দিদি এবার আইআইটি পেয়ে গেলে সব চেয়ে ভালো হয়। ওর ঘরটা পিকু নিয়ে নেবে। নিজের ঘর। যখন খুশি গান শোনা যাবে, গল্পের বই, সিনেমা, ফোন, চ্যাট। পড়াশোনাতেও মন বসবে ঠিকঠাক। দিদির মতো না হলেও ঠিক রেজাল্ট ভালো হবে। এভাবে থাকা যায় না। ঠিকমতো শোয়ারও উপায় নেই! গরমকালে জামা খুলে ফ্যানের তলায় ঘুমলে কী আরাম! বোঝাই যায় না এসি নেই। ক্লাস এইটে প্রায় সবার নিজের ঘর আছে। শুধু রুচি, আয়েশা, তনিমা… কর গোনে পিকু! কিন্তু ওদের সবার বাড়িতেই কি চিৎকার…? ওদের সবার মাকেই কি…?
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বড়দিনের ঠিক আগে কুয়াশা ঢাকা রাতের আকাশে পীরের বাতাস বইছিল। বইতে বইতে অনেক আগেকার কথা মনে পড়ছিল পীরের। মনে পড়ছিল গরিব বাবার তিন মেয়ের কথা, যৌতুকের অর্থ না থাকায় পরদিন যারা হাটে বিক্রি হয়ে যেত। ভাবতে ভাবতে নজর গেল নীচে, অনেক নিচে শুয়ে আছে তিনটে, না না তিনটে নয় তিরিশ, না কি তিনশো মেয়ে– কারও চোখে ঘুম নেই!
ঘর আর বাড়ি এক নয় পিয়া জানে। নতুন কাজের বাড়িতে একটা ছোট ঘর আছে ওর। দেওয়ালে আয়না, তাক, ডিম লাইট, টিভি– দাদা বৌদি খুব ভালো। বসার ঘরে ওরা বই দেখে রাত জেগে। তাই সারা রাত ধরে ফোনে কথা বলা যায় ফিসফিস করে। গরম হয়ে ওঠা ফোনের ওপারে তপনকে বোঝায় ও, দেরি নয় এই বৈশাখেই– স্বামীর ঘর। তপনের বাবা, মা, ভাই আর ওরা দু’জন। ইটের ওপর তুলে দিলে খাটের তলায় রান্না। ফাঁকা হয়ে যাবে এক ফালি বারান্দা– একটু ঢেকে দিলে বাইরে থেকে ওদের চৌকি দেখতেই পাবে না কেউ। সাড়া করে না তপন। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়, সারাদিন ডেলিভারি দেয় তো, ঘুম ভাঙালে কষ্ট হবে, রেগে যাবে খুব। ফোন কাটে না পিয়া, নিজের মনে বলে চলে… ‘ফুল আঁকা খুব সুন্দর বারান্দা ঢাকার প্লাস্টিক পাওয়া যায় আর উইন্ড চাইম যেমন এখানে আছে– টুং টাং করে বাজবে আর আমি জল ধরব, কুটনো কাটব, রান্না করব, বাসন মাজব, তোমার মাকে কিচ্ছু করতে দেবে না…’
দেওয়ালের দিকে আরও একটু সরে যায় পিকু। মায়ের যেন শোয়ার কোনও তাল নেই আর ওপাশে বাবা মটরসাইকেল চালাচ্ছে! অসহ্য! ঠেলা মেরে বলতে ইচ্ছে করে নাক ডাকা বন্ধ করো। কাঁচা ঘুম ভাঙালে তো আবার রাগ! তবু ভালো আজ ঘুমিয়ে পড়েছে দু’জনেই! দিদি এবার আইআইটি পেয়ে গেলে সব চেয়ে ভালো হয়। ওর ঘরটা পিকু নিয়ে নেবে। নিজের ঘর। যখন খুশি গান শোনা যাবে, গল্পের বই, সিনেমা, ফোন, চ্যাট। পড়াশোনাতেও মন বসবে ঠিকঠাক। দিদির মতো না হলেও ঠিক রেজাল্ট ভালো হবে। এভাবে থাকা যায় না। ঠিকমতো শোয়ারও উপায় নেই! গরমকালে জামা খুলে ফ্যানের তলায় ঘুমলে কী আরাম! বোঝাই যায় না এসি নেই। ক্লাস এইটে প্রায় সবার নিজের ঘর আছে। শুধু রুচি, আয়েশা, তনিমা… কর গোনে পিকু! কিন্তু ওদের সবার বাড়িতেই কি চিৎকার…? ওদের সবার মাকেই কি…? রোদে শোকানো বালিশের ওয়াড় একটু একটু করে ভিজে গেলে সোঁদা গন্ধ ওঠে… খুব সন্তর্পণে মায়ের পেটের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দেয় পিকু।
………………………………………………
পাঁচ বছরের একটা অ্যাবিউসিভ রিলেশন– ফ্ল্যাটটা না পেলে হয়তো বেরনো সহজ হত না। এবার প্রোমোশন। আর সবচেয়ে এক্সাইটিং হল নিজের ঘর– নিজের স্পেস কারও সঙ্গে শেয়ার করতে হবে না আর। থেকে থেকে ডিসগাসটিং জোকস, ঘাড়ের ওপর থেকে স্ক্রিন দেখার চেষ্টা, দেঁতো হাসি, দম আটকানো বডি ওডার! নিজের ঘরে একটা ফ্রন্ট কভার্ড ডেস্ক নিতে হবে। নাহলে স্কার্ট পরে বসলে সবাই নিচের দিকে দেখতে থাকে, এমনকী মিসেস খান্নাও!
