২০২৫ সালে অনুবাদ সাহিত্য হিসেবে ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর বুকার প্রাপ্তি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই বইকে কেবল সাহিত্যগুণ দিয়ে বিচার করলে হবে না, বানু মুশতাকের লেখা কর্নাটকের মধ্যবিত্ত, আধা-মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দলিত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব– নানা স্তরের মুসলিম সমাজের দলিল। যুগ যুগ ধরে, ধর্মকে অস্ত্র করে সমাজের পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নারীর অধিকার খর্ব করা, সীমাবদ্ধ করার যে চর্চা– সেই চর্চা লিপিবদ্ধ করে। নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, তার শরীরের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে কেবলমাত্র প্রজননে ব্যবহার করা, পুরুষের বহু বিবাহে প্রাক্তন স্ত্রীর অধিকার খর্ব হওয়া, একের পর এক সন্তানের জন্ম দেওয়া নারীর ক্লান্তি এবং পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন, অল্প বয়সে বিধবা হওয়া নারীকে মূল জীবনে ফিরতে না দেওয়া, বাড়ির বড় মেয়েদের শৈশব কেড়ে নেওয়া, নারীকে বাড়ির ভৃত্য হিসেবে দেখা, যা আসলে ফ্রি লেবর এবং সব দায়িত্ব তার ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া– এই সব কিছু বানু মুশতাক লিপিবদ্ধ করেছেন।
আমাদের দেখার চোখ বদলে দেবে, কিংবা দেখার নতুন চোখ তৈরি করবে বানু মুশতাকের (Banu Mushtaq) সাম্প্রতিক বই ‘হার্ট ল্যাম্প’। এই কথাটাই প্রথম মনে হল এই বই পড়ার পর। কারণ এই বই শুধু পড়ার জন্য নয়, এই বই ‘মুখোমুখি বসিবার’। একজন হিন্দু মধ্যবিত্ত, তথাকথিত প্রিভিলেজড পরিবারে বড় হয়ে ওঠা নারী হিসেবে যখন এই বই আমি পড়ছি, যে লেন্স দিয়ে আমি দেখছি বানুর পৃথিবীকে– সেই পৃথিবী ধর্ম, সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক, ভাষাগত দিক থেকে যতই পৃথক হোক না কেন আসলে গভীরে খুব ‘আলাদা’ নয়। আলাদা নয় বলেই বইটি নিয়ে লিখতে বসার তাগিদ তৈরি হল।
বিভিন্ন নারীর লড়াই করে বেঁচে থাকার, সার্ভাইভালের কথা বলছে এক নারী। দেশের অন্য এক প্রান্তে বসে সেই কথা পড়ছি যে আমি– সে-ও এক নারী। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসে পড়ছে আরও হাজার হাজার মেয়ে। আমি এখানে শুধু মেয়েদের কথা লিখলাম এই কারণে, গোটা পৃথিবীর মেয়েরা আমরা একসূত্রে বেঁধে বেঁধে আছি, আমাদের অজান্তে। কিংবা আমরা প্রত্যেকে হয়তো জানি। এই যোগসূত্র কী? আমি অনেক দিন পর্যন্ত জানতাম সেটা বোধহয় যন্ত্রণা। সে তো আছেই, কিন্তু যত বয়স বাড়ছে, অভিজ্ঞতা বাড়ছে বুঝতে পারছি, যন্ত্রণার চেয়েও বড় হল যন্ত্রণা প্রতিরোধ করার ইচ্ছে। এবং সেই ইচ্ছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরও অনেক অনেক সমব্যথী মেয়ে। একে-অপরের হাত ধরে আছে। আর এই অগুনতি হাতের মালা পাশের বাড়ি, পাড়া, রাজ্য, দেশ ছাড়িয়ে কতদূর কত রকমভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে, তা প্রতিদিন নতুনভাবে আবিষ্কার করি, বিশ্বাস করি।
