দেশ নিয়ে কথা বলতে বলতে খানিক মজার ছলেই গুলজার বলে ওঠেন যে– ‘আমার জন্ম পাকিস্তানে, রাখির জন্ম বাংলাদেশে, আর আমার মেয়ে মেঘনার জন্ম ভারতে…ফলে এই পুরো উপমহাদেশই তো আমাদের ঘর… এই যে জামা দেখছ, এর কাপড় আসে পাকিস্তান থেকে। এখনও প্রতি বছর পাকিস্তান থেকে আমার জন্য জামার কাপড় আর গুড় নিয়ে আসে বন্ধুরা।’
অক্টোবর, ২০১৮। অফিসের ফাইলে মুখ গুঁজে কাজ করছি একটানা। হঠাৎ অচেনা একটা নম্বর থেকে ফোন। ধরতেই ওপাশ থেকে– ‘হ্যালো, সন্দীপন চক্রবর্তীজি সে বাত কর সকতা হুঁ?’ সাধারণত অচেনা নম্বর আসা থেকে এসব ফোন নানা কোম্পানির হয়। কিন্তু তারা তো ঠিক এভাবে কথা বলে না! একটু ইতস্তত করে হ্যাঁ বলতেই, ওপাশ থেকে– ‘ম্যায় গুলজার বোল রহা হুঁ’। হাত থেকে এবার সত্যিই প্রায় ফাইল ছিটকে পড়ে আর কী! তবু কথা বললাম খানিক। কিন্তু হঠাৎ আমায় ফোন করা কেন? সেটা বুঝতে হলে, একটু পিছিয়ে যেতে হবে।
মার্চ, ২০১৭। কথায় কথায় অনুজ এক বন্ধু শুনিয়েছিল– ‘আঁখো কি ভিসা নহিঁ লগতা/ সপনোঁ কি সর্হদ্ হোতি নহিঁ/ বন্ধ্ আঁখো সে রোজ ম্যায় সর্হদ্ পার চলা যাতা হুঁ’। উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে আমি। চোখ বুজে, আমিও কী কতদিন চলে যাইনি, সীমান্ত পার করে, আমার সেই বাপ-ঠাকুরদার ভিটেয়, ঢাকায়! একেবারে বুকে এসে লাগল। জানলাম, উৎস– সদ্য সে বছরই ‘পেঙ্গুইন ভাইকিং’ থেকে প্রকাশিত গুলজারের দ্বিভাষিক বই ‘সাসপেক্টেড পোয়েমস’। মাস তিনেক পর বইটা হাতে পেয়ে, পড়তে পড়তে মনে হল, এর যে কোনও একটা কবিতা অনুবাদ করে দেখি তো কেমন দাঁড়ায়! প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা… এভাবে যেন এক ঘোরের মধ্যে, নিজেই নিজের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে, গোটা বইটা অনুবাদ করে ফেললাম ১৭-১৮ দিনের মধ্যে। প্রাথমিক একটা খসড়া। কিন্তু পারমিশন পাব কী করে?