……………………………………………….
মিস ক্যারেজের এক মাস এক্সট্রা ছুটি আর বসের প্রতি নিলয়ের নিরন্তর সাইকোফ্যান্সি– গতবছর প্রোমোশনটা মিস হয়েছে। এবছর শিওর সিনিওর এইচআর ম্যানেজার। শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিল প্রেরণা। পঁচিশ তলার ওপরের আকাশ অন্য রকম। হাত বাড়ালেই চাঁদ, তারা, মেঘ যেন ব্যালকনিতে নেমে আসে, বৃষ্টি যেন ওর নিজের। জানলার পাশেই পড়ার টেবিল– তুলি, ক্যানভাস, ইজেল– এই ফ্ল্যাটটা পাওয়ার পর থেকেই অনেকটা সর্টেড লাগে। একা থাকার অভ্যেসও তো চলে গেছিল। পাঁচ বছরের একটা অ্যাবিউসিভ রিলেশন– ফ্ল্যাটটা না পেলে হয়তো বেরনো সহজ হত না। এবার প্রোমোশন। আর সবচেয়ে এক্সাইটিং হল নিজের ঘর– নিজের স্পেস কারও সঙ্গে শেয়ার করতে হবে না আর। থেকে থেকে ডিসগাসটিং জোকস, ঘাড়ের ওপর থেকে স্ক্রিন দেখার চেষ্টা, দেঁতো হাসি, দম আটকানো বডি ওডার! নিজের ঘরে একটা ফ্রন্ট কভার্ড ডেস্ক নিতে হবে। নাহলে স্কার্ট পরে বসলে সবাই নিচের দিকে দেখতে থাকে, এমনকী মিসেস খান্নাও!
আজ ক্লায়েন্টটা যেতে প্রায় রাত কাবার করে দিল না হলে কারও ভি রুমে পিঙ্কি রাত কাটায় না। কাজ করতে এসে কান্নাকাটি করলে এমনিতেই শালা মটকা গরম হয়ে যায়। বলে কিনা বৌদি বৌদি ভালোবাসি ভালোবাসি। ক্যালানে কাত্তিক আমার, আইবুড়ো মেয়ে দেখে বুঝতে পারিস না? দাঁত চিবিয়ে বিড়বিড় করে পিঙ্কি। মেঝেয় রুকশানা ঘুমোচ্ছে। এটা ওরই রুম। মাসির রুমে একটা চৌকি আছে পিঙ্কির, শুধু ঘুমতে যায় সেখানে। এত ছোট চৌকিতে ভালো কাজ হয় না। যে রুম ফাঁকা থাকে, সেখানেই ঢুকে যেতে হয়। মাসি বলেছে চার-পাঁচটা বাঁধা ক্লায়েন্ট হলে পিঙ্কিরও নিজের ঘর হবে। একটা জানলা থাকলে মানি প্লান্ট তুলে দেবে গ্রিলের গায়ে। গোপালকে নিয়ে আসবে দেশ থেকে ছোট্ট একটা আসন বসাবে, পেটের ছেলের মতো খাওয়াবে, শোয়াবে নিত্যদিন। হালকা গোলাপি রং করাবে দেওয়ালে, বাবার ছবিটা টানিয়ে মালা দেবে রোজ। নিজের মনেই হেসে ওঠে এবার– ‘কাজের ঘরে বাবার ছবি… হি হি!’ বাপ বেঁচে থাকলেও শালা কিচ্ছু বদলাত না। আর এনজিও দিদিরা তো বলেছে– এটা একটা কাজ! গতর খাটিয়ে খাই আমরা, একটা ঘর না হলে চলে?
