কুণালের বিশেষত্ব যে, কুণাল একটি বিরল চরিত্র। বিশেষ করে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের যা অবস্থা, সেখানে খুব কমই মানুষ আছেন, যাঁরা বিষয়টিকে কৌতুক হিসেবে দেখছেন। রাজনৈতিক প্রহসনের মধ্যে দিয়েই তাঁরা আমাদের বিভিন্ন ব্যাপার মনে করিয়ে দেন। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা আমাদের এগুলো জানতে বা মনে রাখতে দিতে চান না।
কয়েক দিন আগে উপমুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডেকে নিয়ে পরোক্ষে কিছু রসিকতা করেছেন কুণাল কামরা, তাই নিয়ে মহারাষ্ট্র তথা ভারতে হইহই পড়ে গিয়েছে। কুণালের কাছে এ নতুন কিছু না। এর আগেও তাঁর রসিকতা ও মন্তব্য নিয়ে দেশ জুড়ে শোরগোল হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে, দেখব, আকবরের সভায় ছিলেন বীরবল, তিনি সম্রাটকে নিয়ে নানা রসিকতা করেছেন, তাতে সম্রাট ক্রুদ্ধ হননি। আমাদের বাংলায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর সভায় ছিলেন গোপাল ভাঁড়, তিনিও রাজাকে নিয়ে নানা রকম রসিকতা করেছেন, রাজা সেটি উপভোগ করেছেন।
মনে পড়ছে, সংবাদপত্রের বিখ্যাত কার্টুন শিল্পী কুট্টির কথা। তাঁর আমলে ভারতের শাসক দলের হেন হেভিওয়েট মন্ত্রী/নেতা ছিলেন না, যাঁদের নিয়ে উনি কার্টুন আঁকেননি, এমনকী, প্রধানমন্ত্রীও বাদ যাননি। কই তাঁকে তো শাসকের ক্রোধের শিকার হতে হয়নি!
কৌতুক অভিনেতা কুণাল কামরা বরাবরই শিরোনামে উঠে এসেছেন হাসির মোড়কে রাজনৈতিক খোঁচা দেওয়ার জন্য। বর্তমানে তাঁর মন্তব্য ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে। বলিউডের বিখ্যাত এক সিনেমার একটি গানের প্যারোডি গেয়ে তিনি একনাথকে টার্গেট করেন। ক্ষিপ্ত শিবসেনা-সদস্যরা তার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টার’-এ (যেখানে শো-টি রেকর্ড হয়েছিল) ভাঙচুর করে এবং কুণালের বিরুদ্ধে দায়ের করে এফআইআরও।
কুণাল কামরা তাঁর ইউটিউব স্পেশাল– ‘নয়া ভারত’-এ, উদ্ধব ঠাকরের বিরুদ্ধে শিন্ডের ২০২২ সালের বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিতে ১৯৯৭ সালের ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ সিনেমার একটি হিন্দি গানের প্যারোডি ব্যবহার করেছেন। কুণাল এই গানটির একটি প্যারোডি করে তাঁর শোয়ে গেয়েছেন, যে-গানে পরোক্ষে তিনি একনাথ শিন্ডের উদ্দেশে ‘গদ্দার’ এবং ‘দলবদলু’র মতো বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। এই বিষয়টি নিয়েই চরম আপত্তি জানিয়েছে শিবসেনা।
কৌতুক শিল্পী যাঁরা, তাঁদের কাজই হল ক্ষমতার পিছনে লাগা। এই ব্যাপারটা যে কোনও বেনেভোলেন্ট রাজা অথবা রাজত্ব এবং তারপর গণতন্ত্রে যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। কৌতুক রস মানুষের জীবনের যত রকম ট্র্যাজেডি, তার একটা চুলচেরা বিচার করে সেই নির্যাস একটা জোক হিসেবে জনতার কাছে তুলে ধরে। আর পাওয়ারের পিছনে লাগার ব্যাপারটা নিশ্চয় সকলের মনে আছে যে, ‘স্পাইস জেটে’-ও অর্ণবের পিছনে লেগেছিল। তারপর ওকে ছ’-মাস ওই প্লেনে উঠতেই দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এসব কি ও জানত না? এবারও যেমন ইউটিউবে ২৪ মার্চ আপলোড হয়েছে ভিডিওটি। পরের দিনই ওর কাছে থ্রেট কল এসেছে। সেটারও রেকর্ডিং করে ও আপলোড করেছে এবং সেটি ‘ভাইরাল’ হয়েছে। জানা গিয়েছে যে, ওই রাজনৈতিক দল থেকে গুন্ডারা ওকে ফোন করে শাসিয়েছিল। ওরা জিজ্ঞেস করছিল যে, ও কোথায় আছে? কুণাল বলেছে যে, ‘তামিলনাডুতে আছি, চলে আয়।’ তারা ভাবছে এতদূর যাবে কী করে? এটা নিয়েও একটা হাসাহাসি হচ্ছে সমাজমাধ্যমে। এই সংকটেও পেছনে লাগাটা ছাড়ছে না।
এখানেই কুণালের বিশেষত্ব যে, কুণাল একটি বিরল চরিত্র। বিশেষ করে আমাদের দেশের গণতন্ত্রের যা অবস্থা, সেখানে খুব কমই মানুষ আছেন, যাঁরা বিষয়টিকে কৌতুক হিসেবে দেখছেন। রাজনৈতিক প্রহসনের মধ্যে দিয়েই তাঁরা আমাদের বিভিন্ন ব্যাপার মনে করিয়ে দেন। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা আমাদের এগুলো জানতে বা মনে রাখতে দিতে চান না।
