও গায়ক পল্লব কীর্তনীয়া, বিভাস রায়চৌধুরীর মতো অসংখ্য ব্যক্তিত্ব। এঁদের পাশাপাশি কলম ধরেন কবীর সুমন, রূপম ইসলাম-সহ অসংখ্য শিল্পী সাহিত্যিক-আমজনতা! গঠিত হয় ‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি’, শৌভিক-অনির্বাণ-অর্পিতা সুরজিৎ-সহ আরও অনেকের নেতৃত্বে চলতে থাকে কমিটির লাগাতার কর্মসূচি, আন্দোলন, লিফলেট বিলি, পাশাপাশি চলতে থাকে আইনি লড়াই। বিগত এক দশক ধরে এখনও চলছে সেই লড়াই, হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট। তবুও তো বাঁচানো যাচ্ছে না হেরিটেজের আওতায় আসা যশোর রোডের গাছগুলো। আইনও যেন এদেশে গাছের পক্ষে নেই!
এটা তো আমার সেই দেশ যেখানে চিপকো আন্দোলনের মানসিকতারা জন্মেছিল, আসামের মাজুলি দ্বীপ গড়ে তোলার নেপথ্যে গাছের ভূমিকার কথা উল্লেখযোগ্য ভাবে উঠে এসেছিল, শ্রীনিকেতন গড়ে ওঠার নেপথ্যেও গাছেদের ভূমিকার কথা জানে, ভালোপাহাড়ের কথা জানে এদেশ…
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
৯ মার্চ, ২০১৭ তারিখে সংগঠিত হয় একটি ঐতিহাসিক সমাবেশ, পাঁচ শতাধিক মানুষ গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে বনগাঁর যশোর রোডে জড়ো হই, পথে নেমে আসেন কবি ও গায়ক পল্লব কীর্তনীয়া, বিভাস রায়চৌধুরীর মতো অসংখ্য ব্যক্তিত্বরা। এদের পাশাপাশি কলম ধরেন কবীর সুমন, রূপম ইসলাম-সহ অসংখ্য শিল্পী সাহিত্যিক-আমজনতা! গঠিত হয় ‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি’, শৌভিক-অনির্বাণ-অর্পিতা সুরজিৎ-সহ আরও অনেকের নেতৃত্বে চলতে থাকে কমিটির লাগাতার কর্মসূচি, আন্দোলন, লিফলেট বিলি, পাশাপাশি চলতে থাকে আইনি লড়াই। বিগত এক দশক ধরে এখনও চলছে সেই লড়াই, হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেই ২০১৭ সালের যশোর রোড গাছ বাঁচাও আন্দোলনের প্রাক্কালে এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় ফোন এসেছিল বৃক্ষনাথ কমল চক্রবর্তীর, ফোনে যশোর রোডের গাছগুলোর খবর নিতে হাপুস নয়নে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ‘জয় বৃক্ষনাথ’। সেই কবি-ঔপন্যাসিক কমল চক্রবর্তী, যিনি পুরুলিয়ার এক সময়ের রুখা-শুখা ন্যাড়া পাহাড়ে দু’লক্ষ অরণ্য সৃজনের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন ‘ভালোপাহাড়’! এটা তো আমার সেই দেশ, যে গত কাল পদ্মশ্রীতে ভূষিত করেছে পুরুলিয়া জেলার বাগমুন্ডি ব্লকের ছিন্দারি গ্রামের ৬০ ঊর্ধ্ব বয়সের দুখু মাঝিকে, যার সাইলের সামনে লেখা থাকে ‘বৃক্ষমানব/ শ্রী দুখু মাঝি/ Presented By. Save Ajodhya Hills Purulia’
যিনি জানেন না, বিশ্ব উষ্ণায়ন কী! মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম তিনটে শর্ত যে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, অর্থাৎ বেঁচে থাকার ১০০% উপাদানই প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে আমরা পাই গাছ থেকে, এতটা গভীর তিনি বোঝেন না। জানেন না, পশ্চিমবঙ্গের বনাঞ্চল মাত্র ১৪%, যেখানে ভারতের গড় ২৩%, আর পৃথিবীতে ৩১ %! পপুলেশন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের সংখ্যা যে বাড়ানো দরকার, পৃথিবীর গভীরতর দুঃখ দূর করতে পারে যে গাছ, তা-ও তিনি জানেন না। এটুকু বোঝেন কেবল, তিনি বড় মানসিক তৃপ্তি পান বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে। তাই তো বড় অভাবের সংসারে থেকেও অদ্যবধি নিজ উদ্যোগে প্রায় দশ হাজার গাছ লাগিয়ে ফেলেছেন গাছদাদু দুখু মাঝি! শুধু তাই নয় তাদের নিয়মিত পরিচর্যায় থেকেছেন নিরন্তর, সন্তান জ্ঞানে বড় করে তুলেছেন! এই মানুষটির পদ্মশ্রী প্রাপ্তি বড় গৌরবের। কিন্তু এই সাপেক্ষে বড় এক প্রশ্ন সামনে আসে, এই পদ্মশ্রী প্রাপ্তিতেই কি বিষয়টি সীমিত থাকবে? এরপরেও আমরা কোনও ভাবে ন্যূনতম সচেতন হব গাছ রক্ষায়? সাময়িক উন্নয়নের স্বার্থ ভুলে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা তৈরির ভাবনায় তৎপর হতে পারব কি?
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।