ক্রিস্টমাস ইভ, হুইস্কি, অরিত্র নাক ডাকছিল খুব। একটা রহস্য গল্পের কথা ভাবছিল পিয়ালি ‘‘The Murder of Santa Clause– “Merry Christmas, Mickledore! Go to bed and sleep no more…” বাপের বাড়িতে ওর নিজের ঘর আর বইয়ের আলমারিটার কথা ভাবছিল। সেসব এখানে আর নিয়েই আসা হল না। অরিত্র ইঞ্জিনিয়ার, সাহিত্য পড়ে, কিন্তু শুধুই বাংলা। বাংলা মিডিয়ামের কৃতি ছাত্রর ইংরেজির প্রতি কিঞ্চিৎ অনীহা, স্ত্রীর চর্চার প্রতি হয়তো আরও একটু বেশি। পিয়ালি ভাবে, কী স্বাভাবিক ভাবে নিজের পছন্দ-অপছন্দের কথা বলতে পারে অরিত্র– ক্লান্ত হতে পারে, রাগ করতে পারে, আরাম করতে পারে, কথা শুরু করে থামিয়েও দিতে পারে। তবে পিয়ালির কাছ থেকে সবসময় একটা ন্যাকা মতো হাসি খুশি মুড আশা করে কেন? একা একা সারাদিন সাজিয়ে রাখা আসবাবগুলোর সঙ্গে থাকে বলে কি ওকেও একটা শোপিস ভাবে? কিছু হলেই বলে ‘আবার কী হল? বসে বসে করো কি সারাদিন?’ কান্না পায়, চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। নিজের একটা ঘর থাকলে অন্য রকম হত জীবন?
যে সংসারে নায়িকা ছিলেন, আজ সেখানেই ক্যামিও অ্যাপিয়ারেন্স! হাসি পায়। জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর মধ্যমণি। ঠিকই আছে, এমনই তো হয়! তবু শেষের দিনগুলো এমন বন্ধনে কাটাতে চান না প্রকৃতি। ঘুম আসতে চায় না। শুয়ে শুয়ে হিসেব করেন– এখন চুয়াত্তর, মেরে কেটে আর দশ বছরও যদি চলশক্তি থাকে ঢাকুরিয়ার দু’-কামরার ফ্লাটটা না হলে বৃদ্ধাবাসের একটা ঘর। অনেকদিন হল এখানে মন টেকে না। ছেলে-মেয়েরা হেসে উড়িয়ে দেয়। ‘কী অসুবিধে হচ্ছে বলো’! এতদিন সবার জন্য করার পর একটা নিজস্ব স্পেস যে চাওয়া যায়, তাঁর অতিশিক্ষিত সন্তানরা সেটা বুঝতে চাইবে না! সত্যি, নিজেকেই চেনা হল না এখনও– কিছু কথা, সারা জীবনের কিছু প্রশ্ন, কিছু মানুষের সঙ্গ, কয়েকটা একাকী ভ্রমণ বাকি রয়ে গেছে। নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে, একবার বুক ভরা নিশ্বাসের মতো বুঝে নিতে চান এ বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে তাঁর স্থান। সেটা বোঝার জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে যে! প্রকৃতি জানেন তাঁর বয়সোচিত ঈশ্বর-প্রেম বা অল্প বয়সে ফেলে আসা কবিত্ব– কোনওটা দিয়েই নিজের মনের অবস্থা বোঝানো সম্ভব নয়। কী যে করেন এখন!
আর ধৈর্য রাখতে পারে না পীর। বোকা মেয়েগুলো সারাক্ষণ ঘর ঘর করে চলেছে! আরে মোজা দিয়ে কি কখনও ঘর গলিয়ে দেওয়া যায়! আর কিছু চাওয়ার নেই তোদের? তাছাড়া নিজের বলে কি কিছু হয়? কখনও সম্ভব? অপরের সাপেক্ষেই তো নিজের! আশপাশে কেউ না থাকলে, আমার আমার বলে চ্যাঁচাতে পারতিস? কিছুক্ষণ থমকে যায় হাওয়া। পীর বোঝে, যুক্তিটা দাঁড়াচ্ছে না। যার নিজের বলতে কিছু নেই, তাকে কি বলা যায় এ কথা? যার ঘর আছে আর যার নেই– সবই কি সমান হল? ঘর পেলেই সব পাওয়া হবে এদের? এ কি শুধু তাদের একা থাকার ঘর নাকি সবার সঙ্গে সমান মর্যাদায় বেঁচে থাকার ইচ্ছে? ঘরের নীচে মাটির জমিন নাকি শূন্যে ভাসমান অলীক স্বপ্ন কোনও? কী চায় মেয়েগুলো? না পাওয়ার ঘরে জমে ওঠা না-বলা কথার ভারে ঝাপসা হয়ে যায় সব, আর কিছু বুঝতে পারে না পীর। তবে কি তার ছুটি হল এতদিনে? মেয়েগুলো কি মেরে দিল তার জাদু?