বানু মুশতাকের এই বই, যা কন্নড় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাসতি, সেই প্রতিরোধের কথা আবার মনে করিয়ে দিল। ১২টি গল্পগুচ্ছ সমৃদ্ধ এই বই একেবারে প্রথম থেকেই গলার স্বর উঁচু করে নারীর শোষণের কাহিনি তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান একেবারে পরিষ্কার করে দেয়। ‘স্টোন স্ল্যাব ফর সহিস্তা মহল’ গল্পে যেমন নিজের বরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে জিনাত প্রথমেই স্পষ্ট করে বলে, ‘প্রভু-ভৃত্যের ভূমিকা আমি এখানে প্রতিষ্ঠা করতে চাই না … স্বামী বললে মনে হয় খুব উঁচু আসনে বসিয়েছি, সেটা একেবারেই চাই না।’ ধর্মকে হাতিয়ার করে পুরুষের শোষণকে ব্যঙ্গ করে জিনাত বলছে, ‘আল্লাহকে বাদ দিলে এই মর্তে আমাদের স্বামীরাই হলেন আমাদের ভগবান। তুমি যে ধর্মেই বিরাজ করো, স্ত্রী হল স্বামীর সবচেয়ে বাধ্য ভৃত্য, তার bonded labour– এটাই গৃহীত হয়ে এসেছে এতদিন।’
এই একই স্পর্ধায় শেষ গল্পে সরাসরি ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আমি আর ধৈর্যের মানে জানি না। তোমাকে যদি আবার পৃথিবী গড়তে হয়, নারী পুরুষ যদি গড়তেই হয়, তাহলে অপটু মৃৎশিল্পীর মতো কাজ কোরো না। এই পৃথিবীতে একবার নারী হয়ে জন্মে দেখাও তো প্রভু। বি আ ওমেন ওয়ান্স, ওহ লর্ড।’ একবার নারী হয়ে দেখাও হে– এই চ্যালেঞ্জ ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায়, ভাষার ঊর্ধ্বে গিয়ে এই পৃথিবীর সমস্ত নারী ছুড়ে দিতে চায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দিকে। হলফ করে বলতে পারি, প্রতিটি নারীর হৃদয়-পিদিমে এই বার্তা ধিকিধিকি জ্বলছে। সেই আগুন এক মেয়ের হাত ধরে অন্য মেয়ের হৃদয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ঠিক যেমন ‘ব্ল্যাক কোবরা’ গল্পে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পড়াশোনা করার সুযোগ না পাওয়া আশরাফের পরপর কন্যাসন্তান হলে তার বর তাঁকে ছেড়ে অন্য বিয়েতে উদ্যত হলে, তাঁকে জুলেখা বেগম (আশারফ এই বাড়ির গৃহকর্মী) বলে– ‘পণ্ডিতরা কেন মহিলাদের পড়াশোনা করতে দেয় না জানো? কারণ তারা নারীকে গণ্ডিবদ্ধ করতে চায় … ইসলাম ধর্মে নারীর এইসব অধিকারের কথা বলা আছে। মেয়েরা স্কুলে যেতে পারে, দোকানে যেতে পারে, কাজে যেতে পারে … তোমাকে যদি এইসব সে না দেয়, কলার চেপে ধরো সবার সামনে। Do not beg, demand justice…।’ বানু মনে করিয়ে দেন, মিনমিনে গলায় ভিক্ষা নয়, নারীকে দৃপ্ত কণ্ঠে দাবি করতে হবে তার সম্মান, তার অধিকার।
…………………………..
‘স্টোন স্ল্যাব ফর সহিস্তা মহল’ গল্পে, সহিস্তার পাশে জিনাত এবং তার বড় মেয়ে আসিফা। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মেহেরুনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তার বড় মেয়ে সালমা। সে বলে, ‘তুমি আব্বার জন্য মরতে চাইছ, আমাদের জন্য কি বাঁচতে পারো না?’ সেই স্পর্শ বদলে দেয় মেহেরুনকে, তাঁকে জীবনমুখী করে তোলে। নিজের মেয়ে সালমাকে তার বন্ধু মনে হয়, ‘সি ওয়াজ কমফোর্টেড, টাচড অ্যান্ড অ্যান্ডারস্টুড বাই আ ফ্রেন্ড’। সিস্টারহুডের এমন উদযাপন এই বইয়ের অন্যতম অন্তরশক্তি।
…………………………..
