জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে/ সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।’– আসলে সে প্রকৃতিকেও নেয়। আজকের আন্দোলন আজকেই শেষ নয়। ভবিষ্যতে বারবার লোভের এই প্ররোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হবে। ক্ষমতার সঙ্গে টানাপোড়েনে একটু করে বনভূমি আর জলাভূমি আমরা হারাব। আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করব– “আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/ আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।”
ময়ূরের আর্ত চিৎকার আর বাঁচার পথ খোঁজা হরিণের ভীত, সন্ত্রস্ত ছোটাছুটি– এই ছবি ও ভিডিও এতদিনে গোটা দেশ দেখে ফেলেছে। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের (Hyderabad University) এই চিত্র বহুকালের জন্য ধ্বংসাত্মক পুঁজির বিরুদ্ধে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের প্রতিরোধ চিহ্ন হয়ে থাকবে গণমানসে। সারা দেশ জুড়ে মানুষ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে চলেছে, সংহতি জানাচ্ছে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের প্রতি। পরিবেশ, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার দাবিতে দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ মানুষের হাত ধরেছে। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০০ একরের বনভূমি বাঁচানোর এই ছাত্র আন্দোলন বহুদিন ইতিহাসের স্মৃতিতে থেকে যাবে প্রতিরোধ ও সংহতির চিহ্ন হিসেবে। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অগণিত ছাত্রছাত্রী কোনওদিন প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মন্তব্য করেনি তারাও স্পষ্টভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করেছে ও পক্ষ নিয়েছে। হাজার হাজার প্রাক্তনী তাদের প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার দাবিতে একজোট হয়েছে।
আমি হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে যাই ২০০৯ সালে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমে ক্রমে আমার কাছে নতুন বিশ্বলোক উন্মোচিত করে। পশ্চিমবঙ্গের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে প্রথম প্রজন্মের বিদ্যালয়-উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো, মুক্ত চিন্তার পরিসর, অবাধ স্বাধীনতা আর পরিবেশ আমার ও আমার মতো হাজার হাজার বিদ্যার্থীর জীবন পালটে দেয়। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের ভাষা, জাতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি প্রতিরূপ। ভারতের সমস্ত অঞ্চল থেকে ছাত্রছাত্রী এখানে পড়তে আসে। তেলেঙ্গানা বা দক্ষিণ ভারতের রুক্ষ কৃষ্ণমৃত্তিকা অঞ্চল থেকে পিছিয়ে পড়া বর্গের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করার পর শহুরে উচ্চবর্গের ক্লাসমেটদের পাশে বসে, ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলে নিজেকে প্রকাশ করে। কিংবা নীরবে, লাজুক মুখে পিছিয়ে থাকতে থাকতে, মাসের পর মাস হোস্টেলের ঘরে আর ২৪ ঘণ্টা খোলা রিডিং-রুমে বা সন্ধে অবধি লাইব্রেরির অবাধ স্বাধীন পরিসরে নিজেকে অগোচরে নির্মাণ করতে করতে, হঠাৎ একদিন সবাইকে চমকে দেয় ছোট-বড় সাফল্য অর্জন করে। নিজেকে সে নতুন করে চেনে, আর বহু মানুষের হয়ে ওঠার গল্পে উদ্ভাসিত হয় নায়ক হিসেবে। ভালো চাকরি বা বিদেশি ফেলোশিপ, শ্রেণি নির্বিশেষে জীবন নির্মাণের সফল প্রতিষ্ঠান হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় (Hyderabad University)। এই বিশ্ববিদ্যালয় তাই প্রতিটি প্রাক্তনীর কাছে আলগোছে যত্নে লালন করা এক স্মৃতির ধন।
