এই বছর সংবিধান গৃহীত হওয়ার পঁচাত্তর বছর। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বলেছিল যদি ৪০০ আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে, তাহলে তারা সংবিধান বদল করে ‘মনুস্মৃতি’ লাগু করবে। সেই তালিকায় ছিলেন কর্ণাটকের বিজেপি সাংসদ অনন্ত হেগড়ে-সহ আরও বেশ কিছু নেতা। তখনকার মতো সেই সমস্ত নেতাদের সতর্ক করা হলেও তাঁদের অন্তরে যে বাবাসাহেব প্রণীত সংবিধান নেই, মনুস্মৃতি আছে তা সেদিন যেমন বোঝা গিয়েছিল, আজ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আবার বোঝা গেছে। যতই অমিত শাহ বলার চেষ্টা করুন এটা তাঁর পুরো বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ, কিন্তু বোঝা যায় যে, বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের বাস্তুতন্ত্র মনুস্মৃতিতেই ভরসা করে।
আম্বেদকর নিয়ে রীতিমতো প্যাঁচে পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপি। রাজ্যসভায় সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্কে বলতে উঠে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মধ্যে এমন তীর্যকভাবে বাবাসাহেব আম্বেদকরের নাম নিয়েছেন যে, তার জেরে সমস্ত বিরোধী দল এক হয়ে গেছে। যে বিরোধীরা, আদানি প্রশ্নেও ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না, ইভিএম প্রশ্নেও কিন্তু কিন্তু ভাব ছিল, সেই বিরোধীরা এক হয়ে সংসদে এবং সংসদের বাইরে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে সাংবাদিক সম্মেলন করে, অমিত শাহ যাতে সর্বসমক্ষে ক্ষমা চান, সেই দাবি তুলেছেন। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে টুইট করে বলেছেন, বিজেপি এবং অমিত শাহের দলিত প্রেমী মুখোশ খসে পড়েছে। পুরো বিষয়টাতে বিজেপির অবস্থা বেশ নাজেহাল দেখালেও, তাঁরা জোরের সঙ্গে বলছে, অমিত শাহের বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ বিরোধীরা দেখিয়ে দেশে অচলাবস্থা তৈরি করতে চাইছে। অমিত শাহ নিজে এই বিষয়ে শুধু সাংবাদিক সম্মেলন করেই খান্ত দেননি, সমস্ত বিরোধী দলনেতা, যাঁরা তাঁর ওই ভাইরাল হওয়া অংশটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন, তাঁদের কাছে টুইটারের তরফ থেকে নোটিশ অবধি পাঠানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, বিজেপি এবং অমিত শাহ বেশ বেকায়দায় পড়েছে।
এই বছর সংবিধান গৃহীত হওয়ার পঁচাত্তর বছর। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘অব কি বার চারশো পার’, অর্থাৎ লোকসভায় তাঁরা ৪০০ আসন পেতে চলেছেন। সেই সময়ে বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের পক্ষ থেকে বারংবার বলা হচ্ছিল যে, বিজেপি যদি ৪০০ আসন পেয়ে ক্ষমতায় আসে, তাহলে তাঁরা সংবিধান বদল করে, তার জায়গায় সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শ মেনে চলা ‘মনুস্মৃতি’ লাগু করবেন। সেই অভিযোগের পক্ষে বিরোধী জোটের যথেষ্ট যুক্তি ছিল, কারণ বেশ কিছু বিজেপি সাংসদ বিভিন্ন বক্তব্যে এই কথাটাই বলছিলেন যে, তাঁরা যদি ৪০০ আসন পান, তাহলে তাঁরা সংবিধান বদল করবেন। সেই তালিকায় ছিলেন কর্ণাটকের বিজেপি সাংসদ অনন্ত হেগড়ে-সহ আরও বেশ কিছু নেতা।
তখনকার মতো সেই সমস্ত নেতাদের সতর্ক করা হলেও তাঁদের অন্তরে যে বাবাসাহেব প্রণীত সংবিধান নেই, মনুস্মৃতি আছে তা সেদিন যেমন বোঝা গিয়েছিল, আজ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আবার বোঝা গেছে। যতই অমিত শাহ বলার চেষ্টা করুন এটা তাঁর পুরো বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ, কিন্তু সেই অংশ শুনলেই বোঝা যায় যে, বিজেপি-আরএসএস এবং তাদের বাস্তুতন্ত্র মনুস্মৃতিতেই ভরসা করে। যখন অমিত শাহ বলেন, এতবার আম্বেদকরের নাম জপার চেয়ে, ভগবানের নাম জপলে, স্বর্গলাভ হত, তখন যে তা অন্তর থেকেই বলেছেন তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। স্বর্গ আর নরকের যে ধারণা মনুস্মৃতিতে আছে, তার সঙ্গে অমিত শাহের ধারণা যে পুরোপুরি মিলে যায়, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। মনুস্মৃতিতে আছে, হিন্দুদের চারটি বর্ণে ভাগ করার কথা। শুধু ভাগ নয়, তাঁদের কিছু অবস্থানের কথাও বলা আছে, মনুস্মৃতির ছত্রে ছত্রে। সাবর্ণদের সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি এবং শূদ্রদের জন্য শাস্তির বিধানও দেওয়া আছে। মনু লিখেছেন, ব্রহ্মা নাকি তাঁর মুখ থেকে ব্রাহ্মণদের, কাঁধ থেকে ক্ষত্রিয়দের, জঙ্ঘা থেকে বৈশ্যদের এবং পা থেকে শূদ্রদের সৃষ্টি করেছিলেন। (মনুসংহিতা ১- ৩১) সুতরাং শূদ্র কিংবা দলিতদের অবস্থান কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। শূদ্রদের নাকি কাজ উচ্চবর্ণের মানুষদের সেবা করা। সেই অনুযায়ী তাঁদের পদবিও নির্ধারিত হবে, তাও বলা আছে। (মনুসংহিতা ১-৯১) তাতে যদি উচ্চবর্ণের মানুষ সন্তুষ্ট না হন, তাহলে তাঁদের স্থান হবে নরকে। ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য উচ্চ বর্ণীয়রা বংশ পরম্পরায় স্বর্গেই যাবেন।
……………………………………….
