সম্প্রতি এমনই ‘উপস্থিত বুদ্ধি’-র পরিচয় দিয়েছে ১৩ বছরের কিশোরী নিকিতা। উত্তরপ্রদেশের বস্তি জেলার বাসিন্দা। ১৫ মাসের ভাইঝিকে নিয়ে একটি ঘরে খেলছিল। অন্য ঘরে ছিলেন বাড়ির বড়রা। আচমকাই জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে একপাল বাঁদর। বাড়িতে ঢুকে সব লন্ডভন্ড করতে শুরু করে। ওই কিশোরী তো বটেই, ভয় পেয়ে যান বড়রাও। তার মধ্যেই একটি বাঁদর বারবার বিছানায় শুয়ে থাকা শিশুটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনই ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ প্রয়োগ করে নিকিতা। ঘরের এক কোণে রাখা ছিল অ্যামাজনের ‘অ্যালেক্সা’। সেই যন্ত্রকে নির্দেশ দেয়, কুকুরের ডাকের শব্দ চালাতে। বেজে ওঠে যন্ত্র।
সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে-পড়ে-শিখে এসেছি, ‘বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য নির্বুদ্ধেস্তু কুতো বলম্/ পশ্য সিংহো মদোন্মত্তঃ শশকেন নিপাতিতঃ’। অর্থাৎ, বুদ্ধি যার, বল তার। যার বুদ্ধি নেই বা নির্বোধ, তার শক্তি নেই। দুর্বল খরগোশ বুদ্ধিবলে দুর্জয় শক্তিশালী সিংহকে মেরেছিল। হিতোপদেশ, চাণক্য শ্লোক মুখস্থ করেছি আর খাতায় উগড়ে দিয়েছি।
একটু বড় হওয়ার পর থেকে এই শ্লোকের মর্ম উপলব্ধি হয়েছে হাড়ে হাড়ে, প্রতি পদে। দেখেছি, বুদ্ধিরও অনেক রকমভেদ রয়েছে। যে বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদে কোনও পরিকল্পনা করে কার্যসিদ্ধি হয়, শত্রু দমন হয়, তার বলে কূটবুদ্ধি। আছে সাধারণ বুদ্ধি। যার জোরে ‘বুদ্ধিমান’ মানুষ দ্রুত নিজের ভালো বুঝতে পারে। নিজের লাভ-লোকসান, আখের গোছাতে তা দারুণ সাহায্য করে। নির্বোধ সাধারণ মানুষ আজীবন সাধনা করেও তা করায়ত্ত করতে পারে না। আর আছে উপস্থিত বুদ্ধি। অনেকে ভালো বাংলায় তাকে ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’ও বলে থাকেন। বিপদ থেকে রক্ষা পেতে, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে বুদ্ধির জুড়ি মেলা ভার। ‘কথামালা’-র গল্পে যেমন ভাল্লুক দেখে শ্বাস বন্ধ করে মরার মতো পড়ে থাকার কথা ভাবুন। কারণ, ভাল্লুক মৃত মানুষ স্পর্শ করে না। আমার মতো নির্বোধ হলে এই কথা হয়তো মাথাতেই আসত না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এ যুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংকট, যন্ত্র ও প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বারবারই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, আমরা কি ভবিষ্যতে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব নাকি পরিণত হব প্রযুক্তির ক্রীতদাসে। এই ঘটনা থেকে অনেকেই স্বস্তি পাচ্ছেন যে, এখনও আশা শেষ হয়নি। প্রযুক্তি সর্বদা মানুষের সহায়ক হবে, তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। মানুষই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, নানা ধরনের উদ্ভাবন করছে। নেপথ্যে কাজ করছে মানুষের বুদ্ধি, চিন্তাধারা, মস্তিষ্ক। যন্ত্র কখনও সেই জায়গা নিতে পারবে না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সম্প্রতি এমনই ‘উপস্থিত বুদ্ধি’-র পরিচয় দিয়েছে ১৩ বছরের কিশোরী নিকিতা। উত্তরপ্রদেশের বস্তি জেলার বাসিন্দা। ১৫ মাসের ভাইঝিকে নিয়ে একটি ঘরে খেলছিল। অন্য ঘরে ছিলেন বাড়ির বড়রা। আচমকাই জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে একপাল বাঁদর। বাড়িতে ঢুকে সব লন্ডভন্ড করতে শুরু করে। রান্নাঘরের বাসনপত্রও তছনছ করা হয়। ওই কিশোরী তো বটেই, ভয় পেয়ে যান বড়রাও। তার মধ্যেই একটি বাঁদর বারবার বিছানায় শুয়ে থাকা শিশুটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনই বাঁদর তাড়াতে ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ প্রয়োগ করে নিকিতা। ঘরের এক কোণে রাখা ছিল অ্যামাজনের ‘অ্যালেক্সা’। সেই যন্ত্রকে নির্দেশ দেয়, কুকুরের ডাকের শব্দ চালাতে। বেজে ওঠে যন্ত্র। তাতেই কাজ হয়। হুড়মুড়িয়ে পালায় বাঁদরের দল।
