আমার ছোটকাকাকে আরও অনেকের সঙ্গে একটা ট্রেনে করে পুলিশেরা নিয়ে গিয়েছিল। ঠাকুমা মাঝে মাঝে অন্য কারও চটি খোলার শব্দে, দরজা ভেজানোর আওয়াজে, বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সামান্য কম্পনে চমকে বলে উঠত– ‘কে বুলু এলি?’ বড় কোনও ছবি কোথাও ছিল না ছোট্কা-র। ওর একটা ছোট ছবি মা ঠাকুরের তাকে, একপাশে রেখে দিয়েছিল। আমার কাছে ছোটকা একটু একটু করে আরও ছোট হচ্ছিল… ছোট হতে হতে বাগানোর ঘাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল… বইয়ের তাকে একটা ধুলো মাখা চশমা হয়ে যাচ্ছিল আর মেজবাবু হাসছিল, হাসতে হাসতে আমাদের বলছিল– ‘আরে মহব্বতি নয়… মাওবাদী… আমি দেখছিলাম চশমাটার কাচে আর কিছু দেখা যায় না… দেখছিলাম দুটো বুড়ো-বুড়ির মুখ, চিনি না তাদের।
ওরা সবাই চাইত সে একদিন ফিরে আসুক। কোনও এক ভোরে, পাতায় পাতায় জমা জলের বিন্দুগুলি কেঁপে উঠুক, ঝর ঝর করে ঝরে পড়ুক গাছেদের বিশুষ্ক যা কিছু, আর ফুল অবাক হয়ে মেলতে থাকুক তার শিহরিত পল্লব যখন সারা অরণ্যময় ডেকে উঠছে পাখিরা। ওরা জানত সেই প্রথম সংগীত, যা উড়তে থাকবে হাওয়ায় আর তুমি ফিরে আসবে কাদা-পাথর ঠেলতে ঠেলতে, উচ্ছল, আনন্দময়, দু’পাশের বৃক্ষরাজি ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন জানাবে তোমায়, সমস্ত আলো এক হয়ে ঝলমল করতে থাকবে ঢেউয়ে ঢেউয়ে…
‘সে’– মানে এক হারিয়ে যাওয়া নদী। বহু বছর আগে সে বয়ে যেত এই তাইরুলি গ্রামের পাশ দিয়ে। এঁকেবেঁকে জঙ্গলে জঙ্গলে পাক খেয়ে, লাফিয়ে পড়ত নিচে জমে থাকা মেঘের ওপর আর সরু চিকচিকে ফিতের মতো বইতে থাকত পাহাড়তলির সবুজ অধিত্যকা বেয়ে। তখন পাহাড়েরা ছিল। গাছেরা ছিল সতেজ, সন্নিবিষ্ট। একদিন সকালে সে এই গ্রাম ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। ফাঁকা নদীখাতে গুমরে ওঠে হাওয়া। গাছেরা বিষণ্ণ হয়। শুষ্ক হয়ে ওঠে গোটা জঙ্গল। লাল ধুলো ওড়াতে ওড়াতে ক্ষয়ে যেতে থাকে পাহাড়েরা। সে আর ফিরে আসে না। তাইজানরা দলে দলে ভাগ হয়ে খুঁজতে বেরয় তাকে। দেশ জুড়ে প্রতি বছর, প্রতি বসন্তে আর খুঁজে পায় না কখনও। সে না বলে চলে গিয়েছে কোথাও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বুধুয়া মহব্বতির হাতে পড়ে গেল… মাঠে ভৈস, বখরি লিয়ে যেত, ওর বুদ্ধি ছিল না, অনেক তাকত ছিল। খেতির কাম না থাকলে ঘরে বসে থাকত। কোনও ইয়ার দোস্ত, খেত-খামারি, নেশা-উসা কুচ্ছু না। বাৎ ভি বহত কম। সে বছর মকরের টাইমে বাড়ি থেকে পয়সা লিয়ে বলল কি কোন মেলা যাবে। দেহাত থেকে বাস-পার্টির সঙ্গে চলে গেল… আজ চাওদা সাল হয়ে গেল কোই পাতা হি নহি। পরে পুলিশ বাতাল কি ও মেলা যায়নি, পয়সা লিয়ে মহব্বতির সঙ্গে জাঙ্গাল মে পালিয়ে গেছে…।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কুয়াশা ঢাকা একটা রাত উপুড় হয়ে পড়ে আছে হাজরার মোড়ে। ৩০ নম্বর ট্রামের ঘড় ঘড় আওয়াজ, এস.টি.ডি. বুথে– ‘অসীম? অসীম… হ্যালো.. অসীম..’, শাটল ট্যাক্সির হাঁক-ডাক আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে। আমরা চুপ করে শুনছিলাম আর জলে ভিজে চিক্ চিক্ করছিল কথকের চোখ। ‘‘জানো, এখনও যখন বৃষ্টির জলে এ রাস্তাটা ভরে ওঠে, নদীর মতো বয়ে যায়, আমি ভাবি ‘কুসু’ ফিরে এসেছে… হয়তো এখানে, হয়তো অন্য কোথাও।’’ একটা উধাও হওয়া নদী আর তার সন্ধানে একটি জনজাতির উন্মাদনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে উপকথার মতো উৎসবে পরিণত হয়। পাখিদা-র মুখে ওর চায়ের দোকানে বসে এ গল্প আমরা যতবার শুনি, ততবারই যেন কুসু ফিরে আসে। অথচ কেউ-ই ফেরে না… ভুলন, ছোট্কা, পুতুল, অনিন্দ্য সিংহ, আমাদের পুরনো বাড়ি, সুমন্তদের লাল রোয়াক, একটা গড়ানো ফুটবল পার্কের ভাঙা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে গলে গড়াতে থাকল এ রাস্তা থেকে সে রাস্তায় আর হারিয়ে গেল একদিন…।
‘বুধুয়া মহব্বতির হাতে পড়ে গেল… মাঠে ভৈস, বখরি লিয়ে যেত, ওর বুদ্ধি ছিল না, অনেক তাকত ছিল। খেতির কাম না থাকলে ঘরে বসে থাকত। কোনও ইয়ার দোস্ত, খেত-খামারি, নেশা-উসা কুচ্ছু না। বাত ভি বহত কম। সে বছর মকরের টাইমে বাড়ি থেকে পয়সা লিয়ে বলল কি শোন মেলা যাবে। দেহাত থেকে বাস-পার্টির সঙ্গে চলে গেল… আজ চাওদা সাল হয়ে গেল কোই পাতা হি নহি। পরে পুলিশ বাতালো কি ও মেলা যায়নি, পয়সা লিয়ে মহব্বতির সঙ্গে জাঙ্গাল মে পালিয়ে গেছে…।’ লালা-র মুখে তার ছেলের লাপাতা হওয়ার গল্প বিহারের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামের সন্ধের মাঠে মাঠে ভাসিয়ে দিতে থাকে গরম রুটির গন্ধ। উনুনের লাল গহ্বরের ওপর কাঁপতে থাকে তার মুখ। একটা একটা করে রুটি ফুলে ওঠে আর ভাঙা পায়ের টেবিলে টেবিলে জড়ো হতে থাকে খেটে খাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের দল। ফুটপাথের এক কোণে গরিবের খাওয়ার দোকান আছে লালার। আটা ছড়ানো, অপরিষ্কার আর ইতস্তত এই দোকানে যারা খেতে আসে তারা নিষ্প্রভ, নীরব– যেন ধুলো থেকে এইমাত্র উঠে এসেছে। তারা লালাকে নিচু স্বরে পরামর্শ দেয়। লালা শোনে। সপ্তাহে চারদিন থানায় গিয়ে বসে থাকে। আমরা কখনও যাই, দেখি– একটা বিরাট বোর্ডে থিক থিক করছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের ছবি। তলায় নাম ও ঠিকানা, নিচে লালবাজার মিসিং পার্সনস স্কোয়াড। সার সার বিবর্ণ বিবশ মুখ। কোনওটা ছিঁড়ে গেছে, কোনওটা অর্ধেক খুলে ঝুলে পড়েছে নিচে। মেজবাবু লালাকে বুঝিয়ে যাচ্ছেন। লালা হাতজোড় করে বলছে– ‘স্যর ও এখন পাঞ্জাবের দিকে আছে। গুণিন বলেছে হামায়, দার্পাণ ভি করিয়েছি স্যর, আপলোগ থোড়া দেখিয়ে স্যর, হামার আউরত বহুত বিমার হয়ে গ্যাছে’… লালা তান্ত্রিকের কাছে যায়। লালা ঝাড় ফুঁক করায়। লালা অঙ্গুঠি ধারণ করে। লালা মাজার শরিফ যায়। লালা ভূতের মেলায় গিয়ে ভূত কিনে তাকে মুক্তি দেয় আর বলে– ‘বুধুয়া কো লাওটা দো মাহারাজ, ঘর ভেজো উসে’… একটা কেটে যাওয়া ঘুড়ি লটকাতে লটকাতে উড়ে যায়… বুধুয়া ফেরে না, গুণিন কখনও বলে– এখন উঁচু পাহাড়ের দিকে আছে। কখনও বলে– কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি আছে কোথাও…
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: নবান্ন নাটকে মন্বন্তরের মঞ্চায়ন শুধু নয়, ‘মাসিমা মালপো খামু’ও বিজন ভট্টাচার্যেরই কলম নিঃসৃত