চিপকো বা নর্মদা আন্দোলনের পর স্বাধীন ভারত হয়তো এত বড় পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আর দেখেনি। ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা সংগঠিত এত বড় পরিবেশ আন্দোলন আর হয়নি। এই আন্দোলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব তাই অপরিসীম। এই আন্দোলন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদেরও দায়বদ্ধ হওয়ার বার্তা দিয়ে যায়। তেলেঙ্গানা সরকারের পাঠানো পুলিশের বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে যে ছেলেমেয়েগুলো অকুতোভয় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাঠির আঘাত সহ্য করে, অথবা গ্রেপ্তার হয়ে কিছু ঘণ্টার জন্য হাজতবন্দি হয়, অথবা রিলে-অনশনে বসে– তারা প্রত্যেকে কেবল মেধাবী ছাত্রছাত্রী হিসেবে একটি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে উঠছে না; তারা প্রত্যেকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রকৃতি-সচেতন ব্যক্তি হিসেবে একেকটি বার্তা হয়ে উঠছে ক্ষমতার সামনে। এই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন তাই শিক্ষকদের শেখায়, অভিভাবকদের শেখায় এবং ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষায় আসবে এমন ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ ও দায়বদ্ধতার পাঠ দেয়।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের (Hyderabad University) সামনে দিয়ে চলে যাওয়া সি আর রাও রোড থেকে মেনগেট পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায় প্রকৃতির মর্ম কী! বোঝা যায় গেটের বাইরে আর গেটের ভেতরে উষ্ণতার বেশ খানিকটা পার্থক্য আছে। মেনগেট থেকে সি আর রাও রোড ধরে যদি গাছিবৌলি স্টেডিয়ামের দিকে এগোনো যায় তাহলে ডানদিকে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর-ঘেঁষা বনভূমি অঞ্চল। বোঝা যায় সেখানেও উষ্ণতা বেশ কম। পরিবেশ মানুষের জীবন ও মনে কী প্রভাব ফেলে– হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করতে যান তাঁরা প্রত্যেকে এই সত্যিটা টের পান। পরিবেশ কেন বাঁচানো দরকার প্রতিদিনের যাপন থেকে ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পারেন। ২০০৯ সালে আমি যখন প্রথম নবনির্মিত হোস্টেলের বাসিন্দা হিসেবে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছই, তখন প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতে পাই হোস্টেলের দরজার কাছে হরিণ শিশু বা ময়ূর খেলা করছে।
২০১৫ সালের আগস্ট মাসে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ি। তখন অনেকটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ ক্যাম্পাসে দু’টো বড় বড় হোস্টেল তৈরি হয়েছে, শিক্ষকদের জন্য কোয়াটার তৈরি হয়েছে, অনেক বড় লাইফ-সায়েন্স বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। আর জঙ্গল কেটে চলছে আরও নতুন হোস্টেল তৈরি করার কাজ। উন্নয়ন না পরিবেশ– শিল্পবিপ্লবোত্তর আধুনিকতার নানা পর্বে এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, শেষ ২০ বছরে আরও বেশি করে। বৃহত্তর মানুষের স্বার্থে পরিবেশকে ধ্বংস করতে আমরা পিছপা হইনি। সেই বিতর্ক তাই পাশে সরিয়ে রেখে পরিবেশকে বাঁচানো কীভাবে সম্ভব– মানুষের কথা ভেবেই এই প্রশ্ন আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
তেলেঙ্গানা সরকার যে ৪০০ একর জমি দখল করে নিতে চাইছে সেই ৪০০ একর জমি এক নিবিড় বনভূমি অঞ্চল ছিল। তার সঙ্গে ছিল অসংখ্য পশুপাখি কীটপতঙ্গ ও সরীসৃপের স্বাভাবিক বসতি। এই ৪০০ একর সরকার দখল করে নিচ্ছেন মানুষের দাবিতে নয়, পুঁজির লোভে। নব্য উদারীকৃত রাজনীতি এবং অর্থনীতির লোলুপতার ফল হচ্ছে এই জবরদখল। ২০১০ সালে নলেজ অ্যান্ড ইনোভেশন পার্কের জন্য হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেনগেট থেকে ডানদিকের অংশের বিপুল বনভূমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য সৈয়দ ই হাসনাইন তুলে দিতে চান কর্পোরেট সেক্টরের হাতে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যৌথ মঞ্চের আন্দোলনে সেই কাজ করতে ব্যর্থ হন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই আন্দোলনে আমি নিজেও শরিক ছিলাম।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইকন হচ্ছে মাশরুম রক। এই মাশরুম রক কেবল আজ নয়, এর আগেও বহুবার সরকারের লোলুপ দৃষ্টিতে পড়েছে। মাশরুম রক কানচা গাছিবৌলি এলাকার বনভূমির অন্তর্গত। ২০১১ সালে আমরা তীব্র প্রতিবাদ ঘোষণা করেছিলাম এবং মানববন্ধন করে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলাম মাশরুম রকের চারপাশে। আমরা দখল হতে দিইনি মাশরুম রক।
