২০১৫-এ অভিজিৎ রায়, ২০২২-এ রুশদি ও মাহশা আমিনি এবং ২০২৩-এ মেহরজুই-এর ওপর হওয়া আক্রমণগুলি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আজ ইরানের মৌলবাদী ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর মেহরজুইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে মানেই এই প্রাণহানি অরাজনৈতিক হতে পারে না। তবে দেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এই হত্যাকে অরাজনৈতিক প্রমাণ করার। চেষ্টা চালানো হচ্ছে নিছক সম্পত্তির কারণে খুনের, কিন্তু আমরা আজ জেনে গিয়েছি যে কোনও রাজনৈতিক হত্যাকেই এভাবে আড়াল করে রাষ্ট্র। একজন রাজনৈতিক মানুষ খুন হয় রাজনৈতিক কারণেই।
ইরানের চিত্রপরিচালক দারিয়ুশ মেহরজুই ও চিত্রনাট্যকার, পোশাক ডিজাইনার ভাহিদেহ মহম্মাদিফারকে তাঁদের বাড়িতে ঢুকে ছুরি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে– ক’হপ্তা আগে আসা এমন খবরে আঁতকে উঠেছিলাম আমরা। এমনিতেই ইরানের খবর বাইরে আসতে দেওয়া হয় না বিশেষ, যেটুকু আসে, তাও কয়েকপ্রস্থ সেন্সরশিপের পর। তবে বিশ্বখ্যাত সিনেমা পরিচালক ও তাঁর স্ত্রী-র এই নির্মম খুনের খবর ছড়িয়ে পড়েছিল রাতারাতিই, হয়তো তাঁরা বিশ্বখ্যাত বলেই। না হলে হয়তো এই স্বামী-স্ত্রীর হত্যা দেশের গণ্ডির মধ্যেই চেপে দেওয়া হত। যেমন ইরানে প্রতিদিন, প্রতিরাত্রে মৌলবাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরগুলোর হত্যা চেপে দেওয়া হয়, চেপে দেওয়া হচ্ছে কয়েক দশক ধরে। সঠিকভাবে হিজাব না-পরার অপরাধে নীতিবাদী পুলিশদের হাতে মাহশা আমিনির হত্যার জন্য ফেটে পড়া দেশে আরও কত শত মাহসা আমিনির হত্যা হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান কেউ জানতে পারে না কোনও দিন। জানতে দেওয়া হয় না আরও কত শত মহিলা ও পুরুষ ইসলামি মৌলবাদী রাষ্ট্রের কবলে রাতারাতি মৃতদেহ হয়ে যায়। আবার, এই কয়েকশো মাহশা আমিনির মৃতদেহ থেকে উঠে আসে আরও হাজার হাজার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, যারা হিজাব রাস্তায় ছুড়ে ফেলে মৌলবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে চলে। মাহশা আমিনিদের তাই মেরে ফেলা যায় না। রাবণের কাটা মুন্ডু থেকে যেমন একশো মুন্ডু গজিয়ে ওঠে, তেমনই এক মাহশা আমিনির মৃত্যুতে একশো আমিনির জন্ম হয় প্রতিবার। ইরান থেকে সারা বিশ্বের মহিলাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে ২২ বছরের মেয়েটার প্রতিবাদের আগুন, যে আগুনে ছারখার করে দেওয়া যায় বিশ্বের প্রতিটা কোণায় থাকা মৌলবাদী রাষ্ট্রশক্তিকে। এখন পাঠকের মনে হতে পারে, দারিয়ুশ মেহরজুই ও ভাহিদেহ মহম্মাদিফারের হত্যা প্রসঙ্গে মাহশা আমিনিকে নিয়ে এত কথা আসছে কেন? এই দুই হত্যা কি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত?