এই বইয়ের নানা গল্প জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এই ডিমান্ড এবং একই সঙ্গে জুলেখা বেগমের মতো সহযোদ্ধা ও সলিডারিটির নিদর্শন। আশরফের পাশে দাঁড়ায় জুলেখা এবং তারপর একে একে হানিফা চিকাম্মা, রাফিয়া, নাসিমা, জামিলা, আমিনারা। ‘স্টোন স্ল্যাব ফর সহিস্তা মহল’ গল্পে, সহিস্তার পাশে জিনাত এবং তার বড় মেয়ে আসিফা। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পে আত্মহত্যা করতে যাওয়া মেহেরুনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তার বড় মেয়ে সালমা। সে বলে, ‘তুমি আব্বার জন্য মরতে চাইছ, আমাদের জন্য কি বাঁচতে পারো না?’ সেই স্পর্শ বদলে দেয় মেহেরুনকে, তাঁকে জীবনমুখী করে তোলে। নিজের মেয়ে সালমাকে তার বন্ধু মনে হয়, ‘সি ওয়াজ কমফোর্টেড, টাচড অ্যান্ড অ্যান্ডারস্টুড বাই আ ফ্রেন্ড’। সিস্টারহুডের এমন উদযাপন এই বইয়ের অন্যতম অন্তরশক্তি। আর ঠিক যেমন দীপা ভাসতি সমব্যথী হয়ে এই বইয়ের অনুবাদ করেছেন। ঠিক যেন বন্ধুর চিঠি খুব মন দিয়ে পরম যত্নে বহু প্রচলিত কলোনাইজারের, ঔপনিবেশিক ভাষায় অনুবাদ করা; যাতে আরও আরও বন্ধুদের কাছে বানুর মনের সব কথা, সেইসব আঞ্চলিক মেয়ের কথা, একেবারে হুবহু পৌঁছে দেওয়া যায়। এবং মুশতাক বানুর দীর্ঘ ৩০ বছরের লেখা থেকে বাছাই করে এই অনুবাদ গল্পগুচ্ছ তৈরি করেছেন দীপা।
২০২৫ সালে অনুবাদ সাহিত্য হিসেবে ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর বুকার প্রাপ্তি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই বইকে কেবল ঝরঝরে পাঠ্যরূপ দিয়ে বিচার করলে হবে না, বানু মুশতাকের লেখা কর্নাটকের মধ্যবিত্ত, আধা-মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, দলিত, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব– নানা স্তরের মুসলিম সমাজের দলিল। যুগ যুগ ধরে, ধর্মকে অস্ত্র করে সমাজের পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নারীর অধিকার খর্ব করা, সীমাবদ্ধ করার যে চর্চা– সেই চর্চা লিপিবদ্ধ করে। নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা, তার শরীরের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে কেবলমাত্র প্রজননে ব্যবহার করা, পুরুষের বহুবিবাহে প্রাক্তন স্ত্রীর অধিকার খর্ব হওয়া, একের পর এক সন্তানের জন্ম দেওয়া নারীর ক্লান্তি এবং পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন, অল্প বয়সে বিধবা হওয়া নারীকে মূল জীবনে ফিরতে না দেওয়া, বাড়ির বড় মেয়েদের শৈশব কেড়ে নেওয়া, নারীকে বাড়ির ভৃত্য হিসেবে দেখা, যা আসলে ফ্রি লেবর এবং সব দায়িত্ব তার ওপরেই চাপিয়ে দেওয়া– এই সব কিছু বানু মুশতাক লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু ‘হার্ট ল্যাম্প’ পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় না এই নিপীড়িত মেয়েরা দুর্বল! পুরুষের অত্যাচার সইতে সইতে তারা শক্তিশালী হয়ে উঠছে এমন নয়, তারা এমনিতেই শক্তিশালী। তাদের নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত, তাদের নতুন করে ঠিক-ভুল-প্রতারণা-শোষণের চেহারা চেনানোর প্রয়োজন নেই। এরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে পুরুষতন্ত্রের প্রাচীরে ধাক্কা মারছে। কেউ একাই পেরে যাচ্ছে, কাউকে অন্যরা সাহায্য করছে। কিন্তু সকলেই নিজেদের মতো করে সাম্য ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে শামিল। আপাতদৃষ্টিতে তারা একপ্রকার বাধ্য হলেও ভিন্নমত পোষণ করে, ‘হ্যাঁ তাই তো’ বলে মেনে নিলেও তাদের প্রতিবাদী স্বর শোনা যায়, গার্হস্থ্য জীবনে একনিষ্ঠ হয়েও এই জীবনের সমালোচক তারা।
……………………………………………
তিনি যে কেবল ফ্যাসিস্ট মুসলিম সমাজে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, এমন নয়, বানু তাদের অবস্থানও রিক্লেম করছিলেন। এ-ও এক অদ্ভুত সমাপতন, যে পত্রিকার সাময়িক এডিটর ছিলেন গৌরী লঙ্কেশ সেই ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’-তে কাজ শুরু করেছিলেন বানু, সে সময় গৌরী লঙ্কেশের বাবা পি. লঙ্কেশের অধীনে ছিল এই পত্রিকা।
……………………………………………
মুসলিম সমাজের প্রেক্ষিতে এই বই লেখা হলেও কোনও এক নির্দিষ্ট ধর্ম বা ভৌগোলিক অবস্থানে এই বইকে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। নারীর জন্ম এবং এই পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, পিতৃতান্ত্রিক, ধর্মান্ধ পৃথিবীতে তার যাপন এক অর্থে বিপ্লব। আরব দেশের কবি এবং জেন্ডার রিসার্চার ফরিদা. ডি লিখেছেন, ‘As a women loving yourself is rebellion; loving other women too, is revolution.’ বানু মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’ সেই প্রতিরোধের কথা বলে, সেই সহমর্মিতার কথা বলে, সেই সিস্টারহুডের কথা বলে, সেই রেবেলিয়নের কথা বলে।
বানু মুশতাক নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও সেই চর্চা করে এসেছেন। সাংবাদিকতা দিয়ে কাজ শুরু করে তিনি একইসঙ্গে আইনজীবী এবং সমাজকর্মীও, আর তারই সঙ্গে চলেছে তাঁর লেখালেখি। আর তিনি যখন কলম ধরলেন, তাঁর দেশ তাঁর মাটির মেয়েদের কথাই লেখার বিষয় হয়ে উঠল। তিনি যে কেবল ফ্যাসিস্ট মুসলিম সমাজে নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন, এমন নয়, বানু তাদের অবস্থানও রিক্লেম করছিলেন। এ-ও এক অদ্ভুত সমাপতন, যে পত্রিকার সাময়িক এডিটর ছিলেন গৌরী লঙ্কেশ সেই ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’-তে কাজ শুরু করেছিলেন বানু, সে সময় গৌরী লঙ্কেশের বাবা পি. লঙ্কেশের অধীনে ছিল এই পত্রিকা।
বানু বরাবরই নানা সমাজ সংস্কারমূলক কাজে নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন। তার কলমকে তিনি নারীবাদী স্বর হিসেবে তুলে ধরেছেন। কখনও সেই স্বর খুব জোরালো, কখনও মৃদু , কখনও ব্যঙ্গাত্মক, কখনও হাস্যরসাত্মক, কখনও আবার দাউদাউ করে জ্বলে ওঠা। কিন্তু তাঁর কলমে মেয়েদের হৃদয়-প্রদীপ নেভে না কখনওই।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………………