ইতিহাসে খোদাই করা দেবরাজ রায়ের মুখ, শরীর, পায়ে গুলি, গোলা, বোমা, বিস্ফোরণের ভয়াল আতঙ্কের মধ্যে সেই যুবকের দৌড়ের দৃশ্য, অন্ধ গলির অবরোধে। সত্তরের দশকের সেই যে যৌবনমূর্তি মৃণালবাবু একটা সময়ের আইকনে রূপায়িত করেছিলেন, সেই যৌবন-শরীরের ওই ভগ্নদশা দেখে সেদিনই কষ্ট পেয়েছিলাম।
মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষেই অকাল প্রয়াণ হল দেবরাজ রায়ের। বছর তিনেক আগে শেষ দেখা হয়েছিল ঢাকুরিয়ায় এক অনুষ্ঠান মঞ্চে, তখনই দেখে কষ্ট হয়েছিল, দুর্বলদেহী, লাঠি হাতে কোনওক্রমে শরীরভার সামলে হাঁটছেন। তাঁর যে অন্য ছবিটা আমরা দীর্ঘদিন মানসচক্ষে ধারণ-লালন করে এসেছি, সেই মুখচ্ছবিটা সিনেমার পর্দার কালো পট দীর্ণ করে ফুটে ওঠা এক যুবকের, যাঁকে চিহ্নিত করে ওই কালো পটের ওপর সাদা অক্ষরে অক্ষরায়িত পাঠ:
আমার বয়স কুড়ি
কুড়ি বছর বয়স নিয়ে
আমি আজও হেঁটে চলেছি
হাজার বছর ধরে
দারিদ্র্য
মালিন্য
আর মৃত্যুর
ভিড় ঠেলে
আমি পায়ে পায়ে চলেছি
হাজার বছর ধরে
হাজার বছর ধরে
দেখছি
ইতিহাস
দারিদ্র্যের ইতিহাস
বঞ্চনার ইতিহাস
শোষণের ইতিহাস
ইতিহাসে খোদাই করা সেই মুখ, শরীর, পায়ে গুলি, গোলা, বোমা, বিস্ফোরণের ভয়াল আতঙ্কের মধ্যে সেই যুবকের দৌড়ের দৃশ্য, অন্ধ গলির অবরোধে। সত্তরের দশকের সেই যে যৌবনমূর্তি মৃণালবাবু একটা সময়ের আইকনে রূপায়িত করেছিলেন, সেই যৌবন-শরীরের ওই ভগ্নদশা দেখে সেদিনই কষ্ট পেয়েছিলাম।
তাঁর মৃত্যুসংবাদে সেই কষ্টটাই আবার নতুন করে বাজল, প্রায় আত্মীয়শোকে পরিণত হল আরেকটা স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে। বাংলা থিয়েটারে যখন পুরাতন, বাবু-কালচারজারিত ব্যবসায়িক থিয়েটার আলোকযুক্তির চমকপ্রদ জেল্লাদারি, শেফালী-শরীর আর সিনেমা-তারকার পসারের কম্বিনেশন নাইট-এর মুনাফা শিকারে টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টায় রত; আর স্বমহিমায় বাংলা নবনাট্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছে ‘বহুরূপী’, ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’, ‘রূপকার’, ‘নান্দীকার’, ‘নক্ষত্র’, ‘এলটিজি’, ‘সুন্দরম’, ‘চর্তুমুখ’; তখনই ভবানীপুরে তরুণ রায় নিজের বাড়ির একটা অংশকে ছোট মঞ্চ-সহ থিয়েটার সেন্টারে পরিণত করে গভীর সৎ নিষ্ঠায় পুরাতন-নতুন, দেশজ-বিদেশি মিলিয়ে থিয়েটারের আরেকটা ধারা লালন করেছেন; থিয়েটার সেন্টারে অন্য যে কোনও নাট্যদলকে সাদরে মঞ্চমহলা দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন; তরুণ রায়-দীপান্বিতা রায় দম্পতির সেই সহৃদয় সাধনার মধ্যেই আমি প্রথম দেখি, একটা সময় জুড়ে লক্ষ করে যাই দেবরাজের সংবেদী, সংযত অভিনয়শিল্পের বিকাশ; তারপর ও কোথায় যেন হারিয়ে যায়! রায়বাড়ি, থিয়েটার সেন্টারের সেই আবেগোষ্ণ আড্ডা-পরিবেশের স্মৃতিরই এবার অঙ্গ হয়ে গেল দেবরাজ।
আমি জানি না, কেন তরুণদার সেই প্রকল্পটা দেবরাজের হাতে ফলন্ত হয়ে উঠল না। হলে হতে পারত বাংলা থিয়েটারের আরেকটা ঘরানা। দেবরাজের অভিনেতা-শরীরে সেই ভিতটা গ্রোথিত ছিল– ওঁর মাতা-পিতার উত্তরাধিকার, ওঁর শিক্ষা।