ইরানের নবতরঙ্গের এক অন্যতম বেঞ্চমার্ক ছবি ‘দ্য কাউ’ (১৯৬৯)-এর পরিচালক দারিয়ুশ মেহরজুই-এর ১৯৯৬ সালের ছবি ‘লীলা’-র প্রসঙ্গে আসা যাক। লীলা এবং রেজার আপাত সুখের সংসার। তাঁরা স্বচ্ছল, বিবাহিত এবং পরস্পরের প্রেমে মগ্ন। এমতাবস্থায় তাঁরা সন্তানধারণ করতে চাইলে ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায় লীলা সন্তানগ্রহণে অক্ষম। লীলা ভেঙে পড়ে। রেজা বারংবার জানায় এতে ভেঙে পড়ার কিছু নেই, সে সন্তান চায় না, সে লীলাকে নিয়েই খুশি। অথচ লীলার ওপর পরিবারের চাপ আসতে থাকে। রেজার পরিবারে রেজার মা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লীলাকে দোষী করে এবং রেজার দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাব দেয়। রেজা এই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও লীলাই রেজাকে একপ্রকার জোর করে আরেকটি বিয়ে করায়। লীলা মূলত প্যাসিভ এবং শান্ত গোছের মেয়ে, প্রতিবাদ করে রুখে দাঁড়ানোয় সে স্বচ্ছন্দ নয়। তাই নিজের স্বামীকে পাশে পেয়েও সমাজের চাপে পড়ে সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতাকে আত্মীকরণ করে নিতে বাধ্য হয় সে। ছবির শেষে দেখা যায় তাঁদের সুখের পরিবার ছারখার হয়ে গিয়েছে– রেজা তাঁর নতুন স্ত্রীকে সময় না দেওয়ায় সে ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং অপরদিকে লীলা তাঁর বাপের বাড়ির এককোণে বন্ধ ঘরে পড়ে আছে। সন্তান না বহন করতে পারার দায়ে সমাজের দেওয়া অপরাধবোধের চাপে আস্তে আস্তে বদ্ধ উন্মাদ ও নিওরোটিক হয়ে উঠছে লীলা। লীলার এই নিউরোসিস কেবল লীলারই নয়– এ আসলে পুরুষতান্ত্রিক পরিবারপ্রথার কবলে পড়া সমস্ত মহিলা এবং পুরুষের। মেহরজুইউ সরাসরি ইসলামি মৌলবাদের বিরূদ্ধে কখনও সোচ্চার না হলেও তাঁর ছবির পর ছবি জুড়ে রয়েছে ইরানের সমাজ, মহিলাদের অবস্থান এবং ধর্মীয় দমনপীড়ন নিয়ে নুয়ান্সড পর্যবেক্ষণ। যা মৌলবাদেরই আরেক রূপ, বলা যেতে পারে মৌলবাদের ফসল। ‘লীলা’-র কয়েক বছর আগের ছবি ‘সারা’ (১৯৯৩) হেনরিক ইবসেনের ‘আ ডলস হাউজ’ (১৮৭৯)-এর প্রেক্ষাপটে বানানো। যেখানে সারা (ইবসেন-এর নোরা) ‘পারফেক্ট ওয়াইফ’-এর চরিত্রে জীবন কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত হয়ে একসময় পরিবার-স্বামী-গৃহ ত্যাগ করে সন্তানকে নিয়ে নতুন এক জীবনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ইরানের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এমন এক সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুরূহ এবং র্যাডিকাল। সারা সেই পথই বেছে নেয়। দেখা যাবে দারিয়ুশ মেহরজুই-এর নির্মাণ লীলা ও সারা আসলে একই লড়াই লড়ছে, একই অত্যাচারের ভিকটিম। পুরুষতান্ত্রিক শোষণমূলক সমাজের চাপে পড়ে এক মহিলা বাকশক্তি হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে, আরেক মহিলা গৃহ ত্যাগ যাত্রা করছে অনির্দিষ্টের পথে। দারিয়ুশ মেহরজুই-এর পরের পর ছবি জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এমনই সব চরিত্র। যেন এরাই জান-জিন্দেগি-আজাদি (woman-life-freedom) স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে আসছে ইরানের রাজপথ বেয়ে। ইরানের রাজপথ ছেয়ে গিয়েছে লীলা, সারা, পারি-র মতো হাজার হাজার মেয়েদের উল্লাসে। এদের প্রত্যেকের হাতগুলো আজ শক্ত করে ধরা। কয়েক দশকের ইসলামি মৌলবাদের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে এরা প্রত্যেকে আজ খেপে উঠেছে। লীলা, সারা এবং আরও কয়েকশো ইরানের মেয়ে আজ মাথার আচ্ছাদন খুলে পুড়িয়ে দিচ্ছে আগুনে, চুল কেটে লুটিয়ে দিচ্ছে রাস্তায়। বন্দুকের নল আর পুলিশের লাঠির সামনে পড়েও এরা আজ আর ভয় পাচ্ছে না– চিৎকার করে উঠছে তাঁদের অধিকারের লড়াইয়ে– জান-জিন্দেগি-আজাদি! এ লড়াইয়ের ময়দান আঁকড়ে ধরে জিততেই হবে আমাদের।
২০২২ সালের মার্চ মাস। মাহশা আমিনির হত্যার কয়েক মাস আগে। রাষ্ট্রের চাপানো সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে উত্তাল ইরানের সিনেমাজগৎ। ইরানের নবতরঙ্গের অন্যতম হোতা দারিয়ুশ মেহরজুইও সেই দলে সামিল। সিনেমাপ্রেমীদের ভিড়ের মধ্যে থেকে চিৎকার করে উঠলেন তিনি– ‘আমি এই সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করব। আমি এ অনাচার আর নিতে পারছি না। যা ইচ্ছে করে নিন আপনারা– চাইলে মেরে ফেলুন আমাকে! আমি তবু আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে সরব থাকব!’