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশের জন্য বারবার এই আন্দোলনে সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ একর সম্পত্তি যখন টিআইএফআর হায়দরাবাদ-কে দিয়ে দেওয়া হয় এবং তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং উদ্বোধন করতে আসেন, তখন আমরা ছাত্রছাত্রীরা প্রবল প্রতিবাদ ঘোষণা করি এবং প্রবল সাহস নিয়ে পথ রুখে দাঁড়াই। কিন্তু আমাদের আন্দোলন সফল হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি চলে যায় টিআইএফআইয়ের হাতে। তারপর ক্রমে ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক বনভূমি নানা সময় নষ্ট করা হয়েছে, বন্য গাছপালা কেটে কৃত্রিম গাছপালা রোপণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গাছের অভাব ঘটেনি কিন্তু বাস্তুতন্ত্রের বিপর্যয় ঘটেছে। আমরা বারবার উপলব্ধি করেছি কী বিপুল অবজ্ঞায় প্রকৃতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ধ্বংস করা হয়েছে; বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করা হয়েছে। বাফেলো লেক, সানসেট রক, হোয়াইট রক, পিকক লেক অঞ্চলের বিপুল স্বাভাবিক জলাভূমি ও বনভূমিকে ধ্বংস করে বারবার কৃত্রিম সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে।
অথচ দেশের একটি শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে এরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেত যে একইসঙ্গে কীভাবে উন্নয়ন এবং প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেদিকে কোনওদিনই নজর দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মধ্য ক্যাম্পাস থেকে সাউথ ক্যাম্পাসের দিকে যেতে যে প্রশস্ত রাস্তা তৈরি হয়েছে– সেই রাস্তা ততটা প্রশস্ত করার প্রয়োজন ছিল কি না এই প্রশ্ন ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন ঘটানোর জন্য বারবার বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে; অথচ তার বিকল্প ছিল জঙ্গল বাঁচিয়ে জনঘন অঞ্চলে পরিকাঠামো নির্মাণ করা। কিন্তু পরিকল্পনা ও পরিবেশগত দায়িত্ববোধের অভাব বারবার দেখা গেছে।
আজ যে ময়ূর বা হরিণ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে জীবনের দায়ে, শেষ ১৫ বছর ধরে ক্রমশ ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বনভূমি হারিয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছে কাঞ্চা গাছিবৌলি, অর্থাৎ ইস্ট ক্যাম্পাসের দিকে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছেন। আশা করি, এমন রফা হবে না যাতে ৪০০ একরের মধ্যে মীমাংসা করে ২০০ একর চলে যায় সরকার পোষিত কর্পোরেটের কাছে; আর বাকি ২০০ একর বনভূমি অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের মৃত্যু-অপেক্ষায় বসে থাকে।
জীবনানন্দ দাশ ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে/ সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।’– আসলে সে প্রকৃতিকেও নেয়। আজকের আন্দোলন আজকেই শেষ নয়। ভবিষ্যতে বারবার লোভের এই প্ররোচনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রয়োজন হবে। ক্ষমতার সঙ্গে টানাপোড়েনে একটু করে বনভূমি আর জলাভূমি আমরা হারাব। আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘উটপাখি’ কবিতার পঙ্ক্তিগুলো উচ্চারণ করব– “আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে/ আমরা দুজনে সমান অংশীদার/ অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে,/ আমাদের ’পরে দেনা শোধবার ভার।”
হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের প্রতি এক প্রাক্তনীর অভিবাদন!
………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।