২৬ আগস্ট, ২০১৭। বাংলায় অনূদিত তাঁর অন্য দু’টি বইয়ের উদ্বোধনে, গুলজার এসেছেন কলকাতায়। দে’জ-এর অপুকে (শুভঙ্কর দে) ধরে, অনুষ্ঠানের ঠিক আগের মুহূর্তেই তাঁর কাছে পৌঁছলাম সম্মতি আদায়ের জন্য। তিনি– বোধহয় একটু অবাক হয়েই– জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পুরো বইটা আপনি ট্রান্সলেট করেছেন?’ অবাক হওয়ার কারণ আন্দাজ করলাম, সবেমাত্র মাস ৬-৭ আগে বেরনো বই পড়ে আবার অনুবাদও করে ফেলেছে! উত্তরে ‘হ্যাঁ’ জানাতেই, বললেন– ‘ঠিক আছে। একবার আমাকে পাঠান।’ এত সহজে সম্মতি পেয়ে যাব, ভাবিনি। গুলজারের যে-ধরনের কবিতা আমরা পড়ে এসেছি, এ বইয়ের লেখাগুলো যেন সেই গণ্ডি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। অনেক সময়েই সেসব সরাসরি উঠে আসছে খবরের কাগজ থেকে। সাম্প্রদায়িকতা আর দেশভাগে ছিন্ন রক্তাক্ত এক দেশ থেকে। কাঁটাতারে ঘেরা এক অর্থহীন স্বাধীনতার প্রহসন থেকে। এই অস্থির সময়ে পা রেখে, তাঁর ভাষাও তাই হয়ে উঠছে আরও সরাসরি। ঘষা লেগে লেগে ভোঁতা হয়ে-যাওয়া আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তার ভাষাকেই মুচড়ে, তিনি করে তুলছেন খাপখোলা তলোয়ার; তা ঝলসে উঠছে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে। তুলনায় বাঙালি পাঠকের হয়তো মনে পড়তেই পারে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই লাইন– ‘মুখে যদি রক্ত ওঠে/ সে-কথা এখন বলা পাপ’। এমনকী ‘যন্ত্রণায় ধনুকের মতো/ বেঁকে যাওয়া পাপ: নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ’। এসব কবিতাই যেন সেই ‘পাপ’। তাই ক্ষমতার চোখ একে দেখে সন্দেহের নজরে। আর তা হয়ে ওঠে ‘সন্দেহজনক কবিতা’। ঠিক-ঠিকভাবে বললে হয়তো হওয়া উচিত ছিল ‘সন্দেহভাজন কবিতা’; সেক্ষেত্রে ‘কবিতা’-র উপর একটা ব্যক্তিত্ব আরোপ হত। কিন্তু গুলজারজির কানে লাগছিল ‘সন্দেহভাজন’ শব্দটি, বরং ‘সন্দেহজনক’-ই তাঁর শ্রুতিতে ভালো। আর এটা নিয়ে কথা বলতেই তিনি ফোন করেছিলেন আমায়। এই বইয়ের ভূমিকায় গুলজার লিখছেন–
যাকে আপনি ঠোঁটচাপা বলেন, সে তো আর খোলাখুলি কিছু বলতে পারবে না। বললেই গৃহবন্দি হয়ে যাবে। এমনকী কেউ কান পেতে শোনে যদি, কান মুচড়ে দেওয়া হবে।
‘কী বললে?’
আর আপনি হয়তো অনুপম খেরের মতো বলে উঠবেন:
‘মেরা উয়ো মতলব নেহি থা!’
কিন্তু আপনি যা-ই বলবেন, সন্দেহের নজরে দেখা হবে। এসবই সেই সন্দেহজনক কবিতা, উর্দুতে বললে, ‘মাশ্কুক নজমেঁ’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
গুলজারের যে-ধরনের কবিতা আমরা পড়ে এসেছি, এ বইয়ের লেখাগুলো যেন সেই গণ্ডি থেকে ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। অনেক সময়েই সেসব সরাসরি উঠে আসছে খবরের কাগজ থেকে। সাম্প্রদায়িকতা আর দেশভাগে ছিন্ন রক্তাক্ত এক দেশ থেকে। কাঁটাতারে ঘেরা এক অর্থহীন স্বাধীনতার প্রহসন থেকে। এই অস্থির সময়ে পা রেখে, তাঁর ভাষাও তাই হয়ে উঠছে আরও সরাসরি। ঘষা লেগে লেগে ভোঁতা হয়ে-যাওয়া আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তার ভাষাকেই মুচড়ে, তিনি করে