ভোটপ্রচারে চিরাচরিত প্রথা– দলের প্রতীক-নাম সম্বলিত পুস্তিকা, ইস্তেহার পৌঁছে দেওয়া ভোটারদের কাছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সামগ্রী। দলের নাম-প্রতীক দেওয়া টুপি, ছাতা, চাবির রিং থেকে শুরু করে মায় শাড়ি পর্যন্ত। সেই তালিকায় নয়া সংযোজন এবার ‘কন্ডোম’!
ভারতবর্ষের পঞ্চবার্ষিকী উৎসব ‘লোকসভা নির্বাচন’ সমাগত। আর তা নিয়ে এখন সমস্ত রাজনৈতিক দলেই সাজ সাজ রব। কর্মীদের প্রাণে টেনশনের তুফান উঠেছে। কীভাবে, কত নতুন ফিকির খুঁজে জনগণের নজর কাড়া যায়, তা নিয়ে কৌশল তৈরি চলছে জোর কদমে।
তার মধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে কন্ডোম-রাজনীতি নিয়ে!
ভোটপ্রচারে চিরাচরিত প্রথা– দলের প্রতীক-নাম সম্বলিত পুস্তিকা, ইস্তেহার পৌঁছে দেওয়া ভোটারদের কাছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সামগ্রী। দলের নাম-প্রতীক দেওয়া টুপি, ছাতা, চাবির রিং থেকে শুরু করে মায় শাড়ি পর্যন্ত। সেই তালিকায় নয়া সংযোজন এবার ‘কন্ডোম’!
বিষয়টি কিঞ্চিৎ অদ্ভুত সন্দেহ নেই। তবে অবশ্যই অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণও বটে। অন্তত সামাজিক ‘ট্যাবু’ ছেড়ে অন্ধ্রপ্রদেশের দু’টি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল যে এই সাহসী পদক্ষেপ দেখিয়েছে, সেজন্য তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। জানা গিয়েছে, ক্ষমতাসীন ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং বিরোধী তেলুগু দেশম পার্টি– উভয়েই দলীয় চিহ্ন এবং নাম-ছাপা ভিন্ন রং-এর কন্ডোমের প্যাকেট বিলি করছে ভোটারদের ঘরে ঘরে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র।
শাসক ও বিরোধী দু’দল একই কাজ করলেও কন্ডোম বিলি নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ছাড়েনি। ‘আর কত নিচে নামবেন’, প্রশ্ন তুলেছে উভয়েই! এক ধাপ সুর চড়িয়ে ওয়াইএসআর কংগ্রেস বলেছে, ‘কন্ডোম বিলিতেই কি প্রচার শেষ করবেন আপনারা, নাকি এ বার জনসাধারণের মধ্যে ভায়াগ্রাও বিলি করা শুরু করবেন?’
এই ‘ঘোমটার নীচে খেমটা নাচ’ই ভারতীয় রাজনীতির তথা এ-দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় ‘দুর্ভাগ্য’। কন্ডোম, গর্ভনিরোধক বড়ি বা ভায়াগ্রার দোষটা কী? এ কি কোনও নিষিদ্ধ বস্তু? খোলাবাজারে বিক্রি হয় না? হয়। বহুল পরিমাণেই হয়। প্রয়োজনীয় বলেই তা লোকে কেনে। ওষুধের দোকানেও যেমন পাওয়া যায়, আবার পাড়ার মোড়ে পান-বিড়ির দোকানের তাকেও কন্ডোমের প্যাকেট সাজিয়ে রাখা থাকে। কিন্তু কেনার সময় একটু ট্যারা চোখে আশপাশে তাকিয়ে দেখে নেওয়া, কাগজে মুড়ে ঝট করে ব্যাগে ভরে নেওয়া, লুকিয়ে রাখার অভ্যাস এখনও এ-দেশের মানুষ ছাড়তে পারেনি। অথচ এ-দেশেও এখন নামী হেটেলে নতুন সাবান, তোয়ালের পাশাপাশি ড্রয়ারে কন্ডোমের প্যাকেট রাখা থাকে। নয়তো চাইলেই পাওয়া যায়। কারণ, এটা আর পাঁচটা নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মতোই জরুরি, প্রয়োজনীয়। নিজের স্বার্থে, সঙ্গীর স্বার্থেও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সুদান, কঙ্গোর মতো অনুন্নত দেশেও আজ প্রাথমিকস্তরে যৌনশিক্ষার পাঠক্রম রয়েছে। আর ভারত হেঁটেছে উল্টোপথে। রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে কিছুতেই বের হতে পারছে না। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্য সরাসরি এর বিরোধিতা করেছে। বাকি রাজ্যগুলিতেও পরিস্থিতি তথৈবচ। যেন এটা নিষিদ্ধ বিষয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ধুয়ো তুলে গেল গেল রব উঠেছে নানা মহলে। কিন্তু বাস্তব হল, এখনও দেশের নানা অঞ্চলে নাবালিকা বিয়ে রমরমিয়ে চলছে। এবং বিবাহিতা সেই মেয়েদের সঠিক যৌনশিক্ষা নেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। দেশের আর্থিক উন্নয়ন, দারিদ্র দূর করতে হলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আশু প্রয়োজন। প্রত্যেক বছর যে লক্ষ লক্ষ শিশু জন্ম নিচ্ছে, তারা আকাশ থেকে পড়েনি। কোনও পরী বা দেবদূত এসে রেখে যায়নি। শারীরিক সম্পর্কের জেরেই তারা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণ করতে হলে কন্ডোম-গর্ভনিরোধক পিল, অস্ত্রোপচারে বন্ধ্যাত্বকরণ ইত্যাদি আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করতেই হবে। একই সঙ্গে যৌনরোগের হাত থেকে রক্ষা পেতেও কন্ডোম জরুরি। এই মুহূর্তে ভারতে এইচআইভি-এইডস আক্রান্ত রোগী প্রায় ২৩ লক্ষ। অন্য যৌনবাহিত সংক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন প্রথমে মার্কিন সামরিক বাহিনীতে কন্ডোম বিতরণ করা হত। পরে অন্য ইউরোপীয় এবং এশীয় দেশগুলিও একই পন্থা অনুসরণ করে। ১৯৪১-এ জার্মানিতে সাধারণ মানুষের কন্ডোম ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু সেনা জওয়ানদের ছাড় দেওয়া হয়। ইতিহাস বলছে, ক্যাথলিক চার্চ প্রবল বিরোধিতা করলেও উন্নত দেশগুলি কিন্তু বাস্তবের দিকে তাকিয়ে অর্থাৎ যৌনরোগ ঠেকাতে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণে কন্ডোম ও অন্য গর্ভনিরোধকের ব্যবহারকে অস্বীকার করেনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক বিরোধিতার থেকেও জোরাল কৃষক আন্দোলনের ঢেউ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দ্বিতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আমেরিকায় যৌনরোগীর সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। কার্যত মহামারীর চেহারা নেয়। তার সঙ্গে লড়াই করতে প্রথম সরকারি স্কুলে যৌনশিক্ষার পাঠক্রম চালু হয়েছিল। সুদান, কঙ্গোর মতো অনুন্নত দেশেও আজ প্রাথমিকস্তরে যৌনশিক্ষার পাঠক্রম রয়েছে। আর ভারত হেঁটেছে উল্টোপথে। রক্ষণশীলতার খোলস ছেড়ে কিছুতেই বের হতে পারছে না। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্য সরাসরি এর বিরোধিতা করেছে। বাকি রাজ্যগুলিতেও পরিস্থিতি তথৈবচ। যেন এটা নিষিদ্ধ বিষয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ধুয়ো তুলে গেল গেল রব উঠেছে নানা মহলে। কিন্তু বাস্তব হল, এখনও দেশের নানা অঞ্চলে নাবালিকা বিয়ে রমরমিয়ে চলছে। এবং বিবাহিতা সেই মেয়েদের সঠিক যৌনশিক্ষা নেই। অন্যদিকে. আধুনিক ভারতে বিবাহপূর্ব যৌনতা অনেকটা বেড়েছে এবং তাদের বেশিরভাগ অংশ অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কে লিপ্ত। হচ্ছে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ ও বেআইনি গর্ভপাত। যৌনতা সম্পর্কে সন্তানদের প্রাসঙ্গিক তথ্য শেখাতে অনিচ্ছুক, বিব্রত বোধ করেন অধিকাংশ অভিভাবক। উল্টে সোশ্যাল মিডিয়া, পর্নোগ্রাফি থেকে পাওয়া ভুল ও বিকৃত ধারণা (ফ্যান্টাসি) শেষ করে দিচ্ছে অনেক কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে বহু পরিবারকেও।
এই অবস্থায় যদি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি কন্ডোম বিলি করে, তাতে সমস্যা কোথায়? রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি মেনে নিলেই ল্যাটা চুকে যায়। কিন্তু ওই যে, জলে নামব কিন্তু চুল ভেজাবো না– এই মনোভাব দেশের অনেক প্রাপ্তবয়স্ককেও প্রাপ্তমনস্ক হতে দিচ্ছে না।