পড়ুন অন্য লেখাও: বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে ক্ষমা-সহ ক্ষতিপূরণ কি সত্যিই সম্ভব হবে?
………………………………………..
আম্বেদকর সংবিধান রচনার সময়ে এই কথাগুলো মাথায় রেখেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতবর্ষে এমন একটা সংবিধান থাকুক, যার মধ্যে এই বর্ণবিভেদ থাকবে না। তাঁর রচিত সংবিধান সেই জন্যই আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের না পসন্দ। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে, সঙ্ঘ পরিবার ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা যেমন মেনে নেয়নি, তেমনিই তাঁরা সংবিধানকেও মেনে নেয়নি। তাঁদের যুক্তি ছিল, আম্বেদকর বিদেশে পড়াশোনা করে এসে, বিদেশি ধারণাতে অনুপ্রাণিত হয়ে এই সংবিধানের খসরা প্রস্তাব করেছিলেন। এই সংবিধানের মধ্যে কোনও ‘হিন্দু’ সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নেই। সেই দিন থেকেই আম্বেদকর জানতেন, যে তাঁর রচিত সংবিধান নিয়ে নানান সমস্যা হতে পারে। সেই জন্যেই তিনি লিখেছিলেন, সংবিধান ভালো খারাপ তা বিচার্য নয়, কারা সেই সংবিধান নিয়ে কাজ করছেন, তার ওপর নির্ভর করে, সংবিধানের ভালো খারাপ। অনেক সময়ে একটি ভালো সংবিধানও খারাপ হয়ে যেতে পারে, আবার উল্টোটাও হতে পারে এবং তা ব্যবহারকারীর ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে।
অমিত শাহ, শুধু বিরোধীদের আক্রমণ করেছেন এমনটা নয়, তিনি সংবিধানের প্রণেতা আম্বেদকরের অবমাননা করেছেন। যে মানুষটি এই দেশের প্রতিটি শিশুর জন্য, সমানতা, স্বাধীনতা এবং সৌভাতৃত্বের কথা বলেছেন, সেই মানুষটার অপমান মানে দেশের প্রতিটি মানুষের অপমান। প্রতিটি মানুষের যে সমান সম্মান প্রাপ্য এবং সমানাধিকার প্রাপ্য, তা প্রথম আম্বেদকর তাঁর সাংবিধানিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন। মনুষ্য সমাজে কাজের ভিত্তিতে কোনও বিভাজন থাকতে পারে না, সেটাই আম্বেদকরের লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে। আসলে তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়, কেন অমিত শাহের কিংবা সঙ্ঘ পরিবারের আম্বেদকর নিয়ে সমস্যা।
“It is your claim to equality which hurts them. They want to maintain the status quo. If you continue to accept your lowly status, they will allow you to live in peace. The moment you start to raise your level, the conflict starts”
যতই রামনাথ কোভিন্দের মতো দলিত মানুষকে, বা দ্রৌপদী মুর্মুর মতো আদিবাসী মহিলাকে রাষ্ট্রপতি বানাক বিজেপি, তাঁরা যে আসলে দলিত এবং আদিবাসী বিরোধী, তা রোজ বোঝা যায়, নাহলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন দলিতদের ওপর আজও আক্রমণ হয়। কেন দলিত শিশুর মুখে প্রস্রাব করতে দেখা যায়, বিজেপির উচ্চবর্ণের নেতাদের। কেন ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে চাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মারা হয়, দলিত যুবককে। সেই মানসিকতা থেকেই, আম্বেদকরের মূর্তি ভাঙে সঙ্ঘ পরিবারের মানুষজন। ভারত হয়তো স্বাধীন হয়েছে আজ অনেক বছর হয়ে গেছে, ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার আজকে পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও, ভারতে সংবিধান যে সঙ্ঘ পরিবার বিশ্বাস করে না, তা অমিত শাহের বক্তব্য আবার বুঝিয়ে দিল।
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।