তুলছেন খাপখোলা তলোয়ার; তা ঝলসে উঠছে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জানুয়ারির শেষ, ২০১৯। সে বছরের কলকাতা বইমেলা সদ্য শুরু হয়ে গেছে। জানা গেল যে, গুলজার এসেছেন কলকাতায়। দু’-তিনদিন থাকবেন। এয়ারপোর্টে নেমেই তিনি ফোন করেছেন অপুকে। জানিয়েছেন যে, উঠছেন জে ডব্লিউ ম্যারিয়ট-এ। অপু যাবে দেখা করতে। এবার সঙ্গে যেতে হবে আমায়। উনি দেখা করতে চেয়েছেন। ‘সন্দেহজনক কবিতা’ বই হয়ে বেরবে আর দু’-তিন মাসের মধ্যেই। গিয়ে, পরিচয় দিয়ে প্রণাম করতেই সেই বিখ্যাত কণ্ঠ– ‘জিতে রহো বেটা’। আমার করা বাংলা অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে অপু। আর সলজ্জ মুখে সেই চুরাশি-উত্তীর্ণ তরুণ বলে চলেছেন– ‘আগেরবারের মতো অত বড় ব্যাপার কোরো না…কেমন অস্বস্তি হয়…কবিতার বইয়ের প্রকাশ নিয়ে অতটা বাড়াবাড়ি কেমন যেন লাগে!’ উল্টে তাঁকে বলি– কিন্তু আগেরবার তো কত লোক এসেছিল, অত বড় নন্দন ১-এর হল উপচে গিয়েও দাঁড়িয়ে ছিল লোকে আপনার বইয়ের প্রকাশ দেখবে বলে…তাদের যদি এবার জায়গা না হয়, তাহলে তারা কি আশাহত হবে না? খানিক হেসে জানান– ‘তারা গুলজারের কবিতার জন্য এসেছিল কি? তারা হয়তো এসেছিল চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব গুলজারকে দেখতে।’ এই সচেতনতা চমকে দেয়। অবশ্য সে অনুষ্ঠানের একটা ব্যাপারে তিনি প্রবল খুশি– ‘সেদিন শঙ্খদা এসে আমার বই উদ্বোধন করলেন, পুরোটা সময় রইলেন, আমার কবিতা শুনলেন। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!’
এরপর, আস্তে আস্তে, কথা গড়িয়ে আসে তাঁর নিজের কবিতার প্রসঙ্গে। জিজ্ঞাসা করি, দেশভাগ কি তাঁর জীবনে একটা চিরস্থায়ী ক্ষতরেখা তৈরি করে দিয়ে গেছে, যা হয়ে উঠেছে তাঁর লেখকজীবনের নিয়ন্তা? এই যে আমি যার কাছে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না, আমায় সরে আসতে হল বাধ্য হয়ে, এই সামাজিক বা রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত বেদনাবোধই কি বারবার ডিসপ্লেসড হয়ে ধরা পড়ে না, এমনকী ব্যক্তি-সম্পর্ক বা প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও– তাঁর কবিতা আর গানের কথায়? এর জবাবে তিনি বলে চলেন অনেক কথা। বলেন, এর জন্য এক ধরনের বঞ্চনার বোধ আছে। সে-বঞ্চনা শুধু দেশভাগজনিত নয়, বাবা-মা-ভাই-বোনের পরিবার থেকেও কীভাবে বঞ্চনার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কিন্তু সবকিছু মিলিয়েও সে-শুধুই বঞ্চনার বোধ। কাঁদুনি গাওয়া কোনও কষ্টের বোধ না। জীবন যেমন অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে বঞ্চনা করেছে, তেমনই আরেকদিকে দিয়েছেও অনেক কিছু দু’হাত ভরে। হয়তো এতটা পাওয়ারও কথা ছিল না তাঁর। কাজেই শুধু বঞ্চনা দিয়ে তাঁকে বিচার করা যাবে না। বলেন, শিল্প কীভাবে ক্ষুদ্র ‘পার্সোনাল’-এর গণ্ডিকে অতিক্রম করে আরও বড় পটে তুলে ধরে শিল্পীর সমগ্র ‘পার্সোনা’-কে।
