লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার কখনও ভরে না। যেটুকু খুচখাচ পয়সা জমে তাতে, নিয়ে নেওয়া হয় প্রয়োজনে। মা-ঠাকুরমারা নিজেদের জন্য টাকা রাখতে পারেনি, পরিবারে সে টাকা ঢেলে দিয়েছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে এলেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এখনও খালি। শ্রমবাজারে মেয়েদের অবদান ততটাই, যতটা পুরুষের। কিন্তু সে শ্রমের মূল্য নেই। মূল্য নেই তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার। নিজের শ্রমে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। নিজের উপার্জনে স্বাবলম্বী হওয়ার। একটি পুরুষ সবসময় তার আগে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সম্মানে, ক্ষমতায়, পারিশ্রমিকে।
লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর সময়টা মেয়েদের জন্য বড় যন্ত্রণাময়। চারিদিকে হইহই করে শুরু হয়ে যায় মেয়ের সংজ্ঞা– সে লক্ষ্মী না অলক্ষ্মী, সে চঞ্চলা না স্থিরপ্রাজ্ঞ। চারিদিকে নানা প্রকারের পুরুষের মাঝে বসে হে নারী, তুমি অবাক হও, মনে মনে হাসো। ভাবজগতে তো অনেকটা পথ পেরলে, দাড়িতে হাত বুলিয়ে নারীর চরিত্র, নারীর মন, নারীর শরীর নিয়ে অনেক কাব্য করলে, আবার তত্ত্বও করলে, জোরবার একটা প্রতর্কও খাড়া করে দিলে নারী লক্ষ্মী না অলক্ষ্মী, স্থির না অস্থির, চণ্ডালিনী নাকি শান্তপট, বেশ্যা না দেবী– আবার গম্ভীর হয়ে বলেও দিলে একই দেহে লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মীর বাস, কালী আর লক্ষ্মী দুইয়ে মিলে নারী চরিত্র– এবার থামো হে! অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, এবার মূল কথাটায় আসা যাক। নারীর শ্রম, নারীর উপার্জন, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন। লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার শূন্য, কিন্তু লক্ষ্ণীপুজোর আয়োজন চলেছে রমরমিয়ে।
ক্লডিয়া গোল্ডিন এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন অর্থনীতিতে মহিলাদের অনুল্লিখিত অবদান নিয়ে কাজ করার জন্য। শ্রমবাজারে মহিলাদের অসম মজুরি ও যোগ্যতার অসম বিচার তাঁর কাজের মূল প্রতিপাদ্য। যদিও মহিলারা বছরের পর বছর ধরে পুরুষের সমান খাটুনি খেটেও কম মজুরি পাওয়া নিয়ে হাজারো অভিযোগ, হাজারো প্রতিবাদ করে গিয়েছে, কিন্তু এতদিনে নোবেল কমিটির টনক নড়েছে। ক্লডিয়া গোল্ডিন উপস্থিত করেছেন বিগত ২০০ বছরের পরিসংখ্যান। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্ম অধিকার নিয়ে কথা বলতে না জানি আরও কত সময় লাগবে!
ক্লডিয়া গোল্ডিনের পর্যবেক্ষণ একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশে আলোকপাত করেছেন, যা আশঙ্কার। দেখা যাচ্ছে, কৃষিক্ষেত্রে কাজ করার সময় মহিলাদের যে কর্মের অধিকার ও মজুরি প্রদান করেছিল সমাজ, তা শিল্পবিপ্লবের সময় কমে যায় একলপ্তে। আবার তা বাড়ে (বলা ভাল আগের স্থানে পৌঁছয়) সার্ভিস সেক্টরের প্রসার হলে। ততদিনে মেয়েরা শিক্ষার অধিকার পেয়েছে, কর্মক্ষেত্রেরও নতুন নতুন দিক আবিষ্কৃত হয়েছে। তৈরি হয়েছে মেধাভিত্তিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মস্থল। কিন্তু চিন্তার বিষয় এটা যে, গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী নয়। গ্রাফটা ‘ইউ’-এর আকারের। অর্থাৎ পৃথিবীজুড়ে দীর্ঘকালীন নারী আন্দোলনের ফলে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থান সবেমাত্র পূর্বাবস্থায় ফিরতে পেরেছে, কোনও উন্নতি হয়নি এখনও অবধি। এত বছরের, এত এত মহিলার চিৎকার কানে যায়নি সমাজের। ক্লডিয়া গোল্ডিন দেখাচ্ছেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতারও এমনকী মূল্যায়ন হয় না। নারীর যোগ্যতা পুরুষের থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর বাইরে রাখা হচ্ছে। যদিও ক্লডিয়ার এই গবেষণায় শ্রেণিগত বৈচিত্রের দিকটি অপ্রকাশিত।