১৪ অক্টোবর, ২০২৩। একাধিক ছুরির আঘাতে মেহরজুই ও তাঁর স্ত্রীর মৃত রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায় তাঁদেরই ভিলার ড্রয়িং রুমে। জানা যাচ্ছে, ভাহিদেহ মহম্মাদিফার এই ঘটনার আগে বেশ কিছুদিন ধরে আক্রমণের থ্রেট পাচ্ছিলেন। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা না গেলেও এই খুনকে কেন্দ্র করে একাধিক ভাসা ভাসা তথ্য ভেসে আসছে।
২ মার্চ, ২০১৫। বাংলাদেশের ঢাকার একুশে বইমেলা থেকে রিকশা করে বাড়ি ফিরছিলেন ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী বন্যা। আমেরিকানিবাসী বাংলাদেশী ব্লগ লেখক অভিজিৎ বরাবরই মৌলবাদ এবং গোঁড়া ধর্মমূলক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী দলের কিছু লোক তাঁদের রিকশা থেকে নামিয়ে ছুরি মারে। অভিজিৎ ও বন্যা মরণাপন্ন অবস্থায় হাসতালে ভর্তি হন। বন্যা বেঁচে যান, মারা পড়েন প্রতিবাদী লেখক অভিজিৎ।
১২ অগাস্ট, ২০২২। নিউ ইয়র্কের চাতাকোয়া ইন্সটিটিউশানের মঞ্চে সালমান রুশদি উঠেছেন বক্তৃতা দিতে। ৩৩ বছর আগে তাঁর লেখা ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ (১৯৮৮) ইরানের শাসক আয়াতোল্লা খোমেইনির মৌলবাদী শাসনের বিরোধিতা করায় রুশদির ওপর একাধিক খুনের হুমকি আসে। তাঁকে হত্যার দাবিতে ফতোয়া জারি করেন খোমেইনি। রুশদির কাটা মাথার দাম ওঠে তিন মিলিয়ন ডলার। সেই স্যাটানিক ভার্স খ্যাত বৃদ্ধ রুশদির ওপর চাতাকোয়ার মঞ্চে জনসমক্ষে ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক তরুণ। একটুর জন্য জীবনহানি থেকে বেঁচে যান রুশদি, চিরতরে হারিয়ে ফেলেন তাঁর একটি চোখ।
হত্যা ও আক্রমণ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে এতই যে, আর অবাক লাগে না আমাদের। ২০১৫-এ অভিজিৎ রায়, ২০২২-এ রুশদি ও মাহশা আমিনি এবং ২০২৩-এ মেহরজুই-এর ওপর হওয়া আক্রমণগুলি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় কোথাও। আজ ইরানের মৌলবাদী ইসলামিক সরকারের বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর মেহরজুইকে প্রাণ হারাতে হয়েছে মানেই এই প্রাণহানি ‘অরাজনৈতিক’ হতে পারে না। তবে দেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে এই হত্যাকে অরাজনৈতিক প্রমাণ করার। চেষ্টা চালানো হচ্ছে নিছক সম্পত্তির কারণে খুনের, কিন্তু আমরা এখন জেনে গিয়েছি যে, কোনও রাজনৈতিক হত্যাকেই এভাবে আড়াল করে রাষ্ট্র। এই মিথ্যাচার আর ধোপে টেকে না আমাদের কাছে। একজন রাজনৈতিক মানুষ, রাজনৈতিক কারণেই খুন হয়। ২০১৫, ২০২২ ও ২০২৩ সালের টাইমলাইন একত্রিত হয়ে যায় কোথাও। দেশ-কাল-পাত্র আলাদা আলাদা হয়েও এদের ওপর নেমে আসা আক্রমণ কি সম্পর্কহীন থাকতে পারে আর? আবার আমরা প্রবন্ধের শুরুর প্রশ্নে ফিরে আসি। বন্ধু, উত্তর আর হাওয়ায় ভাসছে না। আমাদের উত্তর দিতে সারা পৃথিবীর রাজপথ বেয়ে এগিয়ে আসছে একদল নারী, যাদের হাতে প্ল্যাকার্ড, চোখে আগুন আর বুকে দুর্দম সাহস। এরা খোলা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে এই প্রত্যেকটি হত্যার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, আর চিৎকার করে উঠছে– জান-জিন্দেগি-আজাদি!