কথায় কথায় গড়িয়ে যায় বেলা। কথার ফাঁকফোকর বেয়ে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রসঙ্গে তাঁর সশ্রদ্ধ নানা মন্তব্য। রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, তাছাড়া বিশেষ করে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা নিয়েও উচ্ছ্বসিত তিনি! উঠে আসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আড্ডার কথা। উঠে আসে তাঁর ফিল্মজগতে আসার দিনগুলোয় বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দুনিয়ায় বাঙালিদের কেমন রমরমা ছিল, সেসব কথা। ধর্মশালায় বাস করা বৌদ্ধদের মধ্যে যাঁরা তৃতীয় প্রজন্ম, যাঁরা কখনও তিব্বতে যাননি, শুধু শুনেছেন যে তাঁদের পূর্বপুরুষ চলে এসেছিলেন দলাই লামার সঙ্গে, তাঁদের লেখা কবিতার প্রসঙ্গ। দেশ নিয়ে কথা বলতে বলতে খানিক মজার ছলেই বলে ওঠেন যে– ‘আমার জন্ম পাকিস্তানে, রাখির জন্ম বাংলাদেশে, আর আমার মেয়ে মেঘনার জন্ম ভারতে…ফলে এই পুরো উপমহাদেশই তো আমাদের ঘর… এই যে জামা দেখছ, এর কাপড় আসে পাকিস্তান থেকে। এখনও প্রতি বছর পাকিস্তান থেকে আমার জন্য জামার কাপড় আর গুড় নিয়ে আসে বন্ধুরা।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ইলিয়াস এবং আমাদের মধুর করুণ বাসনা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমরা নিশ্চয়ই অনেক সময় নষ্ট করে দিচ্ছি তাঁর। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াই। তিনি অলস চোখে তাকিয়ে বলেন– ‘আরেকবার করে কফি খেলে হতো না? এখানকার কফিটা বেশ ভালো!’ বসে পড়ি আবার। বলে চলেন– ‘সেই আট বছর বয়সে পাকিস্তান ছেড়ে চলে এসেছি। অথচ এখনও হুবহু মনে আছে সেখানকার নানা স্মৃতি। একবার অনেক পরে যখন পাকিস্তান গেছি– আমাদের মহল্লায়– দেখা হলো ছোটবেলায় চিনতাম, এমন এক দোকানদারের সঙ্গে। বুড়ো হয়ে গেছে। অথচ স্মৃতি পুরো ঝকঝকে। আমার মা-বোন-মামাদের নাম পর্যন্ত সব মনে আছে তার। আমার পরিচয় পেয়ে, এক মামার নাম করে জিজ্ঞাসা করলো যে, তিনি কেমন আছেন? আমি জানালাম যে, তিনি আর নেই। মারা গেছেন। তারপর সে বুড়ো আমার হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে বললো– লে যা! ইয়ে লে যা! আমি হাতজোড় করে বললাম যে– ক্ষমা করবেন, আমি নিতে পারবো না। কিন্তু আপনি আমাকে দিচ্ছেন কেন টাকাটা? সে বুড়ো জানালো যে, ওই দোকানটা নাকি সে আমাদের থেকে পাঁচ টাকায় ভাড়া নিয়েছিল। এতদিন আমরা না থাকায় আর ভাড়া দিতে পারেনি। আমাকে দেখে, তাই সে ওই ভাড়ার টাকা দিতে এসেছে। কী বলবো, চোখে জল চলে এসেছিল আমার! …তাহলে বলো, এ-ও কি বিরাট এক পাওয়া নয়? শুধু বঞ্চনাটাই সত্যি?’
সম্প্রতি তাঁর জ্ঞানপীঠ পাওয়ার খবরে, আবার আমার চোখে ভেসে উঠছে সেই লাউঞ্জ। কাছে-দূরের টেবিলে জটলা চলছে। কিন্তু নির্দিষ্ট টেবিলে এসে থমকে গেছে সময়। বেজে উঠছে সেই ব্যারিটোন ভয়েস… মুখোমুখি বসে, তাঁর সেই ‘মাশ্কুক নজমেঁ’ থেকে তিনি পড়ে শোনাচ্ছেন– ‘আঁখো কি ভিসা নহিঁ লগতা/ সপনোঁ কি সর্হদ্ হোতি নহিঁ/ বন্ধ্ আঁখো সে রোজ ম্যায় সর্হদ্ পার চলা যাতা হুঁ/ মিলনে মেহদী হাসান সে’। আর বলছেন– ‘বলো, এখানে কি তুমি দেখতে পাচ্ছো কোনও কষ্ট? নাকি সে কষ্ট পেরিয়ে যেতে পারছি আমি?’