ক্লডিয়া জানাচ্ছেন, নারীর শ্রম চিহ্নিত হচ্ছে না, সম্মান পাচ্ছে না। কিন্তু নারীর শ্রমের প্রয়োজন আছে, সেই প্রয়োজনটা চিহ্নিত সাড়ম্বরে। যেভাবে অন্দরমহলে নারীর শ্রমের প্রয়োজন স্বীকার করে নিয়েছে সমাজ, কিন্তু সেই শ্রমের যেমন মূল্য নেই, ঠিক একই পদ্ধতিতে শ্রমবাজারে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর শ্রমের প্রয়োজন রয়েছে, কিন্ত মূল্যায়ন নেই, ক্ষমতায়ন নেই। আরও একটা বিশ্লেষণে তিনি জানাচ্ছেন, গর্ভনিরোধক ওষুধ আসার পর নিশ্চিতভাবেই কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও বিবাহিত নারী বা সন্তানের জন্মের পর তাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ, এখনও মেয়েরা সেই সন্তানধারণেই সীমাবদ্ধ, সন্তান পালনে তার সম্মান, সন্তান লালনই তার ধর্ম। কিন্তু সমাজের একটি অংশের ধারণা, মেয়েরা নাকি অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। সমাজের এই অংশ বিরক্তও নারী আন্দোলনের এই বাড়বাড়ন্তে। সবই তো পাওয়া হয়ে গেছে, তবুও আর লড়াইটা কেন! তবে মিসোজিনিস্ট সমাজ জানে কীভাবে এর ফায়দা লুটতে হয়। চাকরিরত মেয়ের সুবিধে কিন্তু নেবে পরিবার, বলা ভাল পরিবারতন্ত্র, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সে কোন শর্তে, কোন অপমানে, কোন অপরাধের শিকার হয়ে রয়েছে, সে কথা জানবে না পরিবার-স্বজন-সমাজ, স্পষ্ট করে বললে সেই পুরুষতন্ত্রই। যেভাবে লক্ষ্ণীর ভাণ্ডারে জমিয়ে রাখা মায়ের টাকা আসলে পরিবারেরই অসময়ে-দুঃসময় কাজে লাগে। একথা বিলকুল জানে পরিবার। মহিলাদের উপার্জন বা মহিলাদের জমানো টাকার ব্যবহার করবে পরিবার, মহিলাটি নিজে নয়। উপার্জনের অধিকার পেলেও মহিলাদের নিজের স্বার্থে টাকা খরচের অধিকার নেই। জোগাড় করবে একজন, লুটবে অন্যজন।
শ্রমবাজারে আড়ি পাতলে জানা যাবে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রেরই একই চরিত্র। ভারতে শ্রমের নিরিখে পুরুষেরা ৮২ শতাংশ পারিশ্রমিক পায়, মহিলারা ১৮ শতাংশ। ‘ঋ৯কাল’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত কর্মরত মেয়েদের নিজেদের কথার সংকলন ‘কামলাসুন্দরী’-তে চোখ রাখলে পরিষ্কার হয়ে যায়, একটি বিশেষ শ্রেণির মহিলাদের কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মেয়েদের এই অংশটি উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্তেরও। তাদের আশপাশে চিন্তাশীল মানুষেরা হেঁটে চলে বেড়ান, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার নিয়ে চর্চাও চলে হরদম, তবুও কিছুতেই পুরুষের সমান বেতন পায় না মেয়েরা। সঙ্গে রয়েছে যৌন হেনস্তা, স্লাট শেমিং, নারীর পণ্যায়ন। আর যে শ্রেণিটির কথা বাদ পড়ে যাচ্ছে বারবার, কোনও আলোচনাতেই যে মেয়েদের কথা বলা হচ্ছে না, সেই শ্রেণির, একশো দিনের কাজ পাওয়া মেয়েদের অবস্থা আরও সঙ্গীন! তাদের ক্ষমতায়নের চিন্তা আমাদের কারও নেই। সেই মেয়েদের ওপর রয়েছে শ্রেণি-নিপীড়ন। আধবেলা খাবার খেয়ে, যৌন অত্যাচারে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে সে খেটে যাচ্ছে দুটো পয়সার জন্য। আক্ষরিক অর্থেই দুটো পয়সা।
লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার কখনও ভরে না। যেটুকু খুচখাচ পয়সা জমে তাতে, নিয়ে নেওয়া হয় প্রয়োজনে। মা-ঠাকুরমারা নিজেদের জন্য টাকা রাখতে পারেনি, পরিবারে সে টাকা ঢেলে দিয়েছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে এলেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এখনও খালি। শ্রমবাজারে মেয়েদের অবদান ততটাই, যতটা পুরুষের। কিন্তু সে শ্রমের মূল্য নেই। মূল্য নেই তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার। নিজের শ্রমে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। নিজের উপার্জনে স্বাবলম্বী হওয়ার। একটি পুরুষ সবসময় তার আগে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সম্মানে, ক্ষমতায়, পারিশ্রমিকে। ততটাই শ্রম দিয়েও সে বিচার্য হচ্ছে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসাবে, বিবাহের পরিচয়ে, সন্তানধারণের ক্ষমতার অনুযায়ী। তার শ্রম প্রয়োজন, সে নয়।
লক্ষ্ণীপুজো চলছে চারদিকে, হইহই করে বাজার মেতে রয়েছে মেয়েটি লক্ষ্ণী না অলক্ষ্মী সেই চিন্তায়, চর্চায়। কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার খালি।