বাঁদর এবং উপস্থিত বুদ্ধির সঙ্গে একটা যোগাযোগ তো আছেই। মনে করে দেখুন ঈশপের সেই টুপিওয়ালার গল্প। যিনি বনের পথে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভেঙে দেখেন, নিজেরটা ছাড়া তাঁর ঝুলিতে কোনও টুপি নেই। সব পরে আছে গাছে থাকা বানরের দল। ‘উপস্থিত বুদ্ধি’ প্রয়োগ করলেন তিনি। বাঁদর অত্যন্ত অনুকরণপ্রিয়। তাই তাদের দিকে ইট ছুড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে বাঁদররাও কিছু ইট ছুড়ল তাঁর দিকে। এবার তিনি তাঁর টুপি ছুড়লেন। পাল্টা বাঁদরগুলিও টুপি ছুড়ে মারল। আর তিনি সব টুপি কুড়িয়ে বাড়ি চলে গেলেন। অর্থাৎ, বুদ্ধি থাকলে বাঁদরামি জব্দ করে কাজ হাসিল করা যায়। যাই হোক, পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে প্রতিবেশী, সকলেই নিকিতার ‘উপস্থিত বুদ্ধি’র প্রশংসা করেছেন। ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। যা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে মাহিন্দ্রা গোষ্ঠীর কর্ণধার আনন্দ মাহিন্দ্রার। পড়াশুনা শেষ করার পর নিকিতাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
কিন্তু গোটা ঘটনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক– স্বস্তি। কীসের স্বস্তি? এ যুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংকট, যন্ত্র ও প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বারবারই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, আমরা কি ভবিষ্যতে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব নাকি পরিণত হব প্রযুক্তির ক্রীতদাসে। এই ঘটনা থেকে অনেকেই স্বস্তি পাচ্ছেন যে, এখনও আশা শেষ হয়নি। প্রযুক্তি সর্বদা মানুষের সহায়ক হবে, তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। মানুষই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে, নানা ধরনের উদ্ভাবন করছে। নেপথ্যে কাজ করছে মানুষের বুদ্ধি, চিন্তাধারা, মস্তিষ্ক। যন্ত্র কখনও সেই জায়গা নিতে পারবে না। যতই উন্নত ধরনের প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসুক না কেন, তাকে চালাবে মানুষই।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: গণধর্ষিতাকে নষ্ট ভাবে যে বিদ্যালয়, সে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা মূল্যহীন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রায় একই কথা বহুদিন আগে বলে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কবি ইউরোপ ভ্রমণে বিজ্ঞানের অগ্রগতি দেখে লিখছেন, ‘বিজ্ঞান যে বিশুদ্ধ তপস্যার প্রবর্তন করেছে তা সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের…।’ কবি জীবদ্দশায় কিন্তু আণবিক বোমা বা অন্য গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র দেখেননি। তা সত্ত্বেও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন যে, ‘এই বিজ্ঞানই কর্মের রূপে যেখানে মানুষের ফল-কামনাকে অতিকায় করে তুললে সেইখানেই সে হল যমের বাহন।’ তাঁর মতে, ‘এই পৃথিবীতে মানুষ যদি একেবারে মরে তবে সে এইজন্যই মরবে, সে সত্যকে জেনেছিল কিন্তু সত্যের ব্যবহার জানেনি। সে দেবতার শক্তি পেয়েছিল দেবত্ব পায়নি।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘যন্ত্রকে থামিয়ে দিয়ে কোনও লাভ হবে না। থামাতে হবে মানুষের লোভ।’ অর্থাৎ প্রয়োজন শুভবুদ্ধির।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: দু’মুঠো অন্ন চিন্তা যখন মিলিয়ে দেয় ফ্রাঁসের ফেরিওয়ালা এবং কলকাতাবাসীকে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছোটবেলায় পড়েছিলাম মোক্ষম এক উক্তি– ‘মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই কৃপার পরে করে দেব মহিমা নির্ভর’। যে মানুষ দেবতা তৈরি করতে পারে, দানব সৃষ্টি তো তারই হাতে। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে তা সমাজ কল্যাণে কাজে লাগাবে নাকি নিজের ধ্বংস ডেকে আনবে, ঠিক করবে মানুষই। প্রযুক্তি শুধুই হাতিয়ার। তার পরিচালনা-নিয়ন্ত্রণ থাকবে মানুষের হাতেই।