জীবনের প্রান্তবেলায় এসে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের কালো কবিতা’ (প্রকাশ: অনুষ্টুপ)। সে কবিতায় দেখা মেলে কবির এক বন্ধুর, এক কালে যাঁর সঙ্গে সানন্দে বসে রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে। তিনি একদিন বললেন, মসজিদ ভাঙার করসেবকদের দলে ছিল তাঁর আত্মীয়। এবং তাঁর জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। বরং উদযাপন করছেন এই তথ্য। কবিতা তখন তাঁকে বলে, ‘আসবেন না কখনো আর এ-বাড়িতে–/ ধৃষ্ট এই কথাগুলি বলে বিদায় করেছি তাঁকে সেইদিন।’ এমন সময় আসে যখন এই ‘ধৃষ্ট’ উচ্চারণটুকু জরুরি হয়ে ওঠে। তা কতদূর নৈতিক, সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
একজন সিআইএসএফ কর্মী কর্তব্যরত অবস্থায় সহনাগরিককে চড় মেরেছেন। ঘটনাচক্রে সেই নাগরিক আবার নবনির্বাচিত সাংসদ। যিনি সংসদে যাওয়ার পথটি তৈরিই করেছেন ঘৃণাভাষণ এবং অন্যকে অপমান করার নিরন্তর আয়াসে। সে কথা থাক। তবে আপাতত এই ঘটনায় জনঅরণ্যে দু’-তরফা উতল হাওয়া। একদিকে, উল্লাসের বসন্ত। অন্যদিকে, নীতির বাঘ বেরিয়েছে বনে। যাঁরা নিরাপত্তারক্ষীকে প্রকারন্তরে সমর্থন করেই ফেলছেন, তাঁরা শুধু সাংসদের যাত্রাপথটিকে খেয়াল করেছেন, তাই-ই নয়; তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি অতীতে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে যেখানে নীতি-নৈতিকতার জলাঞ্জলি হয়েছে। এমনকী, গণতন্ত্রের সাধারণ ধারণাটিও ধূলিসাৎ হয়েছে অনায়াসে। তা নিয়ে যখন নীতির প্রশ্ন ওঠেনি, তাহলে এখন নীতির কথা কেন! অন্যদিকে, যাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্রকে সুবোধ গোপালঠাকুরটি ভেবে থাকেন– গাল টিপলেও যাঁরা রা কাড়েন না, চাইলে পাড়ার দস্যি ছেলে এসে তাঁকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে, তিনি আবার ধুলো ঝেড়ে সুবোধ বালক হয়েই উঠে বসবেন– তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, মহিলা জওয়ানকে সমর্থনের অর্থ কি গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর বসে হিংসাকেই প্রশ্রয় দেওয়া নয়? যে ভারতের মর্মে মর্মে অহিংসার ফল্গু, সেখানে হিংসা নিয়ে এমন চিৎকৃত উল্লাসে তাঁরা নৈতিক পতনের ছায়ামাত্র দেখে দারুণ শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। এবং সহনাগরিকদের চেনা মুখের আড়ালে হিংসার অতর্কিত প্রকাশ দেখে ক্রমশ আর্ত এবং বেদনাহত হচ্ছেন।
এ-কথা ঠিক যে, হিংসা বা আক্রমণ কখনও নীতি হতে পারে না। সাধারণ মানুষ নীতির পণ্ডিত নন; তবে সেই মানুষের হাতে গড়া নৈতিক বাস্তবতাই আসলে সমাজ। নীতি নিশ্চয়ই একটি সাধারণ নিয়মে সকলকে বেঁধে রাখে, তবে তার ব্যতিক্রম যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ভারতের ইতিহাসে সে নমুনা বিরলও নয়। ১৯৩০ সাল, পেশোয়ার বিদ্রোহ। ব্রিটিশ শাসকের নির্দেশ ছিল, বিদ্রোহী শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর। কিন্তু গারোয়ালি সৈনিকরা তা অস্বীকার করেন। কোনও ভাবেই তাঁরা স্বদেশবাসী বিদ্রোহী সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে রাজি ছিলেন না। সাধারণ ভাবে এ তো নিয়মেরই অন্যথা করা। ঠিক সেই কারণেই তাঁদের প্রতি যিনি ভর্ৎসনা করেছিলেন, তিনি স্বয়ং গান্ধী! তাঁর অভিমত, ‘যে সৈন্য গুলি চালানোর আদেশ অমান্য করে সে তো শপথ ভঙ্গ করে।’ অতএব, তাঁর কাছে এই কাজ ছিল, ‘শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধ’। তবে শুধু এটুকু নীতির যুক্তিতেই তিনি থেমে থাকেননি, তাঁর চিন্তার জায়গা আরও ছিল– ‘আজ যদি আমি তাহাদিগকে অবাধ্য হইতে শিক্ষা দিই, তবে আমি যখন ক্ষমতা লাভ করিব তখনও তাহারা ইহাই করিবে।’ (গান্ধীবাদের স্বরূপ, সুপ্রকাশ রায়) হিংসা যে রাষ্ট্রীয় ধারণাকে সমর্থন করে, গান্ধীকে পরবর্তীকালে তার বিপক্ষে কথা বলতেই আমরা শুনেছি। তবে, এই ঘটনায় তাঁর যে অভিমত, তাতে কি তাঁর অহিংস নীতি পুরোপুরি রক্ষিত হয়! ইতিহাসে আজও তোলা আছে সেই প্রশ্ন। এবং অভিযোগও। যে এই বিদ্রোহ দমনকালে শাসকের হাতে যখন বহু মানুষের নির্বিচারে হত্যা হল, তখন গান্ধী তার প্রতিবাদ করলেন না। সৈন্য তাঁর শপথ পালন করেন না, এমনটা সচরাচর হয় না। তবে সেদিন গারোয়ালি সৈন্যদের যে অবস্থান ছিল, তা শপথের বাইরে, নীতির সাধারণ নিয়মকে আরও খানিক প্রসারিত করে দেয়। প্রশ্ন এই জায়গাটাতে, নীতি রক্ষা না স্বদেশবাসীর প্রাণ রক্ষা– কোনটি জরুরি প্রশ্ন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
হিংসা বা আক্রমণ কখনও নীতি হতে পারে না। সাধারণ মানুষ নীতির পণ্ডিত নন; তবে সেই মানুষের হাতে গড়া নৈতিক বাস্তবতাই আসলে সমাজ। নীতি নিশ্চয়ই একটি সাধারণ নিয়মে সকলকে বেঁধে রাখে, তবে তার ব্যতিক্রম যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ভারতের ইতিহাসে সে নমুনা বিরলও নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সুতরাং, কৃত্যাকৃত্য নির্ণয়ের রাস্তাটি খুব সরলরৈখিক নয়। সেখানে নানা সময়েই এমন বাঁক আসে, যা নতুন ভাবনার দিকে সমাজকে ঠেলে দেয়। নীতির প্রশ্নটিকেই তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে হয়। ধরে নেওয়া যাক, সদা সত্য কথা বলিবে। এর অন্যথা তো সাধারণ ভাবে হতে পারে না। আবার অবস্থার প্রেক্ষিতে হতে যে পারেও না, তা একেবারে নয়। সত্যব্রতী কৌশিক মুনির গল্পটি আমাদের জানা। পথিককে তাড়া করেছেন দস্যুরা, পালিয়ে যেতে যেতে পথিক মুনিকে বলে গেলেন, তিনি যেন দস্যুদের অন্য পথ দেখিয়ে দেন। দস্যুরা এলেও মুনি তাঁর সত্যনিষ্ঠা বজায় রাখলেন। পথিকের প্রাণ গেল। আপাত ভাবে এতে তো সত্য কথা বলে মুনি কোনও দোষ করেননি। কিন্তু করেননি কি? আমাদের নীতিপ্রবক্তারা কৌশিক মুনির জন্য স্বর্গ নির্ধারিত করেননি। কেননা এখানে সত্য ধর্ম রক্ষার চেয়েও আরও বড় ধর্ম রক্ষার দায় ছিল। অতএব দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল বলছেন, ‘‘ ‘মিথ্যা কথা বলা পাপ’, ‘প্রতিজ্ঞা রক্ষা ধর্ম’ প্রভৃতি বড় প্রিন্সিপল্। যে কোন অবস্থাতেই এই প্রিন্সিপল্ অনুযায়ী কাজটি ‘ঠিক’ বা ন্যায়সম্মত হচ্ছে না, অবস্থা গতিকে প্রিন্সিপল্ ভেঙে কাজ করলেও সেটা ঠিক বা ন্যায়সম্মত হয়। একে বলা হয় অবস্থাজনিত নীতিধর্মের আপাত-পরিবর্তন অর্থাৎ ‘সিচুয়েশনাল এথিক্স’।’’ নীতি ছাড়া সভ্যতার প্রাণ নেই। তবে সেই নীতির নানা মাত্রাগুল অস্বীকার করলে আবার সভ্যতার প্রাণরক্ষা হয় না। ফলে অবস্থার প্রেক্ষিতটি যদি চিন্তা করা যায়, তাহলে নীতির প্রশ্নটি বোধহয় আর একটু স্পষ্ট হয়। কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে সেদিন গাড়োয়ালি সৈন্যরা শপথ ভঙ্গ করেছিলেন, বা আজ মহিলা জওয়ান এই পদক্ষেপ করলেন, তা বিচার না করাটা এক্ষেত্রে অনৈতিকই হবে।
………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: না বলে যে সিনেমার পাশে দাঁড়িয়েছেন আপনি
………………………………………………………………………..