কিন্তু কুণালরা জোকটা এমনভাবে করেন যে, সেটা আমাদের মনে বারবার ফিরে আসে আর আমরা হাসি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, মার্কিন কমেডিয়ান জর্জ কার্লিনের কথা। দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে উনি মার্কিন গণতন্ত্রের সমালোচনা করছেন রসিকতার ছলে। কারওর পিছনে লাগতে উনি পিছপা হননি। সমসাময়িক মার্কিন কমেডি জগতে ডেভ শ্যাপেল থেকে শুরু করে জন অলিভার এই একই কাজ করে যাচ্ছেন। তারপর জন স্টুয়ার্ট ও ট্রেভর নোয়া এই কাজ করে যাচ্ছেন।
পৃথিবী জুড়েই এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কৌতুকশিল্পীরাই আমাদের সমাজের কঠিন সত্যটি জানাচ্ছেন। কারণ মিডিয়া ফেল করে গেছে।
ভারতের কৌতুক শিল্পীরা নানা সময়ে নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন। কিন্তু বাকি কমেডিয়ানদের সঙ্গে কুণালের তফাত হল, কুণাল বরাবর রাজনৈতিক ও তাঁর রসিকতা তীক্ষ্ণ ও তাতে ঝুঁকি থাকে। বর্তমান ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাচ্ছি শাসককে নিয়ে রসিকতা কি রাজ্য কি কেন্দ্র– কেউ সহ্য করতে পারছে না। অথচ ভারতের সংবিধান কী বলছে দেখা যাক:
সংবিধানে বাক্ স্বাধীনতার ভিত্তি:
ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১)(ক) বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
১। এই অধিকারের মধ্যে রয়েছে মৌখিক, লিখিত, এবং ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
২। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
৩। ব্লগ এবং ওয়েবসাইটে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
সংজ্ঞা:
বাক্ স্বাধীনতা হল মৌখিক, লিখিত বা অন্য কোনও মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করার অধিকার।
কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশে একজন কমেডিয়ান শাসককে নিয়ে রসিকতা করবেন এ তো স্বাভাবিক এবং শাসকেরও সেটি মনপসন্দ হবে না। কিন্তু এখানেই শাসকের পরীক্ষা, আমাদের বর্তমান শাসক যে পরীক্ষায় বারবার ফেল করছে । রসিকহীন, রসিকতাহীন একটি সমাজে আমাদের বসবাস করতে হবে?
‘তাসের দেশ’-এ যখন রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র তাসেদের দেখে হাসাহাসি করছিল, তখন তাসেরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে রাজসভায় নিয়ে যায় ও তাদের একটা বিচার হয়। এই সিনেমাটা ২০১৩-তে আমরা বানিয়েছিলাম, যেন আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম আগামী ১০ বছরে কী ঘটবে। কুণালও ওই সময় একই কাজ করছিল। আজও করে যাচ্ছে। দেখে ভালো লাগছে যে, পেছনে লাগার আজও কয়েকটা লোক আছে আমাদের দেশে। নাগরিক হিসেবে আর কী করার আছে?
………………………………….
আরও পড়ুন প্রতীক-এর লেখা: হিন্দিভাষী ইউটিউবাররা যা করলেন, বাঙালিরা যা করলেন না
………………………………….
এই ঘটনার উত্তরে কুণাল বলেছেন, ‘একটি বিনোদন স্থান কেবল একটি প্ল্যাটফর্ম। সব ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য একটি স্থান। হ্যাবিট্যাট আমার কৌতুকের জন্য দায়ী নয়, আমি যা বলি বা করি তার ওপর এর কোনও ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ নেই। কোনও রাজনৈতিক দলেরও নেই। একজন কৌতুকাভিনেতার কথার জন্য একটি স্থানকে আক্রমণ করা এক লরি টম্যাটো উল্টে দেওয়ার মতোই অর্থহীন, কারণ আপনাকে যে বাটার চিকেন পরিবেশন করা হয়েছিল তা আপনি পছন্দ করেননি।’
‘আমাদের বাক্ স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের অধিকার কেবল ক্ষমতাশালী এবং ধনী ব্যক্তিদের প্রশংসা করার জন্য ব্যবহার করা হয় না, যদিও আজকের মিডিয়া আমাদের সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। জনসাধারণের টাকায় আপনি একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি, রসিকতা গ্রহণ করতে আপনার অক্ষমতা আমার অধিকারের প্রকৃতি পরিবর্তন করে না। যতদূর আমি জানি, আমাদের নেতাদের এবং আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সার্কাসকে নিয়ে মজা করা আইনবিরোধী নয়।’
৪৫ মিনিটের এই ভিডিওটা এখনও পর্যন্ত ২ মিলিয়ন ভিউ চলছে। যত লোকে হাসবে, তত আওয়াজ হবে, আওয়াজ হলে পাওয়ার কাঁপবে।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।