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বনবন করে একটা লাট্টু ঘুরছে… হাতের তালুর ওপর তাকে নাচিয়ে খেলা দেখাচ্ছে রতনদা। এরপর হবে চারটে বলের জাগলিং, তারপর চারটে বোতলের, তারপর ছুরির আর সবশেষে চোখ-হাত বেঁধে সাইকেলে ওয়াটার ব্যালেন্স। পুতুল চলে যাওয়ার পর থেকে পাগলাটে ধরনের হয়ে গ্যাছে। কেউ বলে মেয়েটা কীর্তন দলের সঙ্গে চলে গেছে, ওর ভক্তিভাব ছিল। পুলিশ বলে কোনও ছেলের সঙ্গে পালিয়েছে। দিনের পর দিন যায়। একটা বাড়িতে একজন নেই, চলে গ্যাছে, আর ফেরেনি কখনও…
একটা ফোন এল– এক ভদ্রমহিলা নাম জিজ্ঞেস করলেন। বললাম– হ্যাঁ, আমি-ই। বললেন অনিন্দ্য সিনহাকে চিনি কি না? বললাম খুব ভাল ভাবে চিনতাম। বললেন ওর বাবা-মা লালবাজারে এসেছেন, ওকে প্রায় দু’বছর হল পাওয়া যাচ্ছে না… আমরা অনেক কথা বললাম। আমার এক বছর সিনিয়র ছিল স্কুলে, ওর নির্দেশনায় নাটক করেছি। লেখা শুনিয়েছি, শুনেছি, আড্ডা মেরেছি রাতের পর রাত। মেধাবী ছাত্র, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, যাদবপুরে ইলেকট্রনিক্স তারপর সোনোডাইনে চাকরি, তারপর সেটা ছেড়ে অধ্যাপনা– ধাদকা পলিটেকনিক, আসানসোল (আমি তখন রানিগঞ্জে)। নেশা করত, অসামান্য গান লিখত, তার কাটত, তার জুড়তও…। একদিন হাওয়া হয়ে গ্যালো… মিলিয়ে গ্যালো। আমরা খোঁজ নিলাম, ভাবলাম হয়তো নিজেই রিহ্যাবে গেছে, ফিরে আসবে…। কিন্তু অনিন্দ্য সিনহা উবে গ্যালো। ‘ছোট্ট মানুষ আরও ছোট্ট হয়ে যায়… ছোট্ট হতে হতে একদিন… বাগানের ঘাসে তার চশমা পাওয়া যায়’– একটা গান ছিল সিনহার।
আমাদের ক্যাম্বিসের দাগ লাগা দেওয়ালেরা, বিকেলে কাপড় তুলতে এসে দু’মিনিট– সিনেমার ইন্টারভেলের মতো, ফোনে– ‘মাসিমা শৈবাল আছে?’ বলার মতো উবে যাচ্ছে দ্রুত। দেওয়ালে দেওয়ালে একটি মেয়ের কাট-আউটের পাশে সংখ্যা বেড়ে চলেছে রোজ। কারা হারিয়ে যাচ্ছে? কে কাকে হারিয়ে ফেলছে? বৃদ্ধ বাবাকে রেখে একটি পরিবার এই বিরাট মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে… সে জিজ্ঞেস করছে তার পরিবারের কথা, কেউ বলতে পারছে না। কেউ তাকে তার দেশের কথা, গ্রামের কথা জানতে চাইছে, সে ভুলে গেছে– সঠিক বোঝাতে পারছে না আর একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে রোজ…
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: মৃত তারার সন্তান ও একটি সুইসাইড নোট
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমার ছোটকাকাকে আরও অনেকের সঙ্গে একটা ট্রেনে করে পুলিশেরা নিয়ে গিয়েছিল। ঠাকুমা মাঝে মাঝে অন্য কারও চটি খোলার শব্দে, দরজা ভেজানোর আওয়াজে, বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সামান্য কম্পনে চমকে বলে উঠত– ‘কে বুলু এলি?’ বড় কোনও ছবি কোথাও ছিল না ছোট্কা-র। ওর একটা ছোট ছবি মা ঠাকুরের তাকে, একপাশে রেখে দিয়েছিল। আমার কাছে ছোটকা একটু একটু করে আরও ছোট হচ্ছিল… ছোট হতে হতে বাগানের ঘাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল… বইয়ের তাকে একটা ধুলো মাখা চশমা হয়ে যাচ্ছিল আর মেজবাবু হাসছিল, হাসতে হাসতে আমাদের বলছিল– ‘আরে মহব্বতি নয়… মহব্বতি নয়… মাওবাদী… আমি দেখছিলাম চশমাটার কাচে আর কিছু দেখা যায় না… দেখছিলাম দুটো বুড়ো-বুড়ির মুখ, চিনি না তাদের… দেখছিলাম– পুতুলের কাট-আউটে ভরা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে কীর্তন গাইছে একটা মেয়ে… দেখতে পাচ্ছিলাম বুধিয়া জঙ্গলের ভেতর একটা ঘর বেঁধেছে মহব্বতির সঙ্গে… রুটি হচ্ছে ওদের বাড়িতে… গন্ধে ভরে উঠছে চারদিক…।