তবে সোজা কথা, একজন সাধারণ মানুষ নীতির এই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কাজ করতে যান না। তা একান্তই পণ্ডিতদের কাজ। নীতির যুক্তি যেমন রাম কিংবা কৃষ্ণকেও ছাড়েনি, নৈতিক দ্বিধার এই জায়গাগুলোও তেমন থেকে যায়। যা নীতির ধারণাকে বদ্ধ ডোবা করে রাখে না। ফলে একজন মানুষ, যাঁর মাকে অপমান করা হয়েছে, তিনি যখন একটা কাজ করেছেন, তখন হিংসার দোহাই দিয়ে নীতি ও কর্তব্যের প্রশ্ন পাড়া যেতেই পারে। কিন্তু আখেরে তা আর একটা বড় নীতির অধঃপতনের দিকেই এগিয়ে দেয়। যদি ধরে নেওয়াও যায় যে, মহিলা জওয়ান রাগের বশেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, সেই রাগের কারণ দূর করার ক্ষেত্রে তাঁর সহনাগরিকরা কি কোনও ভূমিকা পালন করেছিলেন? হিংসার ভূমিকায় সভ্যতা পতনের শঙ্কা যাঁরা করছেন, তাঁরা কি একদিনও বলেছেন যে, উক্ত সাংসদ যেভাবে মানুষকে ছোট করেন, অপমান করেন, তাতে তাঁর সংসদে যাওয়াই উচিত নয়? বলা যেতে পারে, এমন কোনও কথা বলার পরিসর তাঁদের ছিল না। অথবা ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলা বা না-বলায় কীই-বা যায় আসে! আদতে এই ধরনের হিরণ্ময় নীরবতার মধ্য দিয়েই স্বৈরতন্ত্রের প্রবেশ। যেখানে ব্যক্তিসুবিধের আঁটসাট দুর্গে বসে নীতির প্রশ্ন তোলা তুলনায় সহজ। তবে যদি ঘৃণার বিরুদ্ধে, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, কৃষক এবং আন্দোলনরতদের ক্রমাগত হেয় করার বিরুদ্ধে সামগ্রিক স্বর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হত, তাহলে হয়তো এই দিনটাই আসত না। এমনকী, গণতন্ত্রের ভাষাতেও তার পূর্ণ জবাব দেওয়া সম্ভব হয়নি। নাগরিক হিসাবে নীতিচ্যুত হওয়ার সেই দায় তো অস্বীকার করার জায়গা নেই। সুতরাং, একদিকে যখন স্বৈরতন্ত্র নিজের মতো করে তার কাজ করে চলে, অন্যদিকও তার নিজের মতো করে বাস্তবতা খুঁজে নেবে। হয়তো খুঁজে নেবে ব্যতিক্রমী পথেই। আর সেই সেই ব্যতিক্রমী মুহূর্তেই নীতির প্রশ্ন জাগিয়ে তোলা কতখানি মহানুভবতা আর কতখানি নিজের ত্রুটি ঢাকতে কিল মারার গোঁসাই হয়ে ওঠার প্রবণতা, তাও নীতির খাতিরেই তলিয়ে দেখা উচিত।
……………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: অনুবাদে ভুল, কিন্তু রেলপথ কি সত্যিই হত্যাকারী নয়?
……………………………………………………………………………….
জীবনের প্রান্তবেলায় এসে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘ভারতবর্ষের কালো কবিতা’ (প্রকাশ: অনুষ্টুপ)। সে কবিতায় দেখা মেলে কবির এক বন্ধুর, এক কালে যাঁর সঙ্গে সানন্দে বসে রবীন্দ্রচর্চা হয়েছে। তিনি একদিন বললেন, মসজিদ ভাঙার করসেবকদের দলে ছিল তাঁর আত্মীয়। এবং তাঁর জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। বরং উদযাপন করছেন এই তথ্য। কবিতা তখন তাঁকে বলে, ‘আসবেন না কখনো আর এ-বাড়িতে–/ ধৃষ্ট এই কথাগুলি বলে বিদায় করেছি তাঁকে সেইদিন।’ এমন সময় আসে যখন এই ‘ধৃষ্ট’ উচ্চারণটুকু জরুরি হয়ে ওঠে। তা কতদূর নৈতিক, সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক চড় হয়তো নিরীহ গণতন্ত্রে তেমনই কোনও ধৃষ্ট উচ্চারণ। তবে, তা অবশ্যম্ভাবীও। তাহলে, এই লেখা কি চড়ে উল্লাসকারীদের সমর্থন করবে? নাকি তার বিরুদ্ধবাদীদের উদ্দেশে ক্ষোভ উগরে দিতে চাইবে? আসলে কোনওটাই নয়। এই লেখা মোটের ওপর বলতে চায়, ব্যক্তিমহত্বের পর্দা সরিয়ে নীতির প্রশ্নটিকে আর একটু খোলা চোখে দেখাই বিধেয়। চড় মারা নীতি বা নিয়ম হতে পারে না। তবে, ব্যতিক্রম তো বটেই। ব্যতিক্রম এক রকমের নির্ভেজাল বাস্তবতাই। মানুষ তাঁর নিজের প্রয়োজনমতো সেই বাস্তবতা খুঁজে নেয়। নীতির পণ্ডিতরা তা মানুন, আর নাই